প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Saturday, December 9, 2023

পরকীয়া | ঝাল লজেন্স | দেবদাস কুণ্ডু

বাতায়ন/পরকীয়া/গল্প/১ম বর্ষ/২৬তম সংখ্যা/২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

পরকীয়া | বড়গল্প
দেবদাস কুণ্ডু

ঝাল লজেন্স


‘আমি রিনি বলছি।’
‘কে রিনি?’
‘আপনি শ্যামল মজুমদার না?’
‘না।’
‘সরি রং নাম্বার।’
এই সময় সাধারণত ফোন আসে না। এখন রাত ন’টা। এই সময় ব্যালকনির উওর দিকে হেলানো চেয়ারে আধশোয়া হয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শুনি আমি। আজও শুনছি। হাতে কফির মগ। আমার স্ত্রীর ফেরার সময় হয়ে এল।

ও প্রায় দিন সন্ধ্যাবেলা কাছের এক মঠে যায় ভাগবত পাঠ শুনতে। আজও গেছে। স্ত্রী সারাদিন অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওর এখনও চার বছর চাকরি আছে। আমি সারাদিন একাই থাকি। আমার একটা কোচিং ছিল। গত বছর লাস্ট বিএ ব্যাচ পড়িয়ে শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর নিয়েছি। আমার বয়স ষাট পার করেছে। সারাদিন একাই থাকি ঘরে। একাকীত্ব আমার ভাল লাগে। কবিতা লিখি ছোট-বড় গল্প লিখি। ছবি আঁকি। গান শুনি। কাগজ পড়ি। খবর শুনি। বেশি ভাল লাগে রবিঠাকুরের গান। প্রতিটি গান আমাকে অনুভূতির নানা বাঁকে পৌঁছে দেয়। সেই বাঁকে কখনো বিযাদ, কখনো আনন্দ, কখনো ঈশ্বর অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
যখন শিক্ষকতা করতাম তখন কত ফোন আসত। বন্ধুদের ফোন, আত্মীয়দের ফোন, ছাত্রছাত্রীদের ফোন। এবার মনে পড়েছে রিনি নামে একটি কালো মেয়ে আমার কোচিংয়ে পড়তে আসত। কালো হলে কী হবে ছিল সুন্দর মুখমণ্ডল। আধশোয়া থেকে উঠে বসলাম। সোজা হল মেরুদণ্ড। শেষ চুমুক দিয়ে কফির মগটা পাশে রাখলাম। তার আগে বন্ধ করলাম গান। শান্ত মনে ভেসে উঠল থার্ড ইয়ারে পড়া রিনির মুখ। ওর বাংলায় অনার্স ছিল। সেই রিনি ফোন করে শ্যামল মজুমদারকে চাইছিল কেন? আমি তো অরণ্য রায়। এই রিনি কি সেই রিনি? তবে আজকে রিনির ফোন আসতে আমার কুড়ি বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল।
তখন আমার বয়স চল্লিশ। সারাদিন দুপুর বাদ দিয়ে কোচিং ক্লাস করি। বাংলা পড়াই পাশ ও অনার্স। আমি কোন কলেজের প্রফেসর নই। তাদের মতো শুধু নোট দিয়ে কাজ সারি না। রীতিমতো বিষয়টা বুঝিয়ে দিই। তাই শিক্ষক হিসাবে আমার সুনাম ছিল। মুরারী পুকুর অঞ্চলে অরণ্য স্যারের কোচিংয়ের নামডাক ছিল। এক-একটা ব্যাচে আট-দশ জন পড়ত। এই রকম একটা ব্যাচে রাতের দিকে রিনি পড়ত। কারণ ওর মর্নিং কলেজ ছিল। পড়ত বিদ্যাসাগর কলেজে। আমার কোচিংয়ের সুনামের পিছনে আরো একটা কারণ ছিল। তা হল আমি অব্যর্থ সাজেশন দিতাম।
রিনি একটু লম্বা আর সুডৌল চেহারার মেয়ে ছিল। মুখে ছিল নিস্পাপ সারল্য। আর পাঁচটা মেয়ের থেকে একটু আলাদা। শান্ত ধীর-স্থির। অন্য মেয়েরা যখন হইচই করত। ও হয়তো তখন মৃদু হাসত। না হলে ডায়েরির পাতা ওল্টাতো। ওর একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল প্রায়দিন ঝাল লজেন্স নিয়ে কোচিংয়ে ঢুকত। সবাইকে একটা করে দিত। আমাকেও দিত। ভালই লাগত। ঝালঝাল স্বাদ। বলতাম, ‘রিনি তুমি মাঝেমধ্যে মিষ্টি লজেন্স আনতে পারো না?’
মুখটা কুঁচকে রিনি বলত, ‘এ মা মিষ্টি লজেন্স তো বাচ্চারা খায়। দাঁত নষ্ট করে। ঝাল লজেন্স সম্পর্ককে দৃঢ় করে।’
‘কী রকম?’ আমি একদিন প্রশ্ন করেছিলাম।
রিনি হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘জীবনে যখনই তুমি ঝাল খাবে আমার কথা মনে পড়বে। (আমি ছাত্রদের বলে রেখেছিলাম তোমরা কেউ আমাকে আপনি বলবে না।)
‘মিষ্টিতে বুঝি তা হয় না? তাহলে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার সময় সকলে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে যায় কেন?’
‘ওটা ট্র্যাডিশন ছাড়া কিছু না। দেখবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই সম্পর্ক টেকে না।’
রিনির বয়স তখন কত? একুশ-বাইশ হবে। এই বয়সে ও এই জীবনদর্শন কোথায় পেল?
রিনি ছিল ওর বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। মাঝে মাঝে কোচিং থেকে মেয়েকে নিতে ওর মা আসত। ঝড়বাদলের দিনে। কিংবা একটু রাত হলে। ওর মা’র বয়স তখন পঞ্চান্ন-ছাপান্ন হবে। কৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন। কপালে তিলক কাটতেন। রিনি ছিল ওনার বেশি বয়সের সন্তান। তাই ছিল ভীষণ আদরের মেয়ে রিনি।
সেই আদরের রিনি একটা অঘটন ঘটিয়ে বসল। এটা অঘটন কী? সবার চোখে সেটা তাই। কিন্তু আমার চোখে তা মনে হয়নি। কারণ বয়ঃসন্ধি কালে জীবনে প্রেম আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিয়ে করাটা সমীচীন হয়নি।
ওর বাবা-মা এই ঘটনায় ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু কিছু করার নেই। এক দুপুরে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে বিশ্বজিৎকে বিয়ে করল রিনি। ক্লাসে এলে আমি বললাম, ‘কাজটা তুমি ঠিক করোনি।’
‘বিশ্বজিৎ খুব চাপ দিচ্ছিল স্যার।’ রিনি বলল।
‘কে বিশ্বজিৎ?’
‘আমার বর।’
‘কেন চাপ দিচ্ছিল?’
‘ও হয়তো নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিল।’
‘সেটা কী রকম?’
‘ওর হয়তো মনে হয়ে থাকবে যে আমি ওকে বিয়ে করব না।’ 
‘তবু কাজটা তুমি ঠিক করোনি।’
‘কেন? তুমি তো তোমার একটা গল্পে এইরকম একটা চরিত্রের কথা লিখেছ।’
‘কোন গল্পে?’
‘কামিনীর কথা গল্পে।’
আমার তখন মনে পড়ছে না কামিনীর কথা গল্পে কী লিখেছি। লিখেছি তো অনেক গল্প। সব কি মনে রাখা সম্ভব? একটা গল্প সংকলন প্রকাশ হয়েছিল, তার একটা কপি ওকে দিয়ে ছিলাম। 
‘তুমি কি গল্পটা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে বিয়ে করে ফেললে?’
‘অনেকটা তাই।’
এবার মনে পড়েছে গল্পটার বিষয়। বললাম ‘ওই চরিত্রটার একটা সংকট দেখা দিয়েছিল, তাই বিয়ে করেছিল কামিনী।’
‘আমার অবস্থা তো তাই হয়েছিল স্যার।’
তারপর বেশ কিছুদিন কোচিংয়ে আসেনি রিনি। রাস্তায় দেখা হতে ওর মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রিনি কি পড়া ছেড়ে দিল?’
‘না। ওর বর ওকে এখানে মানে আপনার কোচিংয়ে পাঠাতে চাইছে না। ওর শ্বশুরবাড়ি তো মানিকতলা, সেখানে একটা কোচিংয়ে ভর্তি করে দিয়েছে।’
‘সে ভাল। বাড়ির কাছে পড়বে। মানিকতলা থেকে এখানে বাসে করে আসবে কেন?’
কিছু দিন পর হঠাৎ রিনি এসে হাজির। আমি চমকে উঠেছি। বললাম, ‘কী ব্যাপার রিনি শুনলাম তোমার বর চায় না তুমি এখানে পড়তে আসো। তা তুমি এলে যে!’
‘আমি তোমার কাছেই পড়ব। অন্য কোথাও না।’
‘তোমার বর চাইছে না, তবু তুমি আমার কাছে পড়বে?’
‘হ্যাঁ। আমার কোন স্বাধীনতা নেই বুঝি?’
মনে মনে বললাম, কথাটা তো ভুল নয়। একটা মেয়ের কেন স্বাধীনতা থাকবে না? আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। তাই আমার বাবা চেয়েছিল আমি কমার্স নিয়ে পড়ি। কিন্তু আমার প্রিয় বিষয় বাংলা। বাবাকে সে কথা সোজা বলেছিলাম।
কয়েক দিন ক্লাস করার পর আবার আসা বন্ধ হয়ে গেল রিনির। ওর মা’র সঙ্গে বাজারের পথে দেখা। বললাম, ‘রিনি আসছে না তো পড়তে। ওর কি অসুখবিসুখ হলো নাকি?’
‘না না। মেয়ে সুস্থ আছে।’
‘তাহলে আসছে না কেন?’
‘ওর বর আপনার কাছে পড়া নিয়ে অশান্তি করছে।’
‘অশান্তি যখন হচ্ছে, তখন না এলেই পারে।’
‘আমিও সে কথা বলেছি।’
আবার একদিন রিনি এসে হাজির। আমি বললাম, ‘কেন বরের সঙ্গে অশান্তি করছ? ওখানের কোচিংয়ে পড়ো না। অসুবিধা কী?’
‘তুমি কত সুন্দর করে বোঝাও। সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে পারি। যখন বৈষ্ণব পদাবলী পড়াও আমি তখন মনে মনে বৃন্দাবনে চলে যাই। আমার চোখে ভেসে ওঠে রাধিকার মুখ। তার দুঃখ ব্যথা নিজের ভেতর অনুভব করতে পারি। এমন করে ওই কোচিংয়ের স্যার বোঝান না। পুরনো নোটস্‌ ফেলে দিয়ে উনি বাজার চলে যান। এইভাবে শিক্ষা হয় নাকি?’
‘বুঝলাম তোমার কথা। কিন্তু যারা বিএ পরীক্ষা দেবে, তারা কি সবাই আমার কাছে পড়ে নাকি?’
‘জানি না। তোমার পড়া আমার ভাল লাগে। আমি তোমার কাছেই পড়ব। না হলে পড়া ছেড়ে দেব।’
‘এটা কেমন কথা হল রিনি?’
‘এটাই আমার মনের কথা।’
‘বরের সঙ্গে প্রতিদিন অশান্তি ভাল লাগবে?’
‘বেশি অশান্তি করলে সম্পর্ক থাকবে না।’
‘এ কী ভয়ানক কথা বলছ তুমি।’
‘যে সম্পর্কে আমি শান্তি পাব না। যেখানে কেউ আমার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবে, আমার পছন্দের মূল্য দেবে না, আমি সেই সম্পর্কের মধ্যে বিলং করতে পারব না।’
‘কী আশ্চর্য সব কথা বলছ তুমি!’
‘দুটো কোচিংয়ে আমাকে ভর্তি করেছিল। কেউ তোমার মতো বোঝাতে পারে না। তুমি দরদ দিয়ে ঝোঝাও।’
‘বুঝলাম তোমার কথা। আমার চেয়ে ভাল পড়ান, এমন স্যারও আছেন। তুমি কলেজের কোন প্রফেসরের কাছে পড়ো।’
‘একজন প্রফেসরের কাছেই তো ভর্তি করেছিল। তিনি বোঝাবেন না। ক্যাসেট চালিয়ে চলে যান নিজের কাজে।’
‘তাহলেও তুমি আমার কাছে এসো না। অন্য ব্যবস্থা করো।’
‘আমি বিয়ে করেছি বলে বরের অর্ডারসিটি শুনতে হবে? আমি কি তার সারভেন্ট? তুমি তো তোমার একটা গল্পে একটি নারীর স্বাধীনতার কথা লিখেছ।’
‘কোন গল্পে বলো তো?’
‘দরজার ওপারে।’
‘তুমি সব গল্প খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছ! আবার মনেও রেখেছ! আশ্চর্য!’
‘পড়ব না? সাহিত্য তো মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। সাহিত্যের হাত ধরে মানুষ এগিয়ে যায়।’
‘সব বুঝেছি। তুমি ভাল মেয়ে। তাই বলছি আর এসো না।’
‘তুমি বললেই আমি শুনব নাকি?’
সেদিন ক্লাস শেষ করে রাত দশটায় বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বুক পকেটে ফোনটা বেজে উঠল। চলন্ত সাইকেল দাঁড় করাই। কোচিং থেকে আমার ফ্ল্যাট সাইকেলে কুড়ি মিনিট। ডান পা মাটিতে ফেলে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি আননোন নম্বর। তবু বলি, ‘হ্যালো কে বলছেন?’
‘আমি বিশ্বজিৎ বলছি।’
‘কে বিশ্বজিৎ?’
‘আমি রিনির হ্যাজব্যান্ড।’
‘নমস্কার। হ্যাঁ বলুন।’
‘এটা কী হচ্ছে?’
একটু ধাক্কা খেলাম আমি, ‘মানে? কীসের কথা বলছেন?’
‘রিনি কেন আপনাকে ছেড়ে অন্য প্রফেসরের কাছে পড়তে চাইছে না? আপনি তো প্রফেসর নন। স্কুল শিক্ষকও নন।’
‘ঠিক বলেছেন। আমি শুধু টিচার।’
‘তাহলে আপনার থেকে যোগ্যতার টিচার দিচ্ছি তবু কেন সেখানে পড়তে চাইছে না রিনি?’
‘আপনার চোখে তারা বেশি যোগ্য হতে পারে। রিনি তা মনে করে না।’
‘সেটাই তো আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে! দুদিন প্রফেসরের কাছে গেল। আর গেল না। পরিষ্কার বলে দিল আপনাকে ছাড়া অন্য কোথাও পড়বে না। এর রহস্য কী?’
এইবার বড় জোর ধাক্কা খাই আমি। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে উষ্ম গলায় বলি, ‘কীসের রহস্য জানতে চাইছেন?’
‘আপনি ভাল বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি।’
‘না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’ ‘আমার গলা উঁচুতে ওঠে।
‘সহজ কথা আপনার সঙ্গে রিনির…’
‘আপনি একটা ননসেন্স। নিজের স্ত্রীকে অসম্মান করছেন।’
ফোন কেটে দিলাম। রাগে সারা শরীর কাঁপছে। নিজের ভেতর অপমান বোধ করছি। আর ভাবছি ছেলেটি এইরকম কথা বলার সাহস পেল কোথা থেকে? সাইকেলে উঠে প্যাডেল করতে গিয়ে বুঝলাম আমার হাত কাঁপছে। সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম। কিছু ওষুধ নেবার ছিল। নিলাম না। রাস্তা ফাঁকা হয়ে এসেছে। মেন রোড পার করে এপারে চলে এলাম। রাগে অপমানে এখনও শরীরটা থরথর করছে। কানের পাশ দিয়ে যেন আগুন ছুটছে। এমন একটা অশ্লীল কথা বলতে পারল ছেলেটা? তাও নিজের স্ত্রী সম্পর্কে। কথাটা বলার আগে জিভে আটকে গেল না কথাগুলো? এইসব ভাবতে ভাবতে ফ্ল্যাটে চলে আসি। কিছুক্ষণ থম দিয়ে বসে থাকি চেয়ারে। স্ত্রী জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল? অমন ভাবে বসে আছ যে। শরীর খারাপ নাকি?’ সব ঘটনাটা স্ত্রীকে বলি। স্ত্রী বলে, ‘ছেলেটার স্পর্ধা তো কম নয়। তুমি আর মেয়েটাকে পড়াবে না। এখন খেতে এস। রাত হয়েছে।’ তারপর হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসি। আবার ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে বুঝতে পারি বিশ্বজিৎ ফোন করছে। ফোনটা কেটে দিই। স্ত্রী বলল, ‘কে ফোন করেছে? ওই ছেলেটা?’
“হ্যাঁ।’
‘এবার ফোন করলে আমাকে দেবে।’
খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আবার ফোন বেজে উঠল। সেই বিশ্বজিৎ। 
স্ত্রী বলল, ‘ফোনটা আমাকে দাও। আমি কথা বলব।’
‘দাঁড়াও কী বলে শুনি।’ ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে বললাম, ‘তোমার সঙ্গে কোন কথা নয়। কেন ফোন করছ বার বার?’
‘আপনি রিনিকে ফিরিয়ে দিন।’ ‘বিশ্বজিতের গলা চড়া।
‘আমি তো কাউকে আটকে রাখিনি। ফিরিয়ে দেবার প্রশ্ন আসছে কেন?’
‘আপনার ওপর রিনির দুর্বলতা আছে। না হলে আপনাকে ছাড়া অন্যের কাছে পড়তে চাইছে না কেন?’
‘আপনি ভুল করছেন ওর যদি কোন দুর্বলতা থেকে থাকে, সেটা আমার ওপর নয়। আমার টিচিং স্কিলের ওপর।’
‘মানতে পারলাম না। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়োর ওর আপনার ওপর…’
‘আপনি শালীনতা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। এমন কথা বলবেন না। আপনার স্ত্রীকে বোঝান। ও তো আপনাকে ভালবেসে বিয়ে করেছে।’
‘এখন মনে হচ্ছে আমাকে বিয়ে করতে পারে কিন্তু ভালবাসে আপনাকে।’ এতক্ষণ স্ত্রী ফোনের সব কথা শুনছিল। হঠাৎ আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে উষ্ম গলায় বলে উঠল, ‘আপনি আমার স্বামীর চরিত্রের বদনাম করছেন। আপনার সাহস তো কম নয়। নিজের স্ত্রীকে কন্ট্রোল করতে পারছেন না? আপনি কি ইমপোটেড?’
আমি ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললাম, ‘ছি! এমন কথা কেউ বলে নাকি?’
‘তুমি বুঝতে পারছ না একবার তোমার চরিত্রে দাগ পড়ে গেলে কোন মেয়ে পড়তে আসবে?’
‘তবু তোমার এ-কথাটা বলা ঠিক হয়নি।’
‘তুমি বুঝতে পারো না ও সব ব্লেম তোমার ওপর চাপাছে। এরপর কোচিংয়ে এসে ঝামেলা করবে। ওই ইমপোটেড শব্দটা ওকে ঘায়েল করবে।’ ফোন অফ করে শুয়ে পড়লাম। সহসা ঘুম আসে না। ভিতরে একটা অস্থিরতা লাফাচ্ছে। স্ত্রী বলল, ‘একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নাও। না হলে ঘুম আসবে না তোমার।’ স্ত্রীর ঘুমের প্রবলেম আছে। তাই ডাক্তার ওকে ঘুমের ওষুধ লিখে দিয়েছে। সেখান থেকে একটা ট্যাবলেট নিয়ে খেয়ে জল খেলাম। বাথরুম করে এসে শুয়ে পড়লাম। 
তার পরদিন রিনি কোচিংয়ে এলো। আমি বললাম, ‘রিনি তুমি আর পড়তে এসো না।’
‘কেন? কী হল হঠাৎ?’ রিনির চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল।
‘তোমার বরকে জিজ্ঞেস করো।’
‘বিশ্বজিৎ কিছু বলেছে তোমায়?’ রিনি অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
‘আমার একটাই অনুরোধ তুমি আর এখানে এসো না।’
‘বিশ্বজিৎ যদি তোমায় অপমান করে থাকে তবে ওর সঙ্গে আমি শেষ বোঝাপড়া করে নেব।’
 
তারপর আর পড়তে আসেনি রিনি। শুনেছি বিশ্বজিৎ-এর সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে রিনি চলে গেছে সমুদ্রগড়, ওর মামার বাড়ি।
রিনি কেন এমন আচরণ করেছিল? অনেক ছাত্রীর আমার পড়া ভাল লাগত। তারা কেউ কেউ কোন কারণে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিত। আমার কাছেই ওর পড়ার প্রবল আকর্ষণ কেন ছিল? আমি একজন গল্পকার। আমার গল্প ওর ভাল লেগেছিল। সেই ভাল লাগা কি গল্পকারকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল? তাই কী ঝাল লজেন্স দিয়ে বলত, যখন ঝাল খাবে আমার কথা মনে পড়বে। আমি গ্যাসস্ট্রিকের রুগি। ঝাল খাই না। আর পাঁচটা মেয়ের মতো রিনিকে ভুলে গেছি। আজকে রং নাম্বারে রিনি নামে মেয়েটির ফোন না এলে রিনির কথা আপনাদের বলতে পারতাম না।
আজও আমার কাছে রিনির আচরণ বিস্ময়ের। এত বছর পরও ওর আচরণের ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাইনি। আপনারা যদি কেউ পান তবে এই নাম্বারে 983… জানাবেন। রাত হয়েছে। খেতে যাব। স্ত্রী অপেক্ষা করছে। শুভরাত্রি।

 

সমাপ্ত

2 comments:

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)