বাতায়ন/ছোটগল্প/১ম বর্ষ/২৩তম
সংখ্যা/১০ই কার্তিক, ১৪৩০
ছোটগল্প
প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্ণ পরিচয়
ভাল নাম দুলাল। কিন্তু
পরিচিত সবাই ডাকে কাউয়া বলে। কেন এমন একটা কুশ্রী নাম ওর হল, কে রাখল এমন নাম, কেউ
বলতে পারে না। হয়তো ওর কুচকুচে কালো গায়ের রঙের জন্য কেউ এমন একটি নাম রেখে থাকবে।
সে যাই হোক, দুলালের এক
মহা গুণ, এ নামে ডাকলেও কখনো রাগ করে না, সাড়া দেয়। একদম রাগ করে না, বললে বেশি
বলা হবে। আসলে ওর সাথে যাদের ভাব-ভালবাসা আছে তাদের ব্যাপারে দুলাল উদার। অচেনা
কেউ এমন নামে ডাকলে দুলালের বিশ্রী প্রতিক্রিয়া হয়।
দুলাল রেলের লোকোতে কাজ
করে। যদিও সরকারি কাজ না। ঠিকাদারের অধীনে কয়লা তোলা-নামানোর কাজ। যেহেতু কয়লার
ইঞ্জিনের মেরামতের কাজ হয় তাই সারা বছরই কাজ থাকে। কোনো ভাবে ওর সংসার চলে যায়।
ভীষণ পরিশ্রমের কাজ।
বেলচা দিয়ে কয়লা তোলা-নামানো৷ ঠিকাদারের কাজ, ফলে ফাঁকির কোনও সুযোগ নেই। সন্ধের
মুখে যখন বাড়ি ফেরে তখন ওইরকম কষ্টি পাথরের মতো চেহারায়ও ক্লান্তির ছাপ লেগে থাকে।
সব চাইতে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে দুলাল কখনও হাসতে ভোলে না। মুখে হাসি লেগেই আছে।
তার সাথে নানা মজার মজার গল্প যা নানা লোকজনের আচার-আচরণ থেকে সংগ্রহ করা, নানা
ভঙ্গিতে তা খুব ভাল পরিবেশন করতে পারে। চটুল হলেও দুলাল অশ্লীল গল্প করে না। ও খুব
ভালই জানে ও যাদের সাথে গল্প করছে তারা সবাই শিক্ষিত। কেউ কলেজে পড়ছে, কেউ কলেজের
পড়া শেষ করে চাকরির চেষ্টা করছে। কেউ বা চাকরি করছে। সন্ধ্যায় মাঠে বসা এই দলটাও
মাঝেমধ্যে ওকে ডেকে নেয় মজা পাবার জন্য। দুলালের শিক্ষাদীক্ষা কম থাকলেও ওর সৌজন্য
বোধে ঘাটতি নেই। সবাইকে যথেষ্ট সমীহ করেই হাসি-মশকরা করে।
পড়াশোনা করা লোকজনকে ও
খুব পছন্দ করে। পড়াশোনার কথা উঠলেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়। দুলাল একদিন শুনিয়েছিল ওর
ছোটবেলার দুর্যোগের গল্প। কীভাবে একমাত্র রোজগেরে বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে ওকে আয়ের
জন্য পথে নামতে হয়েছিল। চায়ের দোকান, মুদি দোকান, কয়লার গোলা, সাত ঘাটের জল খেতে
খেতে লোকো শেড। মজুরি একটু কম কিন্তু কাজটা সারা বছর চলে এটাই বড় ভরসা।
সেই দুলালকে একদিন দেখি
লম্বা একটা দেয়াল লেখার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কী বলছে। আমি কৌতূহলে দাঁড়িয়ে
পড়লাম। কিছুক্ষণ ওকে লক্ষ্য করলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম,
-এই, বিড়বিড় করে কী
বলছিস?
ও একটু থতমত খেয়ে গেল।
মুখে দেখি বেশ একটা কষ্টের ছাপ। বললাম,
-কী হয়েছে?
ও মিনমিন করে বলল,
-পারছি না, একদম পারছি
না দাদা।
-কী পারছিস না?
আমি জানতে চাইলাম।
-জানো, লেখাগুলো আগে দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে পড়তাম। অসুবিধে হলেও পারতাম। নানা কাজে বহু দিন পড়া হয়নি। এখন যেন মনে
করতে পারি না কোনটা কোন অক্ষর।
বুঝতে পারলাম দুলাল
দেয়ালের সাথে ওর কষ্টের কথা বলছিল। দীর্ঘ অনভ্যস্ততায় ও হারিয়ে ফেলেছে অক্ষরজ্ঞান।
ওর স্মৃতিশক্তি ওর সাথে সঙ্গ দিচ্ছে না। অবাক হয়ে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম ওর
পাশে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। চুপিচুপি চলে এলাম ওর পাশ থেকে। তখনও দুলাল একমনে
বিড়বিড় করে চলেছে।
সমাপ্ত
সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি নিয়ে লেখা। ভালো লাগল।
ReplyDelete