মায়ের আঁচলের গন্ধ
[১ম পর্ব]
এভাবে মা যখন ছোট ভাইকে বুকের দুধ খাওয়ায়, বা কাজে ব্যস্ত থাকে তখন সে মায়ের আঁচল ধরে থাকে। আঁচল চিবোয়। এতেই যেন সে মায়ের ঘ্রাণ পায়। সর্বদা মায়ের পায়ে-পায়ে ঘুরঘুর করে। মা’ও সবসময় বিরক্ত হয় না। মা বুঝে গেছে দুটোকে এভাবেই মানুষ করতে হবে। যদি যমজ সন্তান হত, তবে কী হত? এসব ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেয়। ঘুম পেলে ছেলেটা বিছানায় গিয়ে মায়ের শাড়িটা বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
বাসির নাসিরকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে সে স্কুলে যায়। মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। মায়ের মুখে খুশির ঝলক। একটা স্বপ্ন, ভোরের শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করে। স্কুল থেকে ফিরে নাসির খেয়েদেয়ে মায়ের একটা শাড়ি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু সবসময় শাড়ি পায় না। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তাদের পিন্ধনের ক’টা কাপড় থাকে! নাসির পুরানো কাপড়ের পুঁটলি খুঁজে মায়ের শাড়ির আঁচলের একটা টুকরো পায়। এ যেন সাত রাজার ধনের চেয়েও দামি তার কাছে। মা'র খুব ইচ্ছে আঁচল লাগোয়া ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবে। এইসব নিয়ে মাঝেমধ্যে বাসিরের সঙ্গে খটামটি লেগে যায়। বাসির কখনো-সখনো বলত, "নাসির গোরুগালাকে অ্যাকটু সানি পানি দে তো বাপ।" আবার কোনোদিন জমিতে চাষ করতে যাওয়ার সময় বলে যেত, "নাসিরের মা, নাসিরকে লাহারিখ্যান দিয়্যা পাঠ্যাইও। জমির চাষ শ্যাষ কইরা অ্যাসবো।" নুরেসা মুখঝামটা দিয়ে বলত, "নাসিরকে হামি কিরষ্যান কৈরবো না জী। কয় মাস পর ফাইভে ভরতি করতে হৈবে। ভালো ইস্কুলে ভরতি কৈরতে হৈবে নাকি? ওকে অ্যাকটু মোন দিয়্যা পইড়তে দ্যাও।" বাসিরের কথা হল, “হ্যাইলার ব্যাটা বেশি পড়্যা কী কৈরবে? নামটা সহি কৈরতে পাইরলেই হৈলো।” এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুটমুট লেগে থাকত। নাসির কিন্তু খুব মন দিয়েই পড়াশোনা করে।
নুরেসা ছোটটিকেও স্কুলে ভর্তি করে দেয়। দু’ভাই একসঙ্গে স্কুলে যায়। ছোটটা পড়াশোনায় ভীষণ অমনোযোগী। খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকে। নাসির স্কুল থেকে ফিরে একটু কিছু মুখে দেয়। বাড়িতে যা থাকে। আর ঘুমানোর সময় মায়ের শাড়ির সেই আঁচলের টুকরো নিয়ে খেলায় মগ্ন থাকে। বিড়ালের বাচ্চা যেমন একটা কিছু পেলে খেলতে থাকে, নাসির তেমনি মায়ের ছেঁড়া শাড়ির আঁচল নিয়ে লোফালুফি করে; খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ে। এমনি ভাব যে, শাড়ি নয়, যেন সে মায়ের বুকেই রয়েছে।
জানুয়ারি মাস শুরু হয়েছে। স্কুলে ভর্তি চলছে। বাসিরের কোনো হেলদোল নেই। ভাবছে ‘হালঠেলার ব্যাটা আর কত পড়বে!’ কিন্তু না, নাসিরকে সেদিন ওর হেডস্যার কাদির সাহেব ডেকে বললেন, "কী রে নাসির স্কুলে ভর্তি হবি না? আমি তো হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম স্যারকে বলে রেখেছি, "বাসিরের ছেলেটা পড়াশোনায় ভাল। ভর্তি করে নেবেন স্যার। গরিব মানুষের ছেলে। আজ পাঁচ তারিখ। আর এখনও ভর্তি হওনি। যাও, তোর আব্বাকে বলে কালকেই ভর্তি হয়ে যাবে।"
অনেক দড়ি টানাটানির পর নাসিরকে তার বাবা ভর্তি করতে রাজি হল। ভর্তিও হয়ে গেল। মাস্টারমশাইদের কারো কারো ধারণা, দরিদ্র মুসলিম ঘরের ছেলে কী আর পড়বে! খাটবার লায়েক হলে কোথাও বাইরে চলে যাবে কাজ করতে। মুসলিম সমাজে এখনো পড়াশোনার আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু না, নাসির পড়াশোনায় খুব মনোযোগী। স্টাফরুমে যে ক'জন ছাত্রকে নিয়ে আলোচনা শুরু হল, তার মধ্যে অন্যতম হল নাসির। স্যারেরা বলছেন, "ফাস্ট জেনারেশন লার্নার। বাড়িতে কেউ তো নেই দেখানোর কিন্তু পড়াশোনায় ভীষণ আগ্রহী।" আর টিউশন পড়বার আর্থিক সংগতি নেই। বিদ্যালয়ের মাস্টারমশাইরা সবসময় তাকে সাহায্য করেন।
তার প্রধান অবলম্বন মায়ের এক টুকরো শাড়ি। সেই শাড়ির গন্ধে বাসির যে কী অনুপ্রেরণা পায়, তা সে নিজেও জানে না। মায়ের শাড়ি মানে মা আছেন তার সঙ্গে। মায়ের স্নেহ-ভালবাসায় ঘরখানা যেন পরিপূর্ণ হয়ে আছে। কোথাও কোনো শূন্যতা নেই। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবেই। নুরেসা ভাবে ছোট ছেলে নাজিরের পড়াশোনায় মন নেই। বাবার কাজে ভাল সহযোগিতা করে। গোরু দুটোর প্রতি নজর রাখে। মায়ের কথা শোনে না। মা ভেবে কুল পায় না। তবুও যতদূর পারে, পড়াশোনাটা করুক।
নাসির এবার নাইনে উঠবে। বার্ষিক ফলাফলের দিন দেখা গেল নাসির সবাইকে টপকে প্রথম হয়েছে। ক্রমাগত নাসির এগিয়েই চলেছে। এবার সে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। নাইনে উঠেই সে আরও সচেতন ভাবে মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করল। নবম শ্রেণি। রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হবে। নুরেসা বাসিরকে বলে নাসিরের স্কুলে টাকা লাগবে। বাসিরের মাথায় আগুন ওঠে। বলে, "হামি কি টাকার গাছ। ঝাকালেই পৈড়বে।" নুরেসা শান্ত ভাবে বলে, "দ্যাখো না হারু (হরেন) মাস্টারের কাছে। সামনের মাসে মুরগা দুটা বেইচ্চা দিয়্যা দিতুন।" পীড়াপীড়িতে বাসির হারুন মাস্টারের কাছ থেকে টাকা হাওলাত করে আনে। ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষায় নাসির অবিশ্বাস্য ফল করল। মা খুব খুশি। আবার ফর্ম ফিলাপের জন্য টাকা লাগবে। মা, রাতে ঘুমোতে পারে না। শুধু এপাশ-ওপাশ করে। বাসিরকে বলতে সাহস পায় না। বলা যায় না, কী অশান্তি সৃষ্টি করে। কিন্তু না, চিন্তার নিরসন ঘটল খুব সহজেই। হেডস্যার ইব্রাহিম সাহেব ফর্ম পূরণের টাকা দিয়ে দিয়েছেন। স্যার ডেকে বললেন, "টাকাপয়সা নিয়ে ভাববে না, মন দিয়ে পড়াশোনাটা করে যাও। আর, অসুবিধা হলে স্যারদের হেল্প নিবে।" দারুণ রেজাল্ট করে মাধ্যমিক পাশ করল। ওই স্কুলে এর আগে কেউ এত ভাল রেজাল্ট করেনি।
গ্রামের সবাই খুশি। নাসিরের ভাল রেজাল্ট নিয়ে নেতারা রাজনীতি করলেন। নাসিরকে সম্বর্ধনা দিল। ছবি তুলল। তখন নাসিরের এবং নাসিরের বাবার মন খুশিতে ভরে গেল। নাসির ভাবল যেভাবেই হোক, এবার মিশন স্কুলে পড়াশোনা করবে। কিন্তু না, স্কুলের মাস্টারমশাইরা তাকে বাইরে যেতে দিলেন না। নিজের স্কুলেই থেকে গেল।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment