বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য়
বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক, ১৪৩১
চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | ছোটগল্প
মনোজ চ্যাটার্জী
চালকলের ভুষি
"ফুলমনি দ্যাখ দ্যাখ কী সুন্দর একটা নতুন বাবু এসেছে মিলে। কেনে তুই বুঝি বিহা করবি যে সুন্দর না কেমন দেখে বেরাছিস। তুই খুইব অসভ্য হয়ে গ্যাছিস, পুষ্পরানী একধাক্কা দেয় ফুলমনিকে। খিলখিল করে একদল সাঁওতাল রমণী হেসে গড়িয়ে পরে। মরদগুলা বলে ওঠে, মরণ, যা সব গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড় বাবুটোর উপর।"
বনপলাশী, গ্রামের
নামটার মধ্যেই যেন এক মহুয়া ফুলের গন্ধ, একটু একটু করে মাদকতায় গ্রাস করে।
গাঙ্গেয় সমভূমির উর্বর মাটির দেশ। গ্রামের একপাশ দিয়ে গেছে বর্ধমান-কাটোয়া সড়ক তো
ঠিক বিপরীত পাশে বর্ধমান-কাটোয়া ন্যারোগেজ লাইন। বর্ধমান শহর আধঘণ্টার পথ। তাই
একেবারে অজপাড়াগাঁ বলা যায় না আবার শহরসভ্যতার প্রবল
সংক্রমণের হাত থেকে কী যে প্রতিষেধক টিকা
নেওয়া আছে যে কলকাতার কোনো বাবু এখানে এলেই নিখাদ গ্রামবাংলার স্বাদ পাবেন।
গ্রামের মধ্যে সম্পূর্ণ পাকা বাড়ি বলতে একটি উচ্চ বিদ্যালয়, চারিদিকে
সবুজের মনোরম পরিবেশ,
'দীঘি ভরা জল করে টলমল',
চোখের সামনে এক অবাধ স্বাধীনতা।
এই গ্রামেরই এক দরিদ্র পুরোহিত পরিবারে অনির্বাণের জন্ম। স্বাচ্ছন্দ্যহীনতার মধ্যেই
তার বাবা তাকে অভাবের যন্ত্রণা থেকে আড়াল করে বড় করে তুলেছিলেন। গ্রামের হাই
স্কুলে সে ভাল মেধার নিদর্শন দেখায়, কিন্তু বর্ধমান শহরে উচ্চ মাধ্যমিক
পড়তে গিয়েই একটু একটু করে তার তথাকথিত অধঃপতন শুরু হয়। শহরের বহুমুখীনতায় আচ্ছন্ন
হয় তার কচি সবুজ মন। সিলেবাসের বাঁধাধরা জ্ঞানের জগতের সীমা ছাড়িয়ে সে মগ্ন হয়
সংবাদসাহিত্য, প্রযুক্তিবিজ্ঞান, খেলাধুলা, সমাজসেবা
ইত্যাদি নানা বিষয়ে। যথারীতি উচ্চমাধ্যমিক
পরীক্ষার ফল খারাপ হয় এবং সে ছিটকে যায় সাফল্যমন্ডিত কেরিয়ারের
দুনিয়া থেকে।
অনেক হতাশার দিন কাটানোর পর অবশেষে অনির্বাণ পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ারের শিরোপা
নিয়ে বেরিয়ে আসে জীবিকার অন্বেষণে। চাকরির চেষ্টা করতে করতে যখন ধৈর্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, তখন হঠাৎ অন্ধকারে ছোট লম্ফর মতো এক রাইস মিলে একটা চাকরি পেল সে। রাইস মিলে যোগ দেওয়ার দিনপাঁচেকের মধ্যেই তাকে সমর্পন করা হল কোম্পানির দুঁদে প্রোডাকশন সুপারভাইসর রতনবাবুর অধীনে। প্রশিক্ষণে তাঁর দক্ষতা নাকি প্রশ্নাতীত।
প্রতিদিন সকাল আটটার মিনিট পনেরো আগেই অনির্বাণ পৌঁছে যায় রাইস মিলে। চারিদিকে পারবয়লার, ক্লিনার, প্যাডিহাস্কার, ড্রায়ার, পালিশার, গ্রেডার ইত্যাদি নানারকম বিশালকায় মেশিনের ছড়াছড়ি আর তাদের থেকে
নির্গত কর্কশ আওয়াজ। এর সঙ্গে আছে কারখানার মধ্যে ভুষিগুড়ি, চালগুড়ি, ডিওবিগুড়ি, ধোঁয়া ইত্যাদির অসহনীয়
দূষণ।
-আরে ব্যানার্জী এসে গেছ, ভেরী গুড, এই পাংচুয়ালিটী ধরে রাখতে হবে সবসময়, তুমি হয়তো ভেবেছিলে রাইস মিলে কাজ করতে হবে, বাট ইউ সি আমাদের সলভেন্ট অয়েল মিল আছে, পাওয়ার প্লান্ট ইরেকশন হচ্ছে, তোমাকে আমরা মেনলি নিয়েছি অয়েল মিল ও পাওয়ার প্লান্টের জন্য, তবে তুমি তো একেবারেই নভিশ, তোমাকে সব কাজ শিখে নিতে হবে আর কোনো কাজ ছোট মনে করবে না, ইন্ড্রাস্টিতে কাজ করতে এসেছ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব করতে হবে।
ব্যানার্জী খুব নিষ্ঠার সাথে কাজে মনোনিবেশ করে। প্রথম কয়েকদিন পুরো কারখানা শিক্ষানবিশসুলভ পর্যবেক্ষণের পর রতনবাবু তাকে অয়েল মিল ও পাওয়ার প্লান্টের সুপারভিশনের দায়িত্ব দিলেন।
-এ ফুলমনি দ্যাখ দ্যাখ কী সুন্দর একটা নতুন বাবু এসেছে মিলে।
-কেনে তুই বুঝি বিহা করবি যে সুন্দর না কেমন দেখে বেরাছিস।
-তুই খুইব অসভ্য হয়ে গ্যাছিস, পুষ্পরানী একধাক্কা দেয় ফুলমনিকে। খিলখিল করে একদল সাঁওতাল রমণী হেসে গড়িয়ে পরে। মরদগুলা বলে ওঠে, মরণ, যা সব গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড় বাবুটোর উপর।
এরা সব কারখানার ঠিকাশ্রমিক। তা যাইহোক, অনির্বাণ তার প্রযুক্তিজ্ঞানও শিখে নেওয়ার প্রচণ্ড আগ্রহের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত কাজ দেখাশোনা করতে থাকে। রতনবাবু তাকে প্রথমে বয়লারের দায়িত্ব, তারপরে বয়লারের সাথে টারবাইনের দায়িত্ব ও সবশেষে পুরো পাওয়ার প্লান্ট ইরেকশন ও কমিশনিং-এর সুপারভাইসরের দায়িত্ব দিলেন। আটটা-পাঁচটার ডিউটি কখন যে আটটা-সাতটার ডিউটি হয়ে গেল সে ধরতেই পারল না। মিলের মালিক দু-তিন সপ্তাহে একবার ভিজিটে আসেন। বয়লার-টারবাইনের সব ইনস্টলেশন সে তার ইন্জিনিয়ারিং বুদ্ধি দিয়ে ড্রয়িং অনুসারে করালেও মালিকের সামনে রতনবাবু ও রাইসমিলের ইনচার্জ নাড়ুদা সব কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে নেন। তাকে কথা বলার কোন সুযোগই দেন না।
-কী ব্যানার্জী, তুমি কি
শুধু দর্শক হয়ে থাকো না কি?
না না, ব্যানার্জী বলার আগেই নাড়ু বলে ওঠে আমি আর রতনবাবু ওকে ভাল করে সব
বুঝিয়ে দিই, তারপর ও কাজ করায়। ভুলটুল করে, আমরা ঠিক
করে দিই। অনির্বাণ হতবাক হয়ে যায় এদের
মিথ্যাচার দেখে, দুটো
নন-টেকনিক্যাল লোক তার ভুল নাকি ঠিক করে দেয়।
একটু একটু করে পাওয়ার প্লান্ট তৈরি হয়ে ওঠে, ফাঁকা জমি থেকে একটা সম্পূর্ণ কারখানার রূপ ধারণ করে। ব্যানার্জী যখন প্রথম জয়েন করে, সেই বাজারে মাত্র পাঁচ হাজার মাইনে দাবি করলেও মালিক তাকে তিন হাজারের বেশি দেন না। বয়লার উদ্বোধনের কাছাকাছি রতনবাবু একদিন বললেন— আমি তো জানি ব্যানার্জী তুমি কত ভাল কাজ করছ আমি মালিককে তিন-চারবার বলেছি তোমার মাইনে বাড়ানোর জন্য, কিন্তু ওই নাড়ু সবসময় তোমাকে হেয় করে ব্যাপারটায় জল ঢেলে দেয়। তাও আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই তোমার মাইনে বেড়ে যাবে। এই নাড়ুর গ্রামে জমিজমা না থাকায় মাত্র পনেরো বছর বয়সে এক রাইস মিলে যোগ দেয়, নিজস্ব বুদ্ধি ও অর্থ উপার্জনের মরিয়া চেষ্টার মাধ্যমে রাইস মিলের সমস্ত কাজে দক্ষতা অর্জন করে। এই মালিক মিল তৈরির সময় যোগ দেয় ও দ্রুত বাবুর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। কোন পিছুটান না থাকায় সেই এখন মিলের সর্বক্ষণের অতন্দ্র প্রহরী। মানুষের আনন্দের মধ্যে বেঁচে থাকার সব উপাদান সে মিলের মধ্যেই খুঁজে নেয়।
অনির্বাণ একদিন
জলশোধন প্লান্টের দিকে যাচ্ছিল, মেশিনের বড় বড় ফাউন্ডেশন
দেখতে, দরজার
মুখে ঢুকতেই সে অবাক,
দেখে নির্জন হলঘরে নাড়ুর বক্ষলগ্না হয়ে দুই নগ্ন সাঁওতাল কামিন ফুলমনি আর
পুষ্পরানী। তার মনে পড়ে একদিন তার চোখে ভুষির কুটো ঢুকে যায়, অন্য
কর্মীরা তাকে পুষ্প কামিনের কাছে পাঠায়। পুষ্প তাকে একেবারে নিজের বৌয়ের মতো সংলগ্ন হয়ে তার বুকের দিকে তাকাতে বলে কুটো বার করে দেয়। এহেন নাড়ু থাকতে
তার যে কর্মে উন্নতির সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ তা সে ভালই বুঝতে পারছিল। তবু সে কাজের
ক্ষেত্রে
কোন ঢিলেমি দেয়নি। ‘নাড়ু, কাজকর্ম কেমন চলছে চলো দেখে আসি’ বাবু একদিন ভিজিটে বেড়িয়ে বললেন আর দূর থেকে তাকে ডেকে নিলেন। ইতিমধ্যে রবাহুতের মতো রতনবাবু ছুটে এসে সঙ্গ নিলেন। বিশালাকার চিমনিসহ প্রায় সত্তর ফুটের বয়লারের দেখে মালিক বললেন, ‘নাড়ু তোমার ক্যালি আছে বাপু, তুমি না থাকলে এরকম একখানা বয়লার তৈরি হতে অনেক অসুবিধা আসত। ‘কী বলেন বাবু, আপনার নজরদারি ছাড়া আমাদের ভুলগুলো ধরাই পড়ত না।’ পুরো পাওয়ার প্লান্ট পরিদর্শনের পর সামনের ফাঁকা জায়গাতে এসে বাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘নাড়ু এই জায়গাটায় ব্যানার্জীর জন্য একটা পাওয়ার প্লান্টের অফিস করে দিতে হবে।’ নাড়ুর মুখটা কেমন পাল্টে যায় কথাটা শোনামাত্র।
অনির্বাণ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, নাড়ু আর রতনবাবুর সব শয়তানি মালিকের কাছে ধরা পরে গেছে বুঝতে পেরে। বেশ
আনন্দের সাথে সেদিন সে বাড়ি ফেরে। কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়ার প্লান্টের কাজ আস্তে আস্তে সম্পূর্ণতার দিকে এগোতে থাকে। উদ্বোধনের দিন এগিয়ে আসছে, বিভিন্ন মেশিনের নিয়ন্ত্রণের জন্য কোম্পানি চারজন নতুন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করে। রতনবাবু আনকোরা চারজনকে ব্যানার্জীর কাছে পাঠিয়ে দেন কাজকর্ম সব ভাল করে দেখে নেওয়ার জন্য। তাদের সঙ্গে কথায় কথায় সে জানতে পারে তাদের মাইনে আটহাজার করে, যেখানে ব্যানার্জী পায় মাত্র সাড়ে তিনহাজার টাকা। তীব্র একটা বিমর্ষতা নিয়ে সে ছুটির পর বাড়ি ফেরে। পরের দিন সকালে তার মা তাকে ডাকে, ‘কী রে বাবু, আজ ডিউটি যাবি না, আটটা বেজে গেল যে।’ ধড়ফড়িয়ে তৈরি হয়ে সে অফিস যায়, কিন্তু সেই কর্মনিষ্ঠা আর তার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না। একটু একটু করে হতাশার মেঘ গ্রাস করে তাকে। একসময় সে রতনবাবুকে ফোন করে জানিয়ে দেয় আর সে কাজ করবে না। অনির্বাণ এখন গ্রামের ছোট
ছোট ছেলেদের টিউশন্ পড়িয়ে সামান্য কিছু রোজগার করে।
অনেক হতাশার দিন কাটানোর পর অবশেষে অনির্বাণ পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ারের শিরোপা
নিয়ে বেরিয়ে আসে জীবিকার অন্বেষণে। চাকরির চেষ্টা করতে করতে যখন ধৈর্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, তখন হঠাৎ অন্ধকারে ছোট লম্ফর মতো এক রাইস মিলে একটা চাকরি পেল সে। রাইস মিলে যোগ দেওয়ার দিনপাঁচেকের মধ্যেই তাকে সমর্পন করা হল কোম্পানির দুঁদে প্রোডাকশন সুপারভাইসর রতনবাবুর অধীনে। প্রশিক্ষণে তাঁর দক্ষতা নাকি প্রশ্নাতীত।
প্রতিদিন সকাল আটটার মিনিট পনেরো আগেই অনির্বাণ পৌঁছে যায় রাইস মিলে। চারিদিকে পারবয়লার, ক্লিনার, প্যাডিহাস্কার, ড্রায়ার, পালিশার, গ্রেডার ইত্যাদি নানারকম বিশালকায় মেশিনের ছড়াছড়ি আর তাদের থেকে
নির্গত কর্কশ আওয়াজ। এর সঙ্গে আছে কারখানার মধ্যে ভুষিগুড়ি, চালগুড়ি, ডিওবিগুড়ি, ধোঁয়া ইত্যাদির অসহনীয়
দূষণ।
-আরে ব্যানার্জী এসে গেছ, ভেরী গুড, এই পাংচুয়ালিটী ধরে রাখতে হবে সবসময়, তুমি হয়তো ভেবেছিলে রাইস মিলে কাজ করতে হবে, বাট ইউ সি আমাদের সলভেন্ট অয়েল মিল আছে, পাওয়ার প্লান্ট ইরেকশন হচ্ছে, তোমাকে আমরা মেনলি নিয়েছি অয়েল মিল ও পাওয়ার প্লান্টের জন্য, তবে তুমি তো একেবারেই নভিশ, তোমাকে সব কাজ শিখে নিতে হবে আর কোনো কাজ ছোট মনে করবে না, ইন্ড্রাস্টিতে কাজ করতে এসেছ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব করতে হবে।
ব্যানার্জী খুব নিষ্ঠার সাথে কাজে মনোনিবেশ করে। প্রথম কয়েকদিন পুরো কারখানা শিক্ষানবিশসুলভ পর্যবেক্ষণের পর রতনবাবু তাকে অয়েল মিল ও পাওয়ার প্লান্টের সুপারভিশনের দায়িত্ব দিলেন।
-এ ফুলমনি দ্যাখ দ্যাখ কী সুন্দর একটা নতুন বাবু এসেছে মিলে।
-কেনে তুই বুঝি বিহা করবি যে সুন্দর না কেমন দেখে বেরাছিস।
-তুই খুইব অসভ্য হয়ে গ্যাছিস, পুষ্পরানী একধাক্কা দেয় ফুলমনিকে। খিলখিল করে একদল সাঁওতাল রমণী হেসে গড়িয়ে পরে। মরদগুলা বলে ওঠে, মরণ, যা সব গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড় বাবুটোর উপর।
এরা সব কারখানার ঠিকাশ্রমিক। তা যাইহোক, অনির্বাণ তার প্রযুক্তিজ্ঞানও শিখে নেওয়ার প্রচণ্ড আগ্রহের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত কাজ দেখাশোনা করতে থাকে। রতনবাবু তাকে প্রথমে বয়লারের দায়িত্ব, তারপরে বয়লারের সাথে টারবাইনের দায়িত্ব ও সবশেষে পুরো পাওয়ার প্লান্ট ইরেকশন ও কমিশনিং-এর সুপারভাইসরের দায়িত্ব দিলেন। আটটা-পাঁচটার ডিউটি কখন যে আটটা-সাতটার ডিউটি হয়ে গেল সে ধরতেই পারল না। মিলের মালিক দু-তিন সপ্তাহে একবার ভিজিটে আসেন। বয়লার-টারবাইনের সব ইনস্টলেশন সে তার ইন্জিনিয়ারিং বুদ্ধি দিয়ে ড্রয়িং অনুসারে করালেও মালিকের সামনে রতনবাবু ও রাইসমিলের ইনচার্জ নাড়ুদা সব কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে নেন। তাকে কথা বলার কোন সুযোগই দেন না।
একটু একটু করে পাওয়ার প্লান্ট তৈরি হয়ে ওঠে, ফাঁকা জমি থেকে একটা সম্পূর্ণ কারখানার রূপ ধারণ করে। ব্যানার্জী যখন প্রথম জয়েন করে, সেই বাজারে মাত্র পাঁচ হাজার মাইনে দাবি করলেও মালিক তাকে তিন হাজারের বেশি দেন না। বয়লার উদ্বোধনের কাছাকাছি রতনবাবু একদিন বললেন— আমি তো জানি ব্যানার্জী তুমি কত ভাল কাজ করছ আমি মালিককে তিন-চারবার বলেছি তোমার মাইনে বাড়ানোর জন্য, কিন্তু ওই নাড়ু সবসময় তোমাকে হেয় করে ব্যাপারটায় জল ঢেলে দেয়। তাও আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই তোমার মাইনে বেড়ে যাবে। এই নাড়ুর গ্রামে জমিজমা না থাকায় মাত্র পনেরো বছর বয়সে এক রাইস মিলে যোগ দেয়, নিজস্ব বুদ্ধি ও অর্থ উপার্জনের মরিয়া চেষ্টার মাধ্যমে রাইস মিলের সমস্ত কাজে দক্ষতা অর্জন করে। এই মালিক মিল তৈরির সময় যোগ দেয় ও দ্রুত বাবুর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। কোন পিছুটান না থাকায় সেই এখন মিলের সর্বক্ষণের অতন্দ্র প্রহরী। মানুষের আনন্দের মধ্যে বেঁচে থাকার সব উপাদান সে মিলের মধ্যেই খুঁজে নেয়।
কোন ঢিলেমি দেয়নি। ‘নাড়ু, কাজকর্ম কেমন চলছে চলো দেখে আসি’ বাবু একদিন ভিজিটে বেড়িয়ে বললেন আর দূর থেকে তাকে ডেকে নিলেন। ইতিমধ্যে রবাহুতের মতো রতনবাবু ছুটে এসে সঙ্গ নিলেন। বিশালাকার চিমনিসহ প্রায় সত্তর ফুটের বয়লারের দেখে মালিক বললেন, ‘নাড়ু তোমার ক্যালি আছে বাপু, তুমি না থাকলে এরকম একখানা বয়লার তৈরি হতে অনেক অসুবিধা আসত। ‘কী বলেন বাবু, আপনার নজরদারি ছাড়া আমাদের ভুলগুলো ধরাই পড়ত না।’ পুরো পাওয়ার প্লান্ট পরিদর্শনের পর সামনের ফাঁকা জায়গাতে এসে বাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘নাড়ু এই জায়গাটায় ব্যানার্জীর জন্য একটা পাওয়ার প্লান্টের অফিস করে দিতে হবে।’ নাড়ুর মুখটা কেমন পাল্টে যায় কথাটা শোনামাত্র।
অনির্বাণ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, নাড়ু আর রতনবাবুর সব শয়তানি মালিকের কাছে ধরা পরে গেছে বুঝতে পেরে। বেশ
আনন্দের সাথে সেদিন সে বাড়ি ফেরে। কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়ার প্লান্টের কাজ আস্তে আস্তে সম্পূর্ণতার দিকে এগোতে থাকে। উদ্বোধনের দিন এগিয়ে আসছে, বিভিন্ন মেশিনের নিয়ন্ত্রণের জন্য কোম্পানি চারজন নতুন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করে। রতনবাবু আনকোরা চারজনকে ব্যানার্জীর কাছে পাঠিয়ে দেন কাজকর্ম সব ভাল করে দেখে নেওয়ার জন্য। তাদের সঙ্গে কথায় কথায় সে জানতে পারে তাদের মাইনে আটহাজার করে, যেখানে ব্যানার্জী পায় মাত্র সাড়ে তিনহাজার টাকা। তীব্র একটা বিমর্ষতা নিয়ে সে ছুটির পর বাড়ি ফেরে। পরের দিন সকালে তার মা তাকে ডাকে, ‘কী রে বাবু, আজ ডিউটি যাবি না, আটটা বেজে গেল যে।’ ধড়ফড়িয়ে তৈরি হয়ে সে অফিস যায়, কিন্তু সেই কর্মনিষ্ঠা আর তার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না। একটু একটু করে হতাশার মেঘ গ্রাস করে তাকে। একসময় সে রতনবাবুকে ফোন করে জানিয়ে দেয় আর সে কাজ করবে না। অনির্বাণ এখন গ্রামের ছোট
ছোট ছেলেদের টিউশন্ পড়িয়ে সামান্য কিছু রোজগার করে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment