প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব] | পারমিতা চ্যাটার্জি

বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/১ ৯ তম সংখ্যা/ ৩০শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ ধারাবাহিক উপন্যাস পারমিতা চ্যাটার্জি শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব...

Friday, November 8, 2024

সমরের বাড়ি | তন্ময় কবিরাজ

বাতায়ন/মাসিক/ধারাবাহিক গল্প/২য় বর্ষ/২০তম সংখ্যা/০৭অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

ধারাবাহিক গল্প

তন্ময় কবিরাজ

সমরের বাড়ি

[৩য় পর্ব]

"আদ্রা স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা করছেন সারদা প্রসাদ। গন্তব্য কলকাতা। নিজের কিছু কাজ আছেসঙ্গে সমরবাবু ডেকেছেন। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল রামদয়াল মুন্ডার সঙ্গে। সারদা প্রসাদ দেখতে পাননি। নিজের গীতাঞ্জলি অনুবাদের প্রুফ দেখছিলেন। রামদয়াল পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।"


পূর্বানুবৃত্তি আসলে কী জানেন, জীবনে তো অনেক কিছুই দেখলাম, সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হোক, ঢাকার আন্দোলন, তেভাগা। মুজিবর, হচি মীনকেও চিনেছি। আমার মাঝে মাঝে ভলতেয়ায়ের সেই কথাটা মনে পড়ে যায়, যেখানে কর্তা ভুল সেখানে সমাজের রোগ কে সারবে? বিপ্লবের দরকার। তারপর…
 
- আমার লেখাতে অভিযোগ সে আবার নতুন কী? তা আপনি নতুন কী শুনলেন?
নিচু স্বরে বীরেন্দ্রবাবু জানালেন,
- আপনার লেখা নাকি শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করেছে। আপনার একটা লাইন আছে নাআমি কখনও কোনো প্রেমিকের স্তনে দাঁত বসাইনি।
- যারা এগুলো বলে তাদের যৌনতা সম্পর্কে জ্ঞান নেই। প্রতি বছর রাশিয়াতে ১লা সেপ্টেম্বর গর্ভ দিবস পালন করা হয়। ফুকো তাঁর বইতে লিখছেন, আঠারো-উনিশ শতকে যৌন চাহিদা এত বেশি ছিল যে তাকে বিয়েতে আটকে রাখা যায়নি। আরে মশাই যৌনতা আদিম খিদে। তাকে আপনি শিক্ষিত করবেন কী করে? মহারাজ রণজিৎ সিং প্রকাশ্যে যৌনক্রিয়া করতেন। জোহান বাচোফোনের একটা বিখ্যাত বই ছিল। নামটা সম্ভত মাদার রাইট। বইটা পড়লে মানুষ ফালতু কথা বলত না। ক্যাথি আকার, সুসি বাইটরা মেয়েদের যৌনতার অধিকারে পজিটিভ জেন্ডার আন্দোলন করেছিলেন।
- এ তো রাজকীয় ব্যাপার। শুনুন মলয়বাবু, আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনি আপনার মতো করে চালিয়ে যান।
- ধন্যবাদ। তবে আমার পিকনিকের প্রস্তাবটা যেন আপনার মাথায় থাকে।
- থাকবে।
ঘাড় নাড়ালেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বললেন,
- কাল সমরবাবুর বাড়ি যাবো। সারদা আসবে। ওখানেই কথা হবে।
- বেশ যান। আমি এদিকের ঝামেলাগুলো মিটিয়ে নেই।
উঠে পড়লেন মলয় রায়চৌধুরীর। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন রাস্তার পাশ দিয়ে মলয়বাবুর সমান্তরালে।
 
আদ্রা স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা করছেন সারদা প্রসাদ। গন্তব্য কলকাতা। নিজের কিছু কাজ আছে, সঙ্গে সমরবাবু ডেকেছেন। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল রামদয়াল মুন্ডার সঙ্গে। সারদা প্রসাদ দেখতে পাননি। নিজের গীতাঞ্জলি অনুবাদের প্রুফ দেখছিলেন। রামদয়াল পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
- এত মনযোগ দিয়ে কী পড়ছেন? আমাদের কিছু শোনান। কবির মুখ থেকে কবিতার শোনার অনুভূতিটা আলাদা।
লজ্জিত সারদা প্রসাদ। নিজেকে সামলে বললেন,
- আসলে শহরে যাবার আগে ভাল করে দেখে নিচ্ছি।
- তা একটা কবিতা শুনি। ট্রেন তো আসতে দেরি আছে।
রাম দয়ালের আবদার।
- আমার থেকে জবার অনুবাদ আরোও ভাল। দাঁড়ান আমি ওঁর একটা কবিতা শোনাচ্ছি।
কথা শেষ করে ব্যাগ থেকে বইটা বার করে জবার একটা কবিতা শুনালেন। খুশি হলেন রাম দয়াল। বললেন,
- আপনি কিন্তু ভাষার জন্য ভাল কাজ করছেন।
- আমি আর কী করলাম? যা করার সে তো মাঝি রামদাস টুডু, রঘুনাথ মুর্মুরাই করে গেছেন। তাঁরাই তো আসল। আমরা তো শুধু বহন করছি মাত্র। এই আপনাদের রুহি দাস সিং নাগের কথাই ধরুন।
- ঠিক কথা। ওনার অবদানেই জেনিভা যাওয়া। একটা ব্যাকরণ বই লিখলাম জানেন। কেমন হয়েছে জানি না। তবে ভাল করার চেষ্টা করেছি বলতে পারেন।
বললেন রাম দয়াল।
আপনাদের সক্রিয়তার অভাব। জয়পাল অনেক চেস্টা করেছে। শুনেছি রাজেন্দ্র প্রসাদকে চিঠিও লিখেছে। তার কোনো উত্তর আসেনি বোধহয়?
রাম দয়াল অবাক, সারদা প্রসাদ বেশ খবর রাখেন। তাই তিনিও বললেন
- উনি তো রামগড় অধিবেশনেও যোগ দিয়েছিলেন।
কথার মাঝে খানিক বিরতির পরে রাম দয়াল বললেন,
- এসব বাদ দিন। আপনি তো একাই একশো। আর কত কাজ করবেন? এবার থামুন।
একটু আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন সারদা প্রসাদ।
- আসলে কী জানেন, ভাষাই শিক্ষার বাহন। আমি তো ভাষার জন্যই বলিলাহা হর রে। শুধু বড়দের কথা ভাবলে হবে না। বাচ্চাদের থাও ভাবতে হবে।
- আপনি তো বাচ্চাদের জন্যও কাজ করেছেন। আপনা গীদরা বাউলি আমি পড়েছি।
বললেন রাম দয়াল। শুনে খুশি হলেন সারদা।
- আরোও কিছু বই বার করেছি। পড়বেন?
- নামগুলো একটু বলুন।
- সালোম লটম, ভূর্কা ইপিল, গান গদর।
- পড়ব।
ভাবুক হয়ে পড়লেন রাম দয়াল।
- সারদাবাবু আমরা কি বেশি অনুবাদ করে নিজেদের ক্ষতি করছি?
উত্তরটা সারদার কাছেই ছিল। তাই বললেন,
- এ নিয়ে রূপচাঁদ হাঁসদাকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, অনুবাদের দরকার আছে। যেহেতু আমাদের সৃষ্টি কম, তাই খিদে মেটাতে ধার করতেই হবে।
- আমার তো ভয় হয় অনুবাদে যেন আবার নিজেদেরটাই না হারিয়ে যায়।
সাবধানী রাম দয়াল। ট্রেনের খবর হলো। উঠে পড়লেন দুজনই। রাম দয়াল বললেন,
- কাল অশোক সিংহের একটা কবিতা পড়লাম। শুনবেন?
- বলুন।
রাম দয়াল শোনালেন,
- এখন আমরা কোথায় দেখা করব ফুলমনি / কোন জঙ্গলে কোন পাহাড়ে / দুজনের দেখা হবে।
ট্রেন চলে গেল। ফাঁকা হতে থাকল ব্যস্ত স্টেশন।
 
 
সমরবাবু পাণ্ডুলিপি সরিয়ে চায়ের কাপটা রাখলেন।
- সারদাবাবু আপনাকে নিয়েই একটু আগে কথা হচ্ছিল। আপনি নিজেও জানেন না আপনি কী অসম্ভব ভাল কাজ করছেন। আপনারা গ্রামের লোকেরাই সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কলকাতার লোকেরা তো বাঙালি সাহিত্যকে বেচে দিতে পারলে বাঁচে।
- আমি তাগিদ থেকে করেছি সমরবাবু। আমি চাই আমার ভাষাটা বাঁচুক। ভাষা না থাকলে জাতির বিকাশ হবে না।
মোহিনীমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে সমর সেন বললেন,
- সবাই যদি ওনার মতো করে ভাবতে পারত তাহলে জাতির মর্যাদা আজ এতটা নষ্ট হতো না। আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে।
কথার মাঝেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হাজির।
- নতুন প্রস্তাব তো আমার কাছে।
কথাটা শুনে সবাই অবাক। বীরেন্দ্রবাবু বললেন,
- মলয়বাবু পিকনিকের প্রস্তাব দিয়েছেন।
মোহিনীমোহন বললেন,
- দারু প্রস্তাব। তবে মলয়বাবু ফরাসি শব্দের পিকনিক না বলে বনভোজন বলতে পারতেন।
পাশ থেকে সারদা প্রসাদ বললেন,
- তখন তো আপনারাই বলতেন রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন থেকে টুকেছে।
সবাই হাসল শুনে। সমর সেন বললেন,
- আমাদের আবার ফিরতে হবে। আমরা এক জোট নাহলে বাংলা ভাষার মতো বাংলা কবিতাও মরে যাবে।
সারদা প্রসাদ বললেন,
- তাহলে দিন ঠিক করে জানিয়ে দেবেন।
সমরবাবু হালকা হাসিতে জবাব দিলেন,
- সামনের শীতে। আর আপনারা ওখানেই হবে। লাল পাহাড়ির দেশে।
সারদা প্রাসাদ চিন্তিত।
- আমি পারব এত দায়িত্ব নিতে? আপনারা শহুরে মানুষ।
সারদা প্রাসাদ বাদে সবাই একসঙ্গে বলে উঠল,
- পারলে তুমিই পারবে। এতটা পথ যখন আসতে পেরেছ তখন বাকি পথও তুমি চলে যেতে পারবে। আমরা তোমার পাশে আছি।
 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)