বাতায়ন/ধারাবাহিক/১ম বর্ষ/২৪তম
সংখ্যা/২৪শে কার্তিক, ১৪৩০
ধারাবাহিক গল্প
বিরথ চন্দ্র মণ্ডল
মেন্টাল ডিজ-অর্ডার
[২য় পর্ব]
পূর্বানুবৃত্তি শতদ্রু
অর্চিশার কথায় অর্চিশার সঙ্গে মনোবিদের কাছে যায়। ডাক্তারকে সংসারের, দাম্পত্যের
গোপন কথা বলতে থাকে। এত মানসিক সমস্যার মধ্যেও দ্বিতীয় ইস্যু নিয়েছে শুনে ডাক্তার
শুনে আশ্চর্য হন। বোঝার চেষ্টা করেন আসল গণ্ডগোলটা কোথায়। তারপর…
-স্যার খুলেই বলছি। ও
কখন, কোথায়, কী করছে? আমার সাসপেক্ট ভুল হচ্ছে কিনা! এইসব ভেবে ওর পেছনে স্পাই
লাগলাম। স্পাই ওর সমস্ত তথ্য ছবিসহ আনিয়ে দিল। তখন বুঝে ফেললাম; এতদিনের সব ভাবনা
আমার ভুল। সব আমার প্রলাপ মাত্র। আমাদের এতদিনের সম্পর্ক যখন তলানিতে! ওর উপর
মানসিক চাপ বাড়ালাম। সেই চাপ ভুলতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে নতুন নতুন সম্পর্ক, তার
থেকে চ্যাটিং। এইভাবে ধীরে ধীরে আমার থেকে একদম হারিয়ে গেল। আমি দাঁতে দাঁত
কামড়ে পড়ে থাকলাম সংসারে। শুধু সংসারের কথা ভেবে। একদিন ওর এক কলিগ এল ওরই সাথে।
নাম শ্রীজা। বন্ধুর বাড়ি বন্ধু আসতেই পারে। এ নিয়ে কিছুই ভাবলাম না। সেদিন ছিল
ছুটির দিন। রান্নাবান্না সংক্রান্ত নানা কাজে আমাকে এনগেজ করে রাখছে ও। যা ওর স্বভাববিরুদ্ধ।
ভাবলাম; হয়তো কলিগ এসেছে। দ্রুত কাজগুলো সারতে হবে, তাই। আমি ওর ফাইফরমাশ মতো কাজ
করে যাচ্ছি। সেই মুহূর্তে অফিসের বড়বাবু ফোন করে জানালেন, ‘সোমবারের মিটিং-এর
লাঞ্চ এবং টিফিন সকাল দশটায়। অফিসে পৌঁছে যাবে।’ খানিকক্ষণ পর অর্চিশা স্নান ঘরে
ঢুকল। এই সময় শ্রীজা আমাকে ডেকে নেয়, কথা বলার উদ্দেশ্য। বলল,
-আপনি নাকি সংসারে আঙুলটি
পর্যন্ত নাড়েন না! ওই তো দেখছি, আপনি বেশ সংসারের কত কাজ জানেন।
তাছাড়া, এত বড় মাপের অফিসার আপনি! কই অর্চিশা তো কোনদিন কোন কিছু বলেনি আপনার
কথা! বরং এও বলতে শুনি, ‘চাকরি তো দূর! কোন কিছুই পারে না। সারাক্ষণ কী সব বকরবকর করতে
থাকে পাগলের মতো!’
অফিসের অন্যান্য মেইল স্টাফদের সাথে সবসময় গসিপ করে। আজেবাজে কমেন্ট করে আপনাকে
নিয়ে। প্রসঙ্গ এলে বরং ওকে আমরা বলি, ‘সত্যি যদি ভুল মানুষকে নিয়ে সংসার করিস;
তো ছেড়ে দে! ডিভোর্স নিয়ে নে!
এর উত্তরে বলে, ছেলেদের বাপকে দরকার? অথচ; এদিকে ছেড়েও দিবি না। আবার গসিপ করতেও
ছাড়বি না। এ আবার কী করে হয়? তাইতো চাক্ষুষ দেখতে এলাম।
কথা বলতে বলতে শ্রীজা ভয়ে ভয়ে স্নানঘরের দিকে তাকায়, আর বলে,
-কেন এলাম জানেন? ওর
নাটকের আসল-নকল জানব বলে। আর হ্যাঁ, অর্চিশা যেন এসব কিচ্ছুটি না জানতে পারে।
-সেদিন শ্রীজা রাতে থেকে গেল। ওকে তোয়াক্কা না করে সেদিন গান-গল্প-আড্ডা বেশ
জমাটি হয়েছিল। দীর্ঘদিনের পর মন খুলে সেদিন হেসেছি। গল্প করেছি। শ্রীজার মুখে এসব
কথা শুনে, আমি যেন স্তম্ভিত। ভেতরে ভেতরে কত কিছু করে বেড়াচ্ছে ও। রুখে
দাঁড়ালে ওর চাকরি চলে যাবে। অনেক দিন আগেই বুঝেছিলাম, ও এক সাইলেন্ট কিলার। ওর এই
মোটিভ আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করতাম না। আসলে ও বুঝে গেছে, শত
অন্যায় করলেও আমি কিছুই করতে পারব না ওর বিরুদ্ধে। ও বুঝে নিয়েছিল,
ওর প্রতি, সন্তানদের প্রতি আমার দুর্বলতা, ভালবাসা, আন্তরিক টান কতখানি! আর
সেই সাহসে যা-না-তা করে বেড়াচ্ছে। আর আমাকে ব্যবহার করে চলেছে সেদিন থেকে। সবার
কাছে সমস্ত জায়গায় ব্রাত্য করে রেখেছে আমাকে।
শতদ্রু এক নাগাড়ে বলতে থাকে,
-স্যার; সন্তানকে বড়
করতে গেলে বাবা-মা দু’জনেরই সমান স্নেহ, আদর্শ লাগে। অথচ এই দায়িত্বটুকু ভুলে
গিয়ে যত দিন এগোতে থাকে, সেই ভুল সম্পর্কগুলোকে নেশার মতো আরো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে
থাকে। এদিকে আমি পড়ে থাকলাম অফিস, নিজের সংস্থান আর টুকটাক গানবাজনা নিয়ে। তবুও
এই মানুষটা স্থির থাকল কই?
বাইরের লোকের কাছে নিজেকে ভাল সার্টিফিকেটে মোড়াবার জন্য, আমাকে মানসিক রোগী
সাজাবার জন্য, দীর্ঘ নাটক করে চলেছে এখনো। এত কিছু জেনেও ওর মুখে হাসি দেখার জন্য,
ওর ডাকে ডাক্তার দেখাতে এদিক-ওদিক ছুটে যাই। কত ফ্যামিলি আত্মসুখের জন্য নিজেরা
সেপারেট হয়ে যায়। ওর মতো আমিও নিজের মতো সুখ খুঁজে নিতে পারতাম। কিন্তু স্যার;
প্রত্যেক মানুষ যখন নতুন কিছু লাভ করে, সে সৎ উপায়ে হোক কিংবা অসৎ উপায়ে…
অঙ্গাঙ্গিভাবে আরও একটা জিনিস হারিয়ে যায় তার। যে জিনিস সে হারিয়ে ফেলে,
চিরতরের জন্য আর ফিরে আসে না।
এক মনে বলে চলে শতদ্রু,
-স্যার বেঁচে থাকার
অবলম্বন তো আমি মনে করি সন্তান। আজকাল অসংখ্য ফ্যামিলি গুরুত্ব দেয় না এই
সন্তানদের। গুরুত্ব দেয় না সন্তানের মনকে। ওদের মনের ধারাবাহিকতাকে। একটি
নির্দিষ্ট বয়সে ওরা ঠিক বুঝতে পারে। বাবা-মা’র মনের গতিপ্রকৃতি। তারা সেই ধারণার
ভিত্তিতেই ওদের শ্রদ্ধা ভক্তি বদলে ফেলে পরস্পর এ পিঠ আর ও পিঠে। বাবা-মা যেমন
সন্তানের মন বুঝতে পারে। সন্তানও তেমনই সব বুঝতে পারে। আপনি তো স্যার মনোবিদ। আমার
চাইতে আপনি আরও ভাল বুঝবেন।
ডঃ তমোনাশ চ্যাটার্জি শুনছেন আর অবাক হচ্ছেন। পৃথিবীতে কত নারী-পুরুষ এমন অসহনীয়
জ্বালা নিয়ে বেঁচে আছেন? ভাবছেন, জীবন নিয়ে ইনার সম্যক উপলব্ধি আর ইনার ধৈর্য।
শতদ্রু বলতে থাকে,
-স্যার; জীবনে অনেক
স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ভুলে গেছি। লোভ ছিল। লোভ ত্যাগ করেছি। মানুষ কেন বিয়ে করে? এর
উদ্দেশ্য কী? সে নিয়েও আর ভাবি না! কেন বাঁচে মানুষ?
বলব,
-হয়তো শুধু কর্তব্য।
কর্তব্যের পেছনে থেকে সন্তানকে সঠিক পথ দেখানো। তবে ডাক্তারবাবু! সম্পর্কের এই
টালবাহানায় সন্তানও ঠিক বুঝে নেয়, বাবা-মায়ের মধ্যে পরস্পরের এই হাল বেহাল
অবস্থা। যে লক্ষ্যে বড় করে তোলা, সেই লক্ষ্য পূরণ হবে বলেও ভরসা পাই না। তাই ভাবি,
ওদের মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছে না তো!
বলেই এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শতদ্রু। কথাগুলো বলতে বলতে গভীর চিন্তায় আনমনা হয়ে
যায়। মাথা একটু নিচু হয়ে আসে। এক গভীর দুঃখে ভারাক্রান্ত শতদ্রু…
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment