বাতায়ন/হলদে খাম/বর্ষা/১ম বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/১৯শে শ্রাবণ, ১৪৩০
হলদে খাম
বর্ষা
জয়িতা বসাক
বৃষ্টিকে লেখা খোলা চিঠি
ঠিকানা- মেঘপল্লী, আকাশগঙ্গা
প্রিয় বৃষ্টি,
কেমন আছ তুমি? এখন আর তোমাকে নিবিড় ভাবে কাছে পাই না। সেই পুবের জানালাটার পাশে কতদিন আমার আর বসা হয় না। সেই জানলা বেয়ে ইদানীং শুধু মনখারাপের বাতাস আসে। এখন ইচ্ছে করলেও তোমাকে দু-এক ফোঁটা বিন্দু ছুঁতেও পারি না। এখন জীবন শুধু ছুটছে আর ছুটছে, ঘড়ির কাঁটার চেয়েও দ্রুত। কোথাও থামবার অবকাশ নেই।
অথচ তোমার জলজ ঘ্রাণে পিছিয়ে যেতে ইচ্ছে করে মাত্র দু-এক দশক পথ। আমার আঁচলে গিঁট দিয়ে বেঁধে ফেলতে ইচ্ছে করে সেই ভিজে শ্রাবণকে। মনে পড়ে! সেই কোন সুদূর অতীতে তোমার অপেক্ষায় হাপিত্যেশ দাঁড়িয়ে থাকতাম বারান্দায়। দূরে ঝাঁকড়া সেই বটগাছকে তুমি যখন নাগাড়ে ভিজিয়ে দিতে, আমি অপলক চেয়ে থাকতাম। গাছটাও বোধহয় আমার দিকে ঠিক অমনভাবেই তাকিয়ে থাকত না কি লজ্জায় লাল হয়ে চোখ সরিয়ে নিত! বর্ষার কালো মেঘগুলো জড়ো করে প্রথমে জটার মতো গাছটার মাথায় বেঁধে রাখতে, তারপরেই খুলে দিতে সব বাঁধন। আর সেই ধারাস্নানে সবুজ ধোয়া মাটির সোঁদা গন্ধ উঠে আসত। তোমার ফিনফিনে সুগন্ধি-ধারা-সিক্ত বকুলের মতো ভিজিয়ে দিত আমার চিবুক, আমার করতল। আর রিমঝিম বাদলে সপসপে ভিজে যেত আমার কিশোরীবেলা, আমার চিলেকোঠার খেলনাঘর।
আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যেত শ্যামবাজার দিয়ে হেঁটে চলা মানুষের ভিড়। বাসগুলো চোখে লণ্ঠন জ্বেলে হাপরের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটত। ট্রামগুলো মাথা দুলিয়ে বাজিয়ে নিত গলায় বাঁধা ঘন্টি। ঠনঠন... ঠনঠন... বৃষ্টিমুখর দিনে পথচলতি কালো ছাতারা তখনও এত রঙিন হয়নি!
ঘন মেঘ দেখলেই একরাশ ফড়িং উড়ে আসত বাড়ির উঠোনে। উঠোনের এক চিলতে মাটিতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই আমগাছটাও তখন নেহাত শিশু। একটু জোরে হাওয়া দিলে ভয় হত! এই না হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তিনতলার ছাদে লাগান আ্যলুমিনিয়ামের এন্টেনাটা সেই দামাল হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বোঁ বোঁ করে ঘুরে যেত। সেই ঢাউস সাদাকালো টিভি খোলার আগে কখনো আমি, কখনো দিদি তোমাকে মাথায় নিয়ে ছুটতাম ছাদে, ওকে বাগে আনার জন্য। আমাদের পাত্তা না দিয়ে কার্নিশ বেয়ে উদোম ধারায় গড়িয়ে নামছ তুমি।
তখন বাড়িতে বাড়িতে ফ্রিজের আধিপত্য ছিল না। তাই কালবৈশাখী ঝড়ে মাঝে মাঝে তুমি হরির লুটের মতো করে শিলা ছড়িয়ে দিতে, তখনই সেই শিলা কুড়োনোর ধুম লেগে যেত। আমরা মাথা ঢেকে উঠোন থেকে শিলা কুড়োতাম আর বৃষ্টির জলে ধুয়েই সোজা মুখে চালান করতাম। সে কী তৃপ্তি! সে কী আনন্দ!
তোমার বর্ষণ একটু বেশি হলেই নর্দমা টপকে জল উঠে আসত বাড়ির পাশের রাস্তায়। তারপর চোখের নিমেষে প্রথমে বাড়ির দালান আর একতলার রান্নাঘর ভাসিয়ে দিত। নিচু দালানে এক পাশে রাখা গ্যাসের খালি সিলিন্ডারগুলো সেই সময় চটপট বেঁধে না নিলে, ওদের পিঠে কেমন পাখনা গজিয়ে উঠত আর ওরা তিমি মাছের মতো ভেসে বেড়াত সেই নোংরা জলে। জমা জলে ভেসে আসত কেঁচো, জোঁক, গেঁড়ি। এবার জল জমতে পারে, আন্দাজ করে- স্টোভ, কুকার, চাল-ডাল সমেত এক টুকরো সংসার উঠে আসত সিঁড়ির ছোট্ট চাতালে। আমরা দুই বোনও বড়দের হাতে হাতে তোলাপাড়া করেছি কত! খুব মজাও হত। সেদিনের মতো পড়াশুনা বাতিল। সিঁড়িময় সেই রান্নাঘরে সেদিন মা এক পাকে খিচুড়ি রাঁধতেন আর সঙ্গে গরম ঘি আর পাঁপড় ভাজা। সেটাই ছিল সেদিনের দুপুরে রাজকীয় ভোজ।
বাড়ির বড়রা যত তোমাকে ঠেকানোর চিন্তা করত, আমি তত বেশি তোমার ন্যাওটা হয়ে পড়তাম। কারণ তুমি একবার নাগালের বাইরে চলে গেলে, পরের দিনের স্কুলটা দিব্বি ছুটির দখলে চলে যেত।
তবে ফুটপাথের ওই বাচ্চাগুলোর জন্যও আমার ভীষণ কষ্ট হত! ওদের জন্য তোমাকে কখনো বিচলিত হতে দেখিনি। তুমি নির্বিকার দাপিয়ে হেঁটে বেরিয়েছ পুরোটা বর্ষাকাল জুড়ে।
এখন অফিসঘরের বন্ধ কাঁচের জানলা পেরিয়ে এক টুকরো মেঘও উড়ে আসে না আমার কম্পিউটারের পর্দায়। শীতাতপ যন্ত্রের শীতল হাওয়া পেরিয়ে আসে না তোমার সেই মনকাড়া সোঁদা গন্ধ। তুমি এখন শুধু অতীত। কতদিন পর তোমায় আজ তাই একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে হল। আমি জানি, তোমার কোনো মেইল আইডি নেই। তাই তো সাদা পাতায় সেই হারিয়ে যাওয়া চিঠিই লিখলাম।
জানো! তুমি শুনলে কষ্ট পাবে যে এখনকার বাচ্চাগুলো বৃষ্টিতে ভেজার জন্য আর বায়না করে না। জমা জলে ভাসানোর জন্য কাগুজে নৌকাও বানাতে পারে না। ওদের কচি আঙুলে খেলা করে প্রযুক্তি। যে প্রযুক্তির শরীরে কোনো সবুজ গন্ধ লেখা থাকে না।
আমি টের পাই তোমার গায়ে এখন শুধু বিষণ্ণতার গন্ধ। তোমারও কি এখনো মনখারাপ করে আমার কিশোরীবেলার জন্য? উত্তর দিও। বন্ধ জানলার এপারে মেঘদূতের পথ চেয়ে আজও আমি অপেক্ষায় থাকলাম।
খুব সুন্দর ! খুব সুন্দর ! হেঁটে " বেরিয়েছ " না বেড়িয়েছ ---- একবার ভেবে দেখবেন ৷
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাকে
Deleteবড় চেনা বাস্তবের যথার্থ বহিঃপ্রকাশ,,,,, শহরতলির ভালো খারাপ বৃষ্টিতে আরো একবার ঘুরে এলাম 👌👌👌
ReplyDeleteঅশেষ ধন্যবাদ
Deleteচমৎকার
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteনস্টালজিক, যাকে বলে স্মৃতিমেদুর।
ReplyDeleteশহর কলকাতায় বেড়ে ওঠা প্রবীনদের কাছে একটা আবেগঘন জলছবি।
সুন্দর ও সাবলীল গদ্য। উপভোগ্য
নিরন্তর ধন্যবাদ জানাই
Delete