বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য়
বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক, ১৪৩১
চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | ছোটগল্প
সীতাংশু
ভট্টাচার্য্য
মন্টু ড্রাইভার
"ও এখন রাহাবারির ড্রাইভার। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাস এগিয়ে চলল। না! গোপগড় পেরোনোর পর আজ কেউ গান চালাতে বলল না। কিছুটা যাওয়ার পর মায়ের আশীষ বাসটা হর্ন দিতে থাকল।"
ঘড়ির
কাঁটায় ঠিক ন'টা
পাঁচ বাজলেই
বাসটা রাঙামাটি স্টপেজে হাজির। নাকে মুখে দুটো ভাত গুঁজে আমিও দৌড় লাগাই স্ট্যান্ডের
দিকে। যেভাবেই হোক মায়ের আশীষ বাসটা ধরতেই হবে। না হলে টাইমে স্কুল
ঢুকতে পারব না। বাসে উঠেই ড্রাইভার সিটে প্রত্যেকদিনই দেখতাম মন্টুদাকে। গেটের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। হেল্পারদের তাড়া দিচ্ছে— লে রে
তাড়াতাড়ি কর! বাসে পা দিয়ে আমি দেখে নিই মন্টুদা আছে কিনা? মন্টুদাকে
দেখলে আশ্বস্ত হই, আজ তাহলে ঠিক টাইমে স্কুল ঢুকতে পারব। ‘স্যার
ভাল আছেন?’ বলে
মাথার কাছে হাতটি দিয়ে,
সেলামের ভঙ্গিতে এক গাল হাসি দিয়ে মন্টুদাও কুশল বিনিময় করত।
এই বাসের
বেশির ভাগ যাত্রীই নিত্যযাত্রী। স্কুল, অফিস বা স্বাস্থ্যবিভাগে চাকুরি করেন। তাই সবারই নির্দিষ্ট টাইমে ঢোকার তাড়া থাকে। মন্টুদা সে-কথা মাথায় রেখে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি করে বাসটা চালিয়ে নিয়ে যেত। ঠিক
দশটায় তাকে ঝাড়গ্রাম পেট্রোল পাম্প ঢুকতেই হবে।
বাসের
প্রতিটি নিত্যযাত্রীর সঙ্গে মন্টুদার একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। কোনোদিন যদি বাস না থাকে মন্টুদা কাউকে না কাউকে ফোন করে
জানিয়ে দিত। বাসটা গোপগড় পার হলেই মন্টুদাকে গান চালানোর জন্য আমরা বলতে থাকতাম।
মন্টুদাও সানন্দে গান চালিয়ে দিত। আমরা গান শুনতে শুনতে নিত্যযাত্রার কষ্ট ভুলে
কর্মের উদ্যেশ্যে যেতে থাকি। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই কী
করে অম্লান বদনে প্রত্যেকদিন চন্দ্রকোনা রোড থেকে বান্ডোয়ান প্রায় ১৬০ কিমি আপ-ডাউন করে। মায়ের আশীষ আর মন্টু ড্রাইভার যেন সমর্থক হয়ে গিয়েছিল।
মায়ের আশীষ বাসের ঠিক
আগেই থাকত রাহাবারি বাস। কিছুটা যেতে না যেতেই মন্টুদা রহাবারি বাসটাকে ধরে ফেলত। আর
টপকানোর জন্য অবিরাম হর্ন দিতে থাকত। রাহাবারি কিছুতেই সাইড দেবে না আর মন্টুদা
নাছোড়। সে টপকাবেই। শেষ পর্যন্ত মন্টুদারই জয় হতো। ধেরুয়া পৌঁছানোর আগেই কোন-না-কোনো জায়গায় সে কাজ হাসিল করত। টপকানোর পর মুখে
ফুটে উঠত যুদ্ধ জয়ের আত্মতৃপ্তি। মুখে বলত "আমাকে সাইড দিবি নি! অত সোজা
লয়। হুঁ-হুঁ আমিও মন্টু ড্রাইভার।"
বলেই চোখ বড় বড় করে,
ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে একবার দেখে নিত।
বাচ্চাদের
বার্ষিক পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন স্কুল যাইনি। প্রায় এক
সপ্তাহ পর আজ স্কুল যাচ্ছি। মায়ের আশীষ বাসে উঠেই দেখি ড্রাইভার সিটে মন্টুদা
নেই। চিন্তিত হয়ে হেল্পারকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল বাসের মালিক চেঞ্জ হয়ে গেছে। তাই
মন্টুদা বাদ হয়ে গেছে। ও এখন রাহাবারির ড্রাইভার। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাস
এগিয়ে চলল। না! গোপগড় পেরোনোর পর আজ কেউ গান চালাতে বলল না। কিছুটা যাওয়ার পর
মায়ের আশীষ বাসটা হর্ন দিতে থাকল। রাহাবারির মন্টু ড্রাইভার নির্দ্বিধায় তাকে
সাইড দিয়ে দিল। মন্টুদার পাশ দিয়ে মায়ের আশীষ হুস করে
বেরিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে মিলিয়ে গেল। পিছনে মন্টুদা গামছা দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে
শক্ত হাতে রাহাবারির স্টিয়ারিংটা ধরে ঝাড়গ্রামের দিকে
এগিয়ে চলল। জানি না ওটা ঘাম নাকি বুকের কষ্টমাখা চোখের জল।
ঠিক জানি না।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment