প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Thursday, February 13, 2025

ফিরে এলাম | পারমিতা চ্যাটার্জি

বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/২তম সংখ্যা/২রা ফাল্গুন, ১৪৩১
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সংখ্যা | ছোটগল্প
পারমিতা চ্যাটার্জি
 
ফিরে এলাম

"সব তোমার প্রতিভাআমি কষ্ট পেতাম এত প্রতিভা সবই সংসারের হাঁড়িকুড়ির মধ্যে যাবেআমি কিছুই করতে পারব নানিজের কাছে নিজেকে অপরাধী লাগত জয়ী তাই তোমার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি এই পর্যন্ত।"


আজ অফিস থেকে ফিরবার সময় হঠাৎ অজয়ের মনে হল আসার সময় যেন জয়ীর মুখটা বড্ড শুকনো ছিল, 
অনেকদিন সে জয়ীর কাছে যায় না, প্রেম ভালবাসা সবই যেন সংসার আর কাজের চাপে উধাও হয়ে গিয়ে তারা একটা যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

 
অফিসে তাই মৃণালদা বলছিলেন যে সপ্তাহের অন্তত একটা দিন নিজেদের জন্য রাখা উচিৎ, বছরে একটা দিন এই যেমন বিবাহবার্ষিকী শুধু বউয়ের সাথে কাটাও, পার্টি তুমি তোমার ইচ্ছে মতন পরে দিও কিন্তু ওই বিশেষ দিনটা শুধু থাক-না বউয়ের জন্য। ওকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাও ওর জন্য শাড়ি কিনে দাও নিজে পছন্দ করে, ফুল কিনে আনো, ভাল কোথাও লাঞ্চ বা ডিনার করে বাড়ি ফেরোদেখো এই যে এই একটা দিনের যে স্মৃতি তা সারাবছরের অক্সিজেন
 
আর যাই হোক হাসিখুশি জয়ীকে তার মুখভার দেখতে ভাল লাগে না,  আজ দেখবে সে কী হয়েছে? সে-ও অবশ্য ইদানীং বাইরের জগৎ নিয়ে একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছে, রীতা তার অনেকটা সময় জোর করে তার থেকে ছিনিয়ে নেয়, অজয় জানে রীতা তার ভাল বান্ধবী, তার ডিভোর্সি একলা জীবন অজয়কে আঁকড়ে ধরেছে কিন্তু জয়ী তার সব, তার ভালবাসা তার সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী
 
এটা ভুললে চলবে না যে জয়ীর আত্মত্যাগ তার সংসারের জন্য অপরিসীম সে সরকারি কলেজের লেকচারার ছিল, বাবা-জ্যাঠার এককথায় সে চাকরি ছেড়ে দিল শুধু সংসারটাকে ভালবাসে বলে, তার বিশাল গানের কেরিয়ারও সে ছেড়ে দিল, না না অজয় তাকে কিছুতেই ঠাকাতে পারে না, আজ জয়ীর ম্লান মুখ তার বুকে বেজেছে, সে তার সন্তানের মা।
 
রীতা যখন এসে বলল,
-আজ কোথায় আমরা বসব?
সে তখন বলল,
-রোজ রোজ বসতে হবে কেন? আমি ফ্যামিলি ম্যান আমাকে আজ বাড়িতে যেতে  হবে
-তাহলে এতদিন আমাকে আশা দিলে কেন?
-আশ্চর্য কী আশা দিয়েছি তোমাকে? তুমিই বলেছিলে আমাকে কিছু কথা বলতে চাও, তাই একদিন বসতে রাজি হয়েছিলাম, তুমি সেটা রোজ করে দিলে, কফি থেকে ড্রিংকসে নিয়ে গেলে, কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়, আমি আমার সংসারকে ভালবাসি, আমার স্ত্রী-সন্তান বাড়ির গুরুজনেরা তাদের সবাইকে আমি খুব ভালবাসি, প্লিজ আর না তোমাকে অনেক সময় দিতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম, ভুলতে বসেছিলাম আমাদের সংসারের জন্য জয়ীর আত্মত্যাগের কথা
-কী আত্মত্যাগ করেছে শুনি? ও তো জাস্ট হাউজ ওয়াইফ, ও কি তোমার যোগ্য?
-ও আমার যোগ্য না আমি ওর যোগ্য এই প্রশ্নটাই নিজেকে করি এখন
-মানে?
-মানে বুঝতে গেলে তোমার সময় লাগবে, তুমি খুব সামান্য কারণে শ্বশুরঘর ছেড়ে এসেছ, তোমার স্বামী অনেকবার তোমাকে নিতে এসেছিল তুমি জেদ দেখিয়ে যাওনি, কী কারণ? না তুমি ওর ফ্যামিলির সাথে থাকতে চাও না, তোমার প্রাইভেসি থাকছে না, আর জয়ীর কথা শুনবে? ও এককথায় ওর সরকারি কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল আমার জ্যাঠামশাই পছন্দ করেন না বলে, নিজের বিশাল গানের কেরিয়ারও ছেড়ে দিয়েছিল, ও শুধু হাউজওয়াইফ নয় ওর ভিতরে থাকা গুণগুলো সব নিজের ভিতরেই পিষ্ট হচ্ছে, এতকিছু মানিয়ে ও সংসার করে যাচ্ছে সংসার ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে পারেনি, তুমি প্লিজ অন্য কাউকে দেখো, আমি ভেবেছিলাম তোমার জীবন অনেক কষ্টের অনেক কষ্ট পেয়ে তুমি সংসার ছেড়ে এসেছ তাই তোমার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু এখন দেখছি তুমি যে জন্য ঘর ছেড়েছ সেটা কোন কারণ নয়, আর তাছাড়া তোমার সঙ্গে দুদিন কফি খেয়েছি বলে তোমাকে ভালবাসি বা তোমার সাথে কোন রিলেশন তৈরি হয়ে গেছে তা তো নয়
-কিন্তু আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম
-কেন বেসেছিলে? আমি তো প্রথম থেকেই বলে দিয়েছিলাম যে কোনরকম ইমোশনাল বা আবেগের কথা আমার কাছে বলবে না, কারণ আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি আমার ফ্যামিলি সেখানে আমি কোনরকম স্যাক্রিফাইস করতে রাজি নই তা সত্ত্বেও তুমি কেন আমাকে আটকাবে? প্লিজ লিভ মি, তোমার ইমোশানে যারা সাড়া দেবে তাদের কাছে যাও
-এই তোমার শেষ কথা?
-হ্যাঁ এই আমার শেষ কথা আর আজ থেকে কোন কফিশপে বা ওয়াইন শপে আমাকে যেতে বলবে না
বলে অজয় স্পিডে গাড়িটা চালিয়ে দিল, হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল, দেখল বাড়ির ফোন, সে তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে বলল,
-আমি আসছি জয়ী, আমি আসছি
কিন্তু ওপাশ থেকে মিষ্টি গলায় রিমলি কথা বলে উঠল,
-বাবাই আমি রিমলি
-রিমু তুমি কী হয়েছে মা?
-তুমি কোথায়?
-আমি তো বাড়ি ফিরছি, তোমার মা ঠিক আছে তো?
-না বাবাই মায়ের খুব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে, এদিকে ঠাম্মি মায়ের জন্য পায়েস রান্না করেছে, বড় দাদু মায়ের জন্য কেক এনেছে, আজ তো মায়ের জন্মদিন তুমি ভুলেই গেছ
-না মা আমি ভুলিনি, আমি কখনও ভুলতে পারি? ভুলে গেলে আমার রিমি মা আমাকে ঠিক মনে করিয়ে দেবে, মা-কে বলো বাবাই এখনই আসছে।
অজয় সত্যি এই তারিখটা কী করে ভুলে গেল? প্রত্যেকবার জন্মদিনে তাজা হলুদ গোলাপ আর জয়ীর প্রিয় মিষ্টি এনে জয়ীর হাতে দিয়ে ওকে কাছে টেনে আদরে ভরিয়ে দেয় আর আজ কী করে এতবড় ভুল করে ফেলল? সে কি সত্যি রীতার দুঃখের কাহিনি শুনে ডুবে যাচ্ছিল? পরে ওর বরের কাছে আসল সত্যিটা জেনে নিজেকে শক্ত করে নিল, ভাগ্যিস ওর বর নিলয় এসে জানাল আসল কথাটা রীতা কোন উত্তর দিতে পারেনি, এমনকি নিজের দুবছরের ছোট ছেলেকে ছেড়ে আসতে এমুহূর্ত দেরি করেনি, ওর বর ওকে কোনদিন বেল্টের বাড়ি মারা তো দূরের কথা কোনদিন জোরে কথা পর্যন্ত বলেনি, সংসারটা ধরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, দোষের মধ্যে ওর বরের রোজগার ওর আশানুরূপ ছিল না আর শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে থাকবে না কিছুতেই, এটা শোনার পর অজয়ের মন বিষিয়ে উঠেছিল তারপরই সে ডিসিশন নেয়, না আর না এবার তাকে ফিরতে হবে।
 
দোকানে গিয়ে একটা সুন্দর শাড়ি কিনল, কিনল হলুদ তাজা গোলাপ আর ওর পছন্দের মিষ্টি তারপর বাড়ির দিকে রওনা হলবাড়ি পৌঁছে আগে স্ত্রীর কাছে গিয়ে তাকে দুহাতে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-আমাকে ক্ষমা করো, সত্যি আমি ডুবে যাচ্ছিলাম কিন্তু ঠিক সময়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। আমি ফিরে এসেছি জয়ী শুধু তোমার কাছেই ফিরে এসেছি আমার ভালবাসার কাছে
জয়ীকে তুলে দাঁড় করিয়ে ওর হাতে গোলাপের স্তবক তুলে দিয়ে বলল,
-শুভ জন্মদিন জয়ী
ওর কপালে চুম্বন এঁকে দিল তারপর বাইরে নিয়ে এসে কেক কাটা হল, পায়েস খাওয়া হল। বড় জ্যাঠামশাই বললেন,
-জয়ী মা আমি তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছিলাম আমি সব তোমাকে ফিরিয়ে দিতে চাই, তুমি আবার নতুন করে গানের জগতে ফিরে যাও আবার আরম্ভ করো
 
এর দুবছর পরে  জয়ীর সিডি বার হল অনেক বড় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অজয়ই সব দায়িত্ব নিয়ে ব্যবস্থা করল, তারপর আর জয়ীকে ফিরে তাকাতে হয়নি, জমজমাট হয়ে চলছে ওর গানের স্কুল, ফাংশন, একক সংগীতের অনুষ্ঠান। জয়ী হেসে বলল,
-সবই তোমার জন্য
-উঁহু সব তোমার প্রতিভা, আমি কষ্ট পেতাম এত প্রতিভা সবই সংসারের হাঁড়িকুড়ির মধ্যে যাবে? আমি কিছুই করতে পারব না? নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী লাগত জয়ী তাই তোমার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি এই পর্যন্ত।
জয়ী স্বামীর বুকে মাথা রেখে বলল,
-কজন স্বামী এভাবে ভাবে?
-ভাবা তো উচিৎ, শুধু নিয়েই যাব আর কিছু দেব না তা কি হয়? তবে তোমাকে আর একটা জিনিস দেওয়ার জন্য প্রস্তুত এখন নেবে কী নেবে না সে তোমার ব্যাপার
-কী দিতে চাও?
-রিমলির একটা ভাই বা বোন?
জয়ী লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলল, আর অজয় ওকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল
 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)