প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

ওয়েটিং লিস্টে আছি... | রতনলাল আচার্য্য

বাতায়ন/মাসিক/কবিতা/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | কবিতা রতনলাল আচার্য্য ওয়েটিং লিস্টে আছি ....

Thursday, October 26, 2023

সাগরে মেয়েরা | পিয়ালী সেন

বাতায়ন/অন্য চোখে/১ম বর্ষ/২৩তম সংখ্যা/১০ই কার্তিক, ১৪৩০

অন্য চোখে
পিয়ালী সেন

সাগরে মেয়েরা


এই যে আমি শ্লেট-খড়ি, পেন্সিল, কলম সব পেরিয়ে এসে গড়গড়িয়ে টাইপ করে চলেছি আজ, তা কোনোদিনই সম্ভব হত না যে মানুষটি বাংলায় জন্মগ্রহণ না করলে - সম্প্রতি সেই মানুষটির জন্মদিন গেল, হয়তো বা তাঁর সাথে হাজার হাজার নারীরও পুনর্জন্মের দিন।

আজ বলতে বাধা নেই, ছোটবেলায় ওনার উপর অত্যন্ত বিরক্ত ছিলাম। ছোট ছোট শিশুদের উপর দাঁতভাঙা সব বানান চাপিয়ে দিয়ে উনি তাদের একরকম ভয়ংকর বিপদের মধ্যেই ফেলে দিয়েছেন বলে মনে হত, তার উপর আমি আবার ছোট থেকেই 'বানানে মা ষষ্ঠী'— কিন্তু এখন বুঝি, এই এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আজও এমন এক 'অন্তরে আধুনিক মানুষের' কী ভীষণ প্রয়োজন আমাদের!

ঈশ্বরচন্দ্রের সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা আগেই বললাম। এর পরবর্তী পরিচয়পর্ব কিন্তু মোটেই খারাপ ছিল না। সম্ভবত প্রাথমিকের কোনো একটি ক্লাসে তাঁকে নিয়ে একটি লেখা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ছিল। তাঁর জন্ম, শৈশবকাল, কলকাতায় আগমন এবং সেই সঙ্গে বহুশ্রুত মাইলফলক দেখে তাঁর ইংরেজি সংখ্যামালা শেখা, পরবর্তী পর্যায়ে কলকাতায় তাঁর শিক্ষা, শিক্ষকতা, নানান সংস্কার ও সর্বোপরি তাঁর জীবনযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে পড়ানো হত। সেই লেখা থেকেই প্রথম তাঁর শারীরিক গঠনের পরিচয় পাই। রান্নাবান্না সেরে শীর্ণ শরীরে প্রকাণ্ড ছাতা মাথায় তাঁর কলেজ যাত্রা, 'যশুরে কই বা অপভ্রংশে ‘কসুরে জই’ নামে তাঁকে খ্যাপানো, এগুলো পড়তে বেশ ভালই লাগত, এমনকি আমি নিজে 'চিরকেলে ফাঁকিবাজ' হিসেবে পরিচিত হলেও, ঈশ্বরচন্দ্রের কঠিন অধ্যাবসায়ের  পর্বটিও (ঘুম পেলে চোখে সর্ষের তেল দেওয়া, টিকিটি বেঁধে রেখে পড়তে বসা) যথেষ্ট উপভোগ করতাম। কিন্তু তখনও সত্যি সত্যি ঈশ্বরকে চিনে ওঠা হয়নি আমার। তখনও জানতে পারিনি এই মানুষটির জন্যই আমি পড়তে পারছি এবং সেই পড়াকে উপভোগও করতে পারছি।

কোন একটি মতাদর্শে বিশ্বাস ও সেটি অন্যদের কাছে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে কঠিন এক যাত্রাপথ থাকে, আর সে যাত্রার প্রথম ধাপই বোধহয় নিজেকে প্রমাণ করা। এই বিষয়ে যে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্র ৯ বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে শুরুর থেকে ১৮৩৯ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ এর উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করে। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কর্মজীবনও ছিল শুরু থেকেই সংস্কারমুখী। তা সে সংস্কৃত কলেজে অব্রাহ্মণ ছাত্রদের পঠনই হোক বা আইন করে বিধবাবিবাহ প্রথা শুরু করাই হোক। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় সে যুগে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সম্পর্কে তাঁর জীবনবোধ। স্ত্রী জাতির প্রতি বিশেষ স্নেহ ও ভক্তির প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর তাঁর স্বরচিত জীবনবৃত্তান্তে লিখেছেন: ‘নারীদের কৃত সেবা কেবল আমরা আমাদের সাংসারিক স্বার্থসুখের সহিত জড়িত করিয়া দেখি, তাহা আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কৃতজ্ঞতা উদ্রেক করিবার অবকাশ পায় না।’ কিন্তু তিনি তাঁর সমগ্র জীবন জুড়ে বারেবারেই এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেছেন। শিক্ষাই যে সমগ্র জাতির উন্নতির মূল পথ তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন এবং নানান কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিতও করেছিলেন। বিশেষ করে নারীশিক্ষায় তাঁর অবদান বারবার উল্লেখ করার মতো। ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে 'হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়' (অধুনা বেথুন স্কুল) তৈরি, নারীশিক্ষা ভাণ্ডার তহবিল গঠন। হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদিয়ায় প্রায় ৩৫টি মেয়েদের স্কুল তৈরি ও তাদের শিক্ষা প্রসারে আরও নানাভাবে ব্রতী ছিলেন তিনি। নারী ও স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন এই স্বল্প পরিসরে করা প্রায় অসম্ভব।

শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজ পাঠ্য করে তোলেন। বাংলা গদ্যের সার্থক রূপকার তিনিই। তাঁকে বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী বলে অভিহিত করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মানুষ হিসেবে যে দর্শনে তিনি বিশ্বাস করেছেন তাকে নিজের জীবনেও যতদূর সম্ভব প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তাই আইন করে বিধবাবিবাহ শুরুর সাথে সাথে তিনি নিজ পুত্র নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও হুগলি খানাকুল নিবাসী শম্ভু চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর বিবাহকেও সমর্থন করেছেন, এখানেই তাঁর চরিত্র শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে।

অথচ এমন এক কর্মযোগী যুগপুরুষের জীবনের শেষ কিছু বছর কেটেছে একেবারেই নিভৃতে, অধুনা ঝাড়খন্ডের কর্মাটাঁরে। আদিবাসী গ্রামে, তাদের সান্নিধ্যেই, তবু সেখানেও তিনি তাঁর ছাপ রেখে গেছেন পরম মায়ায়। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দাতব্য চিকিৎসালয়ের মাধ্যমে তিনি সেখানেও নিজের বাসভবনকে যথার্থই নন্দনকানন বানিয়ে তুলেছিলেন। তাঁকে স্মরণ করাও তাই কোনো একদিনে সীমাবদ্ধ থাকা কাম্য নয়। প্রতিটি মানুষেরই তাঁর জীবনবোধ ও কর্মকাণ্ড বিষয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা করা এবং সর্বোপরি তাঁর সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে চলা উচিত।


সমাপ্ত

1 comment:

  1. Amio soto koti pronam janai onake🙏🙏

    ReplyDelete

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)