প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব] | পারমিতা চ্যাটার্জি

বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/১ ৯ তম সংখ্যা/ ৩০শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ ধারাবাহিক উপন্যাস পারমিতা চ্যাটার্জি শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব...

Saturday, August 5, 2023

বর্ষা | হাত বদল | জনা বন্দোপাধ্যায়

 

বাতায়ন/ছোটগল্প/বর্ষা/১ম বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/১৯শে শ্রাবণ, ১৪৩০

ছোটগল্প
বর্ষা
জনা বন্দোপাধ্যায়

হাত বদল

“হ্যাঁ রে ন্যাপলা, তুই মুখটা ও’রকম বাংলার পাঁচের মতো করে আসছিস কেন?” বিশু, রায় বাবুদের রোয়াকে বসে বিড়ি টানতে টানতে প্রশ্নটা ন্যাপলার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়। ন্যাপলা লম্বা দাড়ি ও চুলের মাঝে ঝুলে থাকা ত্রিশঙ্কুর মতো মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “আর বলিস না, দুপুরে পাশের পাড়ার নেড়ি কুত্তাটা ছুটে এসে কামড়ে দিল, তাই ইঞ্জেকশন নিতে হাসপাতালে গেছিলাম।” “হ্যাঁ রে কাল পাঁচ কেজি ওজনের মালটা ঠিকঠাক পাচার করেছিলি? ঘোষদা তোকে কত দিয়েছে?” বিশুর প্রশ্নের উত্তরে ন্যাপলা মুখ বেঁকিয়ে বলে, “শালা এখনো কিছুই দেয়নি রে। ঝুলিয়ে রেখেছে। ধরতে হবে।” বিশুও বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “সত্যি, এদের ঝেলতে ঝেলতে লাইফটাই হেল হয়ে গেল!”

বিশুর ভদ্রস্থ সুন্দর চেহারা দেখে কেউ বলবে না যে বিশু মাদক পাচারকারী। বিশুর অন্য এক বন্ধু অসিত বলেছিল, “বিশে, তোর কার্তিকের মতো চেহারা। ঘোষ বাড়ির মেয়েটার কত ইচ্ছে ছিল তোর সঙ্গে লাইন মারার। আহা অমন সুন্দর রাণী মুখার্জীর মতো দেখতে!” বিশু রেগে অসিতকে মারতে যায়। বিশু নিজের বাবাকে কোনদিন দেখেনি। তার মা হাওড়া স্টেশন চত্বরের হোটেলে বাসন মাজার কাজ করত। মা-ছেলের রাতে শোবার জায়গা ছিল ফুটপাত। বিশুর জন্ম হয় হাওড়া স্টেশনের প্লাটফর্মে। পোয়াতি মাকে ফেলে বিশুর বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আর পাঁচটা ফুটপাতের বাচ্চার সঙ্গেই বিশু বড় হয়। একজন ধনী ব্যবসায়ী একবার তাদের মতো পথশিশুদের জন্য এলাহি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। বড়লোকদের দেখে বিশুর হিংসে হয়। বিশুর মায়ের ক্যানসার হয় বছর পাঁচেক আগে। তখন বিশু সবে আঠারোতে পা দিয়েছে। বিনা চিকিৎসায় তার মাকে চলে যেতে দেখে কষ্টে ভেঙে পড়ে। নিজের প্রতি ক্ষোভ হয়। পৃথিবীটা বিশুর কাছে অসার মনে হয়। ধনীদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তারপরই নরেশ ঘোষ নামে এক দালালের পাল্লায় পড়ে মাদক পাচারকারীদের দলে নাম লেখায়। এই দলেই ন্যাপলা, অসিত, জগার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। বিশুর মা মারা যাবার আগে বিশুর জন্য খুব চিন্তা করত। রাতে মাঝে মাঝে মাকে স্বপ্নে দেখে বিশু।

মাঝের পাড়ার দু’ নম্বর কলোনিতে ন্যাপলা, বিশু আর অসিত একটি ছোট টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর ভাড়া নিয়েছে। মাসের ভাড়া ছ’শো টাকা। বিশুদের দলের ন্যাপলা একবার ধরা পড়ে এক বছর শ্রীঘরে বাস করে এসেছে। ন্যাপলার শৈশব কেটেছে দুর্গাপুরের মাধাইপুরে। ওখানকার জীবন কয়লাকে কেন্দ্র করে। ন্যাপলার মা ন্যাপলার জন্মের সময় মারা গেছে। ন্যাপলার বাবা ছিল কারখানার অস্থায়ী শ্রমিক। ন্যাপলার চার বছরের বড় দাদা আর ন্যাপলা স্কুলে প্রাথমিক বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। একদিন হঠাৎ করেই মাধাইপুর এলাকার খোলামুখ খনিতে কয়লা তুলতে গিয়ে ধসে চাপা পড়ে ন্যাপলার বাবা ও দাদার মৃত্যু হয়। ন্যাপলার বয়স তখন ষোলো বছর। দিনের পর দিন ভিক্ষে করে বেড়ায় ন্যাপলা। আত্মীয়স্বজন কেউই আশ্রয় দেয় না। একদিন ওই এলাকার এক জুয়াড়ি ন্যাপলাকে কলকাতা নিয়ে আসে। জুয়াড়ির এক বন্ধু ছিল রঙের মিস্ত্রি। তার সাহায্যকারী হিসাবে ন্যাপলা কাজ শুরু করে। ওই রঙের মিস্ত্রির বাড়িতেই ন্যাপলার ঠাঁই হয়। কিন্তু স্বভাব দোষে একটি বাড়িতে রঙের কাজের সময় চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ন্যাপলা। বয়স কম বলে বাড়ির মালিক তাকে পুলিশে দেন না। কিন্তু ন্যাপলার রঙের কাজটা চলে যায়। আবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। কিছু দিনের মধ্যে রাস্তায় একটি চায়ের দোকানে নরেশ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় হয় ন্যাপলার। তখন থেকেই নরেশ ঘোষের দলের সঙ্গে যুক্ত হয়।

ন্যাপলার বন্ধু অসিত আট ক্লাস পাশ করে বাসের খালাসির কাজ করত। খুবই সাহসী ও দুরন্ত ছিল। গোখরো সাপের বাচ্চা হাতে করে ধরে শিশিতে ভরে রাখত। মাঝ রাতে বন্ধুদের সঙ্গে বেট ধরে শ্মশানে যেতে কোন দ্বিধা করত না। বজ্র-বিদ্যুৎ মাথায় নিয়ে পাড়ার পুকুর এপার-ওপার করত। পাড়ার ছেলেরা আবদার করলে তাদের বড় পুকুরে সাঁতার শেখাত। বড় সরল মনের ছেলে। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ায় মাত্র আঠারো বছর বয়সে মা আর ছোট বোনের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে। অর্থ রোজগারের নেশা অসিতের লোভ বাড়িয়ে দেয়। সে-ও একদিন নরেশ ঘোষের দলে যোগ দেয়। অসিত বাড়িতে মানি অর্ডার করে টাকা পাঠায়। কিন্তু আর কোনদিনই বাড়িতে দেখা করতে যায় না। কারণ সে যে কাজ করে, তাতে পদে পদে বিপদ। তাই মা-বোনকে বিপদে ফেলতে চায় না।

এবার প্রবল বর্ষায় কলকাতার পথে-ঘাটে গঙ্গা বইছে। ন্যাপলাদের ঘরের টিনের চাল এক জায়গায় ছিদ্র হয়ে ঘরের একটা অংশে জল পড়ছে। অসিত, ন্যাপলা আর বিশুকে বলেছে বহরমপুর যাবে নরেশ ঘোষের একটা বড় অর্ডার নিয়ে। ওদিকে লাইনে জল জমায় ট্রেন বন্ধ। বাসও ছাড়েনি। দু’দিন ধরে অসিতের কোন খোঁজ না পেয়ে বিশু ও ন্যাপলা অস্থির হয়ে ওঠে। মোবাইলে ফোন করলে বলে সুইচড অফ। নরেশ ঘোষ এই অর্ডারের জন্য কিছু টাকা বেশি দেবে বলেছিল। অসিত বোনের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে এ কথা ন্যাপলা আর বিশুকে বলেছিল। আরো সাত দিন কেটে যায়। বৃষ্টি থামে। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়, কিন্তু অসিত ফেরে না। বিশু ঠিক করে মাস শেষে কিছু টাকা অসিতের মায়ের হাতে দিয়ে আসবে। ওদিকে নরেশ ঘোষও অসিতের কোন খবর দিতে পারে না। নরেশ ঘোষের লোক অসিতকে শেষ বার কলকাতাতেই দেখেছিল। বিশু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

ন্যাপলাদের ঘরে অসিতের চৌকির ওপর কয়েকটা জামা-প্যান্ট পড়ে আছে। একদিন হঠাৎ কী মনে করে বিশু অসিতের প্যান্টের পকেট খোঁজায় পকেট থেকে সাদা কাগজের চিরকুট পায়। তাতে অসিতের হাতে লেখা – “বিশু, ন্যাপলা, আমি গত মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারিনি। শুনেছি বোনটা অভাব সহ্য করতে না পেরে মোটা টাকার লোভে কোন এক বাবুর সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। আর মা-ও নাকি লজ্জায় দুঃখে পাড়ার পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করেছে। আমার আর বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। আমায় তোরা খুঁজিস না। ইতি— অসিত।”

কিছু ক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকে বিশু। তারপর আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে, “যখনই আমরা বাঁচতে চাই, একটু সুখের মুখ দেখতে চাই, কেন ওপরওলা সব কিছু তছনছ করে দেয়!” ন্যাপলা শুধু ক্ষীণ গলায় বলে, “সুখ তো এক ভাবে এক জনের কাছে থাকে না। হাত বদল হয়।” বিশু ভাবে ন্যাপলার কথাই হয়তো সত্যি!

 

সমাপ্ত


No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)