বাতায়ন/প্রেমের
Rush-লীলা/ধারাবাহিক গল্প/২য় বর্ষ/২৫তম সংখ্যা/০৬ই মাঘ, ১৪৩১
প্রেমের
Rush-লীলা | ধারাবাহিক গল্প
সঙ্ঘমিত্রা
দাস
কলঙ্কিনী
[১ম পর্ব]
"অনেকেই জানত, দেখেওছে কখনও দুপুরের দিকে আবার কখনও সন্ধের দিকে দুধ দেবার নামে একটি ছেলে আসত। বেশ অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে বের হতো। সুনয়নার সাথে ফষ্টিনষ্টি ছিল তার। ছি! ছি!"
বেশ
কিছুক্ষণ হলো ঘরের ভেতর থেকে আসা চিৎকার-চেঁচামেচি, কান্নার
শব্দটা কমে এসেছে। পরমাদেবীর বিলাপের আওয়াজটা কান পাতলে শোনা যাচ্ছে।
"সব শেষ হয়ে গেল। ডাইনিটা আমার ছেলেটাকে খেল। আয় এবার আমাকে খেয়ে তোর সব সাধ পূরণ কর"
এক নাগাড়ে বলে চলেছেন কথাগুলো।
পুলিশের জিপটা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। থানার বড়বাবু, মেজবাবু আর দুজন মহিলা কনেস্টবল ভিতরে ঢুকেছেন। আর
"সব শেষ হয়ে গেল। ডাইনিটা আমার ছেলেটাকে খেল। আয় এবার আমাকে খেয়ে তোর সব সাধ পূরণ কর"
এক নাগাড়ে বলে চলেছেন কথাগুলো।
পুলিশের জিপটা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। থানার বড়বাবু, মেজবাবু আর দুজন মহিলা কনেস্টবল ভিতরে ঢুকেছেন। আর
ছোটবাবু পাহারায় আছেন কোলাপসিবেল গেটটায়। কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাড়ির ভেতরের কেউ যাতে
পালাতে না পারে তার জন্য এই ব্যবস্থা। তবে পাড়ার লোকেরা অনেক আগেই পিছনের পাঁচিল
টপকে একজনকে দৌঁড়ে পালাতে দেখেছে। সোজা ছুটে গিয়ে একটা রানিং অটোতে উঠে
পালিয়েছে সে। একটা অ্যাম্বুলেন্স আর একটা কালো পুলিশ ভ্যান এসে দাড়ালো এইমাত্র।
চারদিকে উৎসুক মানুষের জটলা, ফিশফাশ নানা কথা। বাড়ির বৌ প্রেমিকের সঙ্গে মিলে খুন করেছে স্বামীকে। দারুণ
মুখরোচক বিষয়। নানা জন নানা গল্প বানাতে ব্যস্ত। সাথে রয়েছে কুৎসিত গালিগালাজ আর
নানাপ্রকার ব্যঙ্গাত্মক অঙ্গভঙ্গি।
একটা
স্ট্রেচারে করে সাদা চাদরে মোড়া সৌমেন তালুকদারের দেহটা বাইরে আনা হলো। বছর
ছত্রিশ-সাঁইত্রিশের তরতাজা তরুণ, এখন কেমন নিথর পড়ে আছে। জন্ম থেকে
এই পাড়াতেই মানুষ ছেলেটা। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিল তারপর পড়াশুনার পাট থামিয়ে ও-ই বাবার ব্যবসার হাল ধরা। মা-ছেলের সুখী সংসারে
বছর ছয়েক আগেই এলো সুনয়না। সম্বন্ধ দেখেই বিয়ে। এককথায় পরমা সুন্দরী সে। বারো
ক্লাসটা পাশ করতে পারেনি দুবারেও তাই বাবা-মা সৎপাত্র দেখে
পাত্রস্থ করলেন সুনয়নাকে। বয়েসের পার্থক্য তা প্রায় বারো বছরের কিন্তু এমন প্রতিষ্ঠিত ছেলে পেয়ে তারা আর এই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। বেশ ধুমধাম করে
বিয়ে হয়েছিল। এখন সৌমেনের ব্যবসাও রাজ্য ছাড়িয়ে দেশে, দেশ
ছাড়িয়ে বিদেশে জায়গা করে নিয়েছে। ভীষণ পরিশ্রমী ছেলেটি শুধু ছুটছে এক প্রান্ত
থেকে আর এক প্রান্তে। বিয়েতে পাড়া, বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে হাজারের উপর
নিমন্ত্রিত ছিল। এমন এক এলাহি আয়োজনের মধ্যে দিয়ে নতুন গৃহে প্রবেশ ঘটেছিল
সুনয়নার। ওর বয়স তখন মাত্র উনিশ।
অ্যাম্বুলেন্সটা
সাইরেন হাঁকিয়ে রওনা দিল। পোষ্টমর্টেম হবে তারপর বাড়ির লোকের হাতে তুলে দেওয়া
হবে বডি। শেষকৃত্য সারতে পারবে তারপরে। সৌমেনের মাসতুতো ভাই আর তার বৌ এসেছে।
তারাই ছোটাছুটি করছে। ওরা ছাড়া বিশেষ কোন নিকট আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ নেই
সৌমেনের। ওরাই
সামলাচ্ছে সবটা। ওর মা তো হুইলচেয়ারে বন্দি। একনাগাড়ে তার
কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জলজ্যান্ত ছেলেটার এমন পরিণতি কোন মা মেনে নিতে পারে।
রাস্তার
দুধারে লোকের ভিড়। উৎসাহী চোখগুলো অপেক্ষা করছে কখন বের করা হবে আসামিকে। অনেকেই
বেশ উৎসুক। পাড়ার যেসব মহিলাদের সুনয়না রূপের অহংকার দেখিয়ে এড়িয়ে যেত তারা
বা স্বামী
বাইরে থাকার সুযোগে নানা রকম ইঙ্গিত দিয়ে পাত্তা না পাওয়া পুরুষেরা মনে মনে বেশ
আনন্দ পাচ্ছে, মুখে
অবশ্য একটা দুঃখু দুঃখু মুখোশ
লাগিয়ে রেখেছে। অনেকেই জানত, দেখেওছে কখনও দুপুরের দিকে আবার কখনও
সন্ধের দিকে দুধ দেবার নামে একটি ছেলে আসত। বেশ অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে বের হতো। সুনয়নার সাথে ফষ্টিনষ্টি ছিল তার। ছি! ছি! ভদ্র বাড়ির বৌয়ের কী
রুচি। আর এসব মুখরোচক খবর তো হাওয়ার আগে ছড়িয়ে পড়ে। আজ পাড়াপ্রতিবেশীরা সুযোগ
পেয়েছে। আশেপাশের মানুষ, ছাত্র, যুবা, মহিলা বাহিনীর হাতে পাথর, ডিম, পচা লেবু, টম্যাটো, তারা
একেবারে রেডি। মেয়েটি বের হলেই লক্ষ্য করে ছুঁড়তে হবে। এতক্ষণ অপেক্ষার অবসান
ঘটিয়ে বেরিয়ে আসে সে। দুজন মহিলা কনেস্টবল দুদিকে ধরে আছে। সাদা একটা ছাপার
চুড়িদার পড়া তাতে এখনও কাঁচা রক্তের ছিটে। মুখটা ওড়না দিয়ে ঢাকা।
সেই ওড়নার নীচের চোখদুটোতে জল আছে কি না বোঝার উপায় নেই। শাঁখা-পলা পরা হাতদুটো হ্যান্ডকাফে বাঁধা। গতকালই শিবরাত্রি গেছে। লাল পাড়
সাদা শাড়ি, হাতে নোয়া, শাঁখা, পলা বাঁধানো পরে সুন্দর সেজে সন্ধ্যাবেলায় বড় বটতলার শিবমন্দিরে স্বামীর দীর্ঘায়ু
কামনায় জল ঢেলেছে। শাঁখা-পলা বাঁধানোটা আর খোলার সময়
পায়নি। তার আগেই ঘটে গেছে যা, তা হয়তো সুনয়না স্বপ্নেও কল্পনা
করেনি। গাড়ির মধ্যে প্রায় ঠেলেই তোলা হয় ওকে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে অকথ্য
গালাগালি। ইট, ডিম
টম্যাটোর বৃষ্টি। ভ্যানে উঠে মুখের ওড়নাটা সরিয়ে নেয় পুলিশ।
হাতটা গাড়ির ভিতরের রডের সাথে বেঁধে দেওয়া হয়। দুপাশে ওই দুই কনেস্টবল। লোকজন
হুমড়ি খেয়ে পড়ে গাড়ির ওপর। মেয়েটা নির্লিপ্ত বসে আছে, চোখে জলের
ছিটেফোঁটাও নেই। কী বেহায়া মেয়েমানুষ। কত শত ঘৃণার চোখ এখনই
হাতের কাছে পেলে ওকে শেষ করে দেবে। গাড়িটা এগিয়ে যায়, পিছনে ছেড়ে
যায় সুনয়নার ছয় বছরের সংসার। কত গল্প, কত কথা সেখানে চাপা পড়ে রইল। কে
খোঁজ করবে তার।
ঘটনা
এইটুকুই। আগের গল্প মোটামুটি জানা। কোর্টকাছারি, দোষী প্রমাণিত, শাস্তি। সহজ জলের মতো
সরল কেস। একজন গৃহবধূ স্বামীর অনুপস্থিতিতে একটি অল্পবয়সি
যুবকের সাথে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। স্বামী তার এই রাসলীলা কাহিনি জেনে যেতেই প্রেমিকের সঙ্গে জোট বেঁধে নিজের স্বামীকে গুলি করে হত্যা
করে। প্রেমিক পলাতক,
পুলিশ তার খোঁজ করছে। কিন্তু পাড়ার লোকের তৎপরতায় বধূটিকে অস্ত্রসহ হাতেনাতে
গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কিন্তু ঘটনা কি এটুকুই। এই পরিবারে আসা থেকে ছয় বছর কেটে
গেছে সুনয়নার। এ গল্প তো শুরু অনেক আগে থেকেই। শেষটুকু আজ সবার সামনে।
সেই ছয় বছর
আগে, সেটাও
ছিল এক শীতের সময়। সুনয়না সুন্দর সাজানো গাড়ি করে পৌঁছেছিল শ্বশুরবাড়ি। বিলাস
বৈভবে পূর্ণ ঘরে সে তখন যেন কোন স্বপ্নে
রাজ্যের বাসিন্দা। বাবার ছোট্ট ব্যবসায়ে সে এসব কিছুই দেখেনি। খুব খুশি ছিল
মেয়েটা। ফুলশয্যার সাজানো খাটে অপেক্ষায় ছিল স্বামীর। বয়সের অনেকটা পার্থক্য
দুজনের, ভেবেছিল
খুব আদরে আহ্লাদে সোহাগে ভরিয়ে রাখবে তাকে। এত উপহার, অলংকার নয়। ওর
ছোট ছোট ছেলেমানুষী আবদারগুলো ভালবেসে আগলে রাখবে। ফুলশয্যার খাটেই কিছুক্ষণের
মধ্যেই সুনয়নার সব স্বপ্নগুলো বেআব্রু হতে থাকল তার সুসজ্জিত
শাড়ি গয়নার সাথে সাথে। একটা একটা অলংকারের সাথে তার
আবদারগুলো খাট থেকে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে থাকল। তার স্বামী মানুষটি মন, ভালবাসা বা
ইচ্ছের কোন ধারই ধারেন না। সৌমেন তার প্রবল শারিরীক শক্তিতে সদ্য ফোটা ফুলের মতো
শরীরটাকে পিষতে থাকে। কামনার উত্তেজনায় রক্তাক্ত হয় সুনয়না কিন্তু তার কোঁকিয়ে
ওঠা কান্না পৌঁছায় না সৌমেনের কানে। প্রবল শক্তিতে শরীরটাকে ভোগ করে একসময়
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment