হানিমুনে
মৌবনী ও কৌশিকের বিয়ে প্রায় দু’বছর হতে চলল। অনেক বার হানিমুন করতে যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার ঠিক হল যাবেই। শুধু দিন-তারিখ ঠিক করতে বাকি। বেশ খুশি খুশি মৌবনী। বন্ধুদের হানিমুনের গল্পের সঙ্গে নিজের ইচ্ছেগুলিকে গোপনে গোপনে রং করতে থাকে। শুধু দুজনের একা থাকার ক্যানভাসে অনেক একান্ত চাওয়া-পাওয়ার কথা প্রতিদিন আঁকা হতে থাকে অজান্তেই।
একদিন কৌশিক রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় এসে জানাল যে সত্যি সত্যি তারা হানিমুনে যাচ্ছে। শুনে মৌবনী সামুদ্রিক উচ্ছ্বাসে কৌশিকের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আপৃষ্ঠ আলিঙ্গনে কৌশিকের সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছিল মিহি আনন্দে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই শুকনো পাতার মতো কৌশিকের বুক থেকে নিঃশব্দে খসে পড়ল সে। যখন শুনল, তাদের সঙ্গে কৌশিকের বাবা-মা-বোন, বোনের হাজব্যান্ড ও কৌশিকের বড়দাও যাবে বেড়াতে। সে রাতে মৌবনী দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। পরের দিন, তার পরের দিন এবং কোনদিন মৌবনী তার এই অপমানের কথা কাউকে টের পেতে দেয়নি। বিজ্ঞাপনের মতো হাসি দুলিয়ে মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিল— ঠিক আছে। সবাই তো আপনজন। সবাই মিলে একটা ভাল জায়গায় কয়েকদিন কাটানো তো যাবে। মৌবনী তখনও জানত না যে তারা কোথায় বেড়াতে যাবে।
দিন দুই তিন পরে কৌশিক এক গাল হেসে মৌবনীকে জানাল যে তারা হানিমুন করতে মায়াপুর যাচ্ছে। এক নাগাড়ে কৌশিক মায়াপুরের ইসকন মন্দিরের এবং রাধা-কৃষ্ণের মাহাত্ম্য বলে গেল। মৌবনী ম্যালেরিয়া রুগির কুইনাইন গেলার মতো কৌশিকের কথাগুলি গিলছিল। বাইরে কোন বিরক্তির প্রকাশ নেই। কিন্তু, ভিতরে ভিতরে ইঞ্জিনের পিস্টনের চলাচল। পৃথিবীর কোন অক্ষাংশে-দ্রাঘিমাংশে এই চলাচলের এতটুকু কাঁপন পর্যন্ত লাগল না। মৌবনী সেদিনও মনকে ধীরে ধীরে বোঝাল যে মায়াপুর তো ধর্মস্থান। বিদেশি ইসকনদের চোখ ধাঁধানো মন্দির। রাধা-কৃষ্ণের মনমোহন মূর্তি, চব্বিশ ঘন্টা কীর্তন। মন্দ নয়।
মুশকিল হল, তারিখ কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না। মায়াপুরের রাস, দোল-ঝুলন মৌবনীর দেখার খুব ইচ্ছে। এই রকম একটি অনুষ্ঠানে হানিমুনটা হলে অন্তত বলার মতো অথবা মনে রাখার মতো হবে। কিন্তু, মৌবনীর এখানেও বিধি বাম। সপরিবারে মায়াপুর যাওয়া হল ঠিকই; কিন্তু সেটা এমন একটা সময়ে, যখন হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের উপস্থিতি থাকে সেখানে। এমন একটা সময় বাছার কারণটা মৌবনী অবশ্য পরে বুঝেছিল; মায়াপুর যাওয়ার পর। কারণটা হল, কৌশিকের দাদা মায়াপুরের ইসকন ট্রাস্টির একজন সাধারণ সদস্য। তাই এই অফ সিজিনে সে দুটো রুম ম্যানেজ করতে পেরেছে। মৌবনীর তখন টিউব থেকে বেরিয়ে আসা টুথপেস্টের মতো অবস্থা। হানিমুন যে এমন হানিকারক হতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
ওরা এই মাত্র মায়াপুরে এসে পৌঁছল। কিন্তু এখানে এখনও যে দুঃস্বপ্নের শেষ একটা দৃশ্য মৌবনীর জন্য অপেক্ষা করছিল, তাও মৌবনীর বোধের অগম্য ছিল। মৌবনী নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। শুধু শুধু দুঃখ করে আর লাভ কী। বরং জার্নি করা ক্লান্ত শরীরটাকে স্বাধীন ভাবে, দু’জনে একান্তে বিছানায় ছড়িয়ে দিয়ে একটু স্বস্তি তো নেওয়া যাবে।
এইসব ভাবতে ভাবতে মৌবনী যখন কৌশিকের পিছন পিছন একটা রুমের দিকে এগোচ্ছিল, তখন পিছন থেকে শাশুড়ি-মায়ের L238 রুটের বাসের হর্নের মতো কণ্ঠস্বর দৌড়ে এল— বৌমা, আমরা মেয়েরা সবাই এক ঘরে থাকব, আর ছেলেরা সবাই এক ঘরে থাকুক। মৌবনী শাশুড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়াল এবং সম্মোহিতের মতো নির্দিষ্ট রুমের দিকে এগোতে থাকল। আর মনে মনে ভাবতে থাকল, হাজব্যান্ড নামক প্রাণীটি পৃথিবীতে সব চেয়ে নিকৃষ্ট জীব এবং হানিমুন শব্দটি একটি চরম অশ্লীল শব্দ।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment