ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য
পিছুটান রয়ে যায়
[পর্ব – ৪]
"ফুঁপিয়ে ওঠে দিদিমণি। দুই চোখের কোল চিকচিক করছে, দিদিমণিকে ভীষণ চেনা মনে হয় কণিকার এই মুহূর্তে। এমন পরিস্থিতি অচেনা নয় কণিকার। বুঝতে পারে বেশ সন্দেহের চাবুকে রক্তাক্ত দিদিমণির হৃদয়।"
আজ নিজেদের
জীবন-তৌলে মাপতে চায় এই ফ্ল্যাটের জীবনকে। নিক্তির কাঁটার এদিক-ওদিক নেই বিশেষ। সন্দেহ-সম্পৃক্ত জীবন সতত জ্বালাময়। তবুও যেন ফ্ল্যাটের
দেওয়াল বন্দি জীবনের তফাৎ আছে বলে মনে হয় কণিকার। দাদাবাবু আর দিদিমণির মেপে বলা কথা কী দারুণ
অর্থবহ। এক শব্দের হাজার অর্থ। তাছাড়া ঘরের কথা আটকা পড়ে ঘরেই থাকে। বাইরের
পৃথিবীর কাছে অজানা,
তাতে অপরের কাছে সম্মানটা থাকে দুজনেরই।
কণিকা আর
যদুও কথা বলে, বেহিসাবি
সব, বেশিরভাগ
শব্দ বাড়ির বাতাস কাঁপিয়ে সীমানার বেড়া টপকে পাড়া-ঘরে আশ্রয় নেয়, আলোচনার খোরাক দেয় পড়শিদের। যদুর খিস্তি
অল্পবয়সি ছেলেদের মুখে মুখে ফেরে। বাড়ির বাইরে যেতে লজ্জা
পায় কণিকা, মেয়েটাও।
অসম্মানের বাকি থাকে না কিছু।
"কণিকা" ডাকে দিদিমণি। আচমকা ডাকে চমকে ওঠে। উঠে দাঁড়ায় কণিকা। "বসো বসো, ঘুম আসছে না, তাই ভাবলাম...।" বলে কণিকার পাশে বসে দিদিমণি। দৃষ্টি বাইরের আকাশের গায়ে। নীরবতার পালে বাতাস লাগে। নিঃশব্দে প্রবাহমান সময়ের ধারা।
এক সময় খুব নিচু গলায় দিদিমণি বলে, "মানুষ মানুষকে সন্দেহ কেন করে বলতে পার কণিকা?" এই প্রশ্নের ধাক্কায় বেসামাল কণিকা। এমন দার্শনিক প্রশ্নের ধার ও ভার দুটোই তার বোধের ওপারে। সন্দেহের ঝাপটায় ওলট-পালট কণিকার জীবন, সে কথা ঠারেঠোরে সত্যি। সন্দেহের আগুনে ভস্মীভূত দাম্পত্যের সুখ, ভুল নেই সে কথায়। তবুও, তবুও ভাষায় তাকে ধরার ক্ষমতা কণিকার নেই। গণেশের মায়ের কথাগুলো মনে আসে শুধু, "শোন বউ... সন্দেহ এক রোগ, আপনি আপনিই বাড়ে। তখন বাতাসে পাথর ভাসতে দেখে...।"
খানিক থেমে দিদিমণি নিজেই বলে, "এ বড় কঠিন প্রশ্ন জানো। সন্দেহ আসে, মনের মধ্যে ঘন ছায়া ফেলে দিনে দিনে। সেটা স্বামী বা স্ত্রী যে কারোর মনেই আসতে পারে। নিত্যদিনের সুখশান্তি কেড়ে নিয়ে এক জটিল ধাঁধা সামনে রেখে দুর্বিষহ করে তোলে জীবন। তবে সন্দেহ কেমন করে আসে, কেনই বা আসে আমি আজও বুঝিনি। ত্রিদিবকে নিয়ে তোমার দাদাবাবু...।" ফুঁপিয়ে ওঠে দিদিমণি। দুই চোখের কোল চিকচিক করছে, দিদিমণিকে ভীষণ চেনা মনে হয় কণিকার এই মুহূর্তে। এমন পরিস্থিতি অচেনা নয় কণিকার। বুঝতে পারে বেশ সন্দেহের চাবুকে রক্তাক্ত দিদিমণির হৃদয়। দাদাবাবু আর দিদিমণির সম্পর্কের বিশ্বাসের গ্রন্থি শিথিল হয়েছে। জীবন নীরস হয়ে উঠবে এইবার দিনে দিনে। সে ঊষর মরুময় জীবন অসহনীয় বড়, সেখানে না থাকা যায় না ভুলে যাওয়া যায়।
যদুর সঙ্গে তার নিজের সম্পর্ক সন্দেহের লেলিহান শিখায় ছারখার হয়েছে। আগুন লাগার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে শেষ হয়েছে সবকিছু। সব কিছু। ফ্ল্যাটে সে হবার নয়। এখানে সব কিছু ভীষণ নিখুঁত, পরিপাটি, পরিশীলিত। সাজানো গোছানো বিন্যস্ত। সন্দেহের আগুন এখানে শিখাহীন, আরক্ত নয়। তবুও কণিকা নিশ্চিত জানে যতকাল বাঁচবে সন্দেহের আগুন জ্বলতেই থাকবে ঢিমেতালে, পাশের ঘরের মানুষও জানবে না সেই নিদারুণ তাপের কথা।
"শুয়ে পড়ো রাত হয়েছে।" উঠে যায় দিদিমণি। এইবার বালিশে মাথা রেখে কাটবে নির্ঘুম রাত। সহস্র প্রশ্নের দাপটে উথালপাতাল মন। কখনও মনে হবে জীবন যদি নতুন করে শুরু করা যেত, যদি...।
বিছানায় বসে বাইরের আকাশ দেখে কণিকা। ভাবুক হয়ে ওঠে গভীর রাত্রির পরশে। আজ বুঝি সময়ের চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে চলে ভাবনা। নিজের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা কী ভীষণ জীবন্ত! এ যেন সন্দেহের ঘূর্ণিপাকে বেসামাল দাম্পত্য বন্ধন থেকে মুক্তিকামী সকল নারীপুরুষের অনিবার্য পরিণতি। দিদিমণি, দাদাবাবু, বাচ্চাটা সবার অনাগত দিন বর্তমান সময়ের গণ্ডি টপকে ধরা দিয়েছে কণিকার মনোজগতে। লোকচক্ষুর অন্তরালে দাদাবাবু আর দিদিমণির মনে যে তুষের আগুন এখন ধিকিধিকি জ্বলে সে বুঝি রাবণের চিতা, চিরবহ্নিমান। দুটি মানুষের জীবনভর একসঙ্গে থাকবার নশ্বর প্রতিশ্রুতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে একদিন শেষ হয়ে যাবে, নিশ্চিত। তখন দুটি ভিন্ন গ্রহের অচেনা মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবে দুজনে। আপন আপন কক্ষপথে আবর্তিত দুটি নিঃসঙ্গ জীবন। একলা চলার কৌশলও রপ্ত হবে ততদিনে, সময় শিখিয়ে দেবে সে আশ্চর্য কৌশল। তবে দিন শেষে একবার অন্তত পুরানো কথা ভিড় জমাবে মনে একমাত্র সন্তানের কথা ভেবে। আর আলোছায়ার চিত্রগুলি স্মৃতির গা থেকে খসে পড়ে ভেসে আসবে মন ক্যানভাসে। অতীত দিনের মুখোমুখি হতে বাধ্য হবে দুজনেই। সহজ সরল কঠিন প্রশ্নগুলি ব্যস্ত করে তুলবে দুজনকে কয়েক মুহূর্তের জন্য। থমকে দাঁড়িয়ে ভাবনা পা ফেলবে ফেলে আসা অতীতের উঁচুনীচু পথে। চড়াই উতরাই বেয়ে অলস পায়ে হেঁটে চলবে মন। কোনটি ঠিক, বেঠিকই বা কী ছিল সে অর্থহীন কথা ভেসে বেড়াবে ভাবনায়। সে বড় বিড়ম্বনার, দিদিমণি, দাদাবাবু একদিন বুঝবে। জীবনটা এমন না হলেও হতো, সে ব্যর্থ আপশোশ হাত রাখবে কাঁধে। বাঁচতে চেয়ে সান্ত্বনা খুঁজবে পরিশ্রান্ত মন। তবে এ বাস্তবতার হাত থেকে নিস্তার নেই কারো। সত্যি মানবজীবন বড় বিচিত্র! কত কিছু ছাড়তে চেয়েও মানুষ অসহায়, কিছু পিছুটান রয়ে যায়, রয়েই যায় চিরকাল।
No comments:
Post a Comment