"প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,
কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে—"
"আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী
আমি সকল দাগে হব দাগি।
কলঙ্কভাগী"
এক্ষেত্রে চিরকাল সমাজের চোখে ঘৃণ্য অপরাধী হয়ে যায় নারী। হয়তো সুপ্রিম কোর্ট পরকীয়া অপরাধ নয় বলে রায় দেয় তবুও পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ-সংসার এই সম্পর্কে জড়িত নারীকেই কলঙ্কের কালিতে দাগিয়ে দেয়। সেই রাধাকৃষ্ণের সময়কাল থেকে আজও রাধার মতোই পরকীয়ার দায়ভার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীকেই বহন করতে হয়। কেন-না স্বকীয়ার সংজ্ঞা অনুযায়ী বলা হয়- ‘বিধি অনুসারে বিবাহিতা এবং পতিব্রতে অবিচালিকা সেই নায়িকাগণই স্বকীয়া’। সুতরাং সমাজদর্শন অনুযায়ী নির্ধারিত এই লক্ষণরেখা অতিক্রম করে কোন বিবাহিত নারী অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলে প্রথমে তিনিই দায়ী হবেন এই বৈধতাহীন সম্পর্কের জন্য যেমনটা হয়েছিলেন দ্বাপরের শ্রীরাধিকা।
কিন্তু একথাও স্বীকার্য
যে কলিকালে এসে শ্রীরাধিকাই হয়ে উঠেছেন আদর্শ প্রেমিকা আর রাধা কৃষ্ণের ভালবাসার
কথা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমগাঁথা রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। অর্থাৎ প্রেম যেখানে আত্মিক
বন্ধন সেখানে যে-কোন সম্পর্কই স্বকীয় হয়ে ওঠে তা কখনোই অবৈধ বা পরকীয়া হতে পারে
না।
‘সহজিয়া’ বাউল
সম্প্রদায়ের কাছে নারী বা সাধন সঙ্গিনী হলেন' প্রকৃতি 'যিনি তাঁর নিজের স্ত্রী হতে
পারে কিংবা অন্যের স্ত্রী, বিধবা অথবা স্বামীবিচ্ছিনা যাই হোক না কেন তাঁর সাথে
যদি প্রেম হয় বা সাধন চিন্তায় যদি ব্যাঘাত না ঘটে সেক্ষেত্রে সেই নারী হবেন
‘প্রকৃতি’। আর প্রকৃতির সাথে প্রেমকে সহজিয়ারা পরকীয়া মানতে নারাজ। সে তখন
স্বকীয়া। বৈদিক যুগে নারীর যেখানে খুশি যাওয়া স্বীকৃত ছিল। কারণ তখনও কামনা ও ভালবাসার
মধ্যে ফারাক চিহ্নিত করা যায়নি। মহাভারতে মহর্ষি উদ্দালক ও তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুর
সামনেই স্ত্রী অন্য ব্রাহ্মণের সাথে চলে যাচ্ছেন, তা দেখে উদ্বেলিত শিশুপুত্রকে সান্ত্বনা
জানিয়ে উদ্দালক বলছেন, ‘এটাই স্ত্রী জাতির ধর্ম’। বৃহস্পতির স্ত্রী তারা’কে কামনা
করছেন চন্দ্র, হরণও করছেন। সপ্তর্ষির স্ত্রীদের কামনা করছেন অগ্নিদেব। বন্ধু
দেবযানীর স্বামী যযাতি’কে কামনা করছেন শর্মিষ্ঠা। অর্থাৎ সেই প্রাচীন যুগ বা
পুঁথিতে প্রতি ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি এই ভালবাসার প্রকাশ।
তবে পরকীয়া প্রেম সাহিত্যে দেখতে পাওয়া যায় তা মূলত
মধ্যযুগে। নারীর পায়ে তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শক্ত শিকল। তাই মধ্যযুগের
সাহিত্যে নারীর ওপর পুরুষের একচেটিয়া অধিকার। নারী এখানে ভোগ্যপণ্য মাত্র। সমাজের
মানদণ্ডে নারীর পরকীয়া গর্হিত কাজ, কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে তা পুরুষত্ব প্রকাশের
অন্যতম অলংকার। যেমন মঙ্গলকাব্যে স্ত্রী লহনা’কে রেখে দিব্যি খুল্লনা’কে বিয়ে করছে
ধনপতি সওদাগর। ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সিংহলের রাজকুমারী পদ্মাবতীকে বিয়ে করতে
চলেছেন রাজা রত্নসেন।
কিন্তু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রূপকার
রবীন্দ্রনাথ এই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে এড়িয়ে গিয়ে তাঁকে অস্বীকার করেননি,
তিনি দেখিয়েছিলেন এই প্রেম সম্পর্কের ভিত অনেক গভীরে তাকে শত চেষ্টাতেও উপড়ে
ফেলা যায় না, যেমনটি হয়েছিল 'চোখের বালি'তে আশার স্বামী মহেন্দ্রর প্রেমে পড়া
বিনোদিনী কিংবা ‘ঘরে বাইরে’-তে বিবাহিতা বিমলার সন্দীপের প্রতি দুর্বলতা।
কিন্তু এ কথা সত্য যে এই ধরনের সম্পর্ক কোনভাবেই
স্বকীয়ার স্তরে পৌঁছোতে পারে না। কেন-না প্রতি মুহূর্তে একটা লুকোচুরি বা কয়েকটা
মিথ্যে দিয়ে কিছুকে সত্যি প্রমাণিত করার যে প্রয়াস তখনই ওই সম্পর্কের ভিতকে
নড়বড়ে করে দেয়। আবার যুক্তি-তর্ক-বুদ্ধি-বিচারশক্তি যেখানে বারবার পরাজিত হয়
সেখানে বিরাজ করে আবেগ। স্ত্রী ছাড়া অন্য নারী বা স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে
সম্পর্ক যখন যৌনতার গণ্ডি অতিক্রম করে মনের বা ভালবাসার হয়ে ওঠে তখন তা আর পরকীয়া
থাকে না, স্বকীয়া হয়ে ওঠে।
তাই সাধারণ ভালমন্দের
দৃষ্টিতে পরকীয়াকে বিচার করা কখনোই সম্ভব নয়। আর কোন সমাজ কখনই সম্পূর্ণ সৎ বা অসৎ
হতে পারে না।
আসলে মানব মনের অনুভূতি
ও অভিব্যক্তির সম্পূর্ণ হদিস পাওয়া অসম্ভব, তাই তা বিচার করার জন্য স্বীকৃতি দেওয়া
উচিত সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতাকেই।
কবি কি সাধেই লিখেছিলেন...
সমাপ্ত
Besh bhalo laglo...onno angike lekha.... Mousumi.
ReplyDeleteধন্যবাদ 🌹🌹
Deleteবাহ্ চমৎকার একটি আলোচনা, ঋদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteDarun
ReplyDelete"মনে" তে কেমন যেনো বিপ্লবী বিপ্লবী চেতনা লাগছে ।
ReplyDeleteদারুন লেখা👍👍👍👍
একটা জ্যান্ত মনোভাব , একদম ধারালো সব বার্তা👍❤️🙏
ReplyDeleteচমৎকার বিশ্লেষণ ।
ReplyDelete