বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/২৮তম সংখ্যা/২রা
ফাল্গুন, ১৪৩১
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সংখ্যা | ছোটগল্প
অমল
চ্যাটার্জী
প্রথম
ভালবাসা
"উৎকণ্ঠায় বুকের এসরাজে তত জোরে বেজেছে যুগল বন্দিশ, হঠাৎ পবিত্র দেখল ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে পরনে হালকা নীল রঙের শাড়ি, কোমর পর্যন্ত লম্বা একমাথা কালো চুল, মায়া ভরা দুটো চোখ, বেতের মতো চেহারায় যেন এক মহামানবী।"
মফস্সলের
একেবারেই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে পবিত্র, নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে
ছলচাতুরি তাকে কোনদিন স্পর্শ করার সাহস দেখায়নি, ফলে তার সহজ সরল জীবনে কোনদিন
ছন্দপতনও ঘটেনি। যদিও ভালবেসে দারিদ্রতার অক্ষত স্পর্শ বহু যত্নে রেখে গেছে তাদের
সংসারের আনাচেকানাচে। টানাটানির সংসারে বেশিরভাগ সময় তাদের নুন আনতে
পান্তা
ফুরোয়। ছোটবেলা থেকে মা ছাড়া সংসারে আর কাউকেই সেইভাবে আপন করে পায়নি। বাবা
বহুদিন আগে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করায় বুড়ি-মা আর পবিত্র এই নিয়েই তার ছোট্ট
সংসার। ধীর স্থির শান্ত প্রকৃতির একটি ছেলে পবিত্র, নিজের চেষ্টায় কলেজ জীবন শেষ
করার পর বেকার জীবনের নুড়ি ও পাথরে গড়া যন্ত্রণার অনেকটা পথ হেঁটে অবশেষে কলকাতার একটা
বেসরকারি সংস্থায় চাকরি পেয়ে তার বেকারত্বের জ্বালা ঘুচেছে। রোজ সকালে বাড়ি
থেকে অফিস আর রাতে অফিস থেকে বাড়ি এই হচ্ছে তার নিত্যদিনের কর্মসূচি।
এখন
মুঠোফোনের যুগ, সবার মতো পবিত্রও ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগ দিয়েছে। সেখানে
বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবও হয়েছে, তবে তারা বেশিরভাগই পবিত্রর অপরিচিত। পুরনো দিনের
গান বা রবি ঠাকুরের গান শোনা ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় পুরনো লেখাজোখার অভ্যাসটা
আবার নতুন করে ঝালাতে শুরু করেছে। বেশ ভালই লাগে এলেবেলে হয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায়
বহু নামডাকওয়ালা লেখক লেখিকাদের সাথে মিশতে ও মাঝেমধ্যে তাদের দু-একজনের সাথে
মেসেঞ্জারে কথাবার্তা বলতে। নিজের সামর্থ্যে ভর করে ও একটা আলাদা জগৎ বানিয়ে
নিয়েছে একেবারেই নিজের মতো করে।
পৃথিবীর
বুকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি নামে, সকাল হয়, দিন আসে আবার দিন চলেও যায়, তার
জীবনও চলছিল সময়ের ওই একই গতানুগতিক ধারায়। কিন্তু একদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় গল্প
পড়তে পড়তে বেশ সাজানো গোছানো সুন্দর একটা লেখায় তার চোখ আটকে গেল। খুব মন দিয়ে
পড়ছিল লেখাটা। নদীর জল যেমন তরতরিয়ে এগিয়ে চলে ঠিক সেইভাবে তরতর করে এগিয়ে
চলতে চলতে এক জায়গায় এসে হোঁচট খেল, থামতে হলো তাকে। বারবার পড়েও কিছুতেই
গল্পটার সাথে মেলাতে পারছিল না, তার মনে হলো কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে ওই
জায়গাটা। অনেক ভেবেচিন্তে মনের খচখচানির হাত থেকে রেহাই পেতে ব্যাপারটা ইনবক্সে
জানিয়ে অপেক্ষা করল উত্তরের আশায়, অনেক রাতে উত্তর এলো আমি ঠিক লিখেছি, হয়তো
আপনার বোঝার অসুবিধা। সে আবার মেসেজ করল ম্যাডাম আপনি ঠান্ডা মাথায় ওই জায়গাটা
আরেকবার দেখুন। উত্তর এলো আমি দেখেছি এবং বুঝেছি ওই জায়গাটা আপনার খুব মনে ধরেছে
তাই পারলে আপনি বারবার দেখুন সাথে একটা হাসির ইমোজি। হতাশ পবিত্র, মনের গভীরে বইছে
একটা চাপা কষ্টের স্রোত। কিন্তু কিছু করারও নেই, মনে মনে ভাবল যাকগে যা হবার হয়েছে
ওই নিয়ে আর চিন্তাভাবনা করে লাভ নেই, যার ভাবনা সেই ভাবুক। এইভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর হঠাৎ
একদিন সকালে মেসেঞ্জার খুলতেই চোখে পড়ল বেশ কয়েকঘন্টা আগে লেখা মেসেজের
জ্বলজ্বলে অক্ষরগুলো, "আমি দুঃখিত আপনি ঠিক বলেছেন"। বাঁধনহারা আনন্দে
পবিত্রর বুকটা গুড়গুড় করে উঠল, চোখে এলো জল। মামণির সাথে আলাপের শুরুটা এইভাবে।
মামণি
ঘোষাল, অমল ও বনলতা ঘোষালের একমাত্র সন্তান। বাবা বন দপ্তরের অফিসার, সেইহেতু
সংসারে অভাব কোনদিন মাথা গলায়নি। সবুজে ঘেরা বর্ধিষ্ণু গ্ৰাম কল্যাণপুরের ঘোষাল
বাড়ির সহজ, সরল মিষ্টি মেয়েটি সদ্য কলেজের গণ্ডি পার করেছে। পবিত্রর সাথে বেশ
কিছুদিন হলো তার চেনাশোনা, মানসিকতায় দুজনের ভীষণ মিল, সেইহেতু তারা খুব ভাল
বন্ধু হতে বেশি সময় লাগেনি, নিয়ম করে দিন রাতের বেশ কিছুটা সময় একে
অপরের পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা-মন্দলাগা, হাসিঠাট্টায় কেটে যায় মেসেঞ্জার বা
হোয়াটসঅ্যাপে আবার কখনও বা ফোনালাপে। এইভাবে যত দিন যায় ভাললাগা থেকে কখন যে
তারা দুজনে দুজনার অন্তরের খুব গোপন কোনো এক জায়গায় বাসা বাঁধার নাগরিকত্ব দিয়ে
ফেলেছে তা তারা নিজেরাই বুঝতে পারেনি। শয়নে স্বপনে তাদের মনের অতলে চলে সূক্ষ্ম
অনুভবে অবিরাম একটি ধ্বনির সুর, সে সুর ভালবাসার সে সুর হাতে হাত রেখে সামনে
এগিয়ে চলার।
ইতিমধ্যে
মা-গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে সমুদ্রে। আলতো শীতের স্পর্শমাখা এক হেমন্তের
বিকেলে তাদের প্রথম দেখা হলো রবীন্দ্রসদনে। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে
গিয়েছিল পবিত্র। চলতে থাকল অপেক্ষার দুঃসহ প্রহর গোনা প্রতিটা মুহূর্ত যেন মনে
হচ্ছে এক-একটা যুগের সমান। মাহেন্দ্রক্ষণের সময় যত এগিয়েছে উৎকণ্ঠায় বুকের এসরাজে
তত জোরে বেজেছে যুগল বন্দিশ, হঠাৎ পবিত্র দেখল ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে পরনে হালকা
নীল রঙের শাড়ি, কোমর পর্যন্ত লম্বা একমাথা কালো চুল, মায়া ভরা দুটো চোখ, বেতের
মতো চেহারায় যেন এক মহামানবী। মামণি ভীষণ পরিপাটি করে আজ নিজেকে সাজিয়েছে।
ভ্যাবলার মতো ড্যাবড্যাব করে একধ্যানে মামণিকে দেখে পবিত্র যেন নিজের মধ্যেই
নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। তার কাছে সেই মুহূর্তটা ছিল একটা অন্যরকম অনুভূতি। মামণি
বুঝেছে পবিত্র ক্যাবলা হয়ে গেছে, এক গাল হেসে তার নাক টেনে দিতেই সম্বিত ফিরে
পেয়ে যেন পর্বতশিখর থেকে সমতলে নেমে এলো পবিত্র। প্রথম দেখায় ভালবাসার মানুষটাকে
আজ আপন করে পেল তারা দুজনে, পূর্ণতা পেল বহুদিনের অপেক্ষা।
বিধাতার
সৃষ্টি এক অমলিন হাসি আর সাথে আনা গোলাপ দিয়ে মামণিকে স্বাগত জানাল পবিত্র। একতারার
পাশে খোলা আকাশের নীচে একটা জায়গা দেখে এই প্রথম একদম কাছাকাছি একদম পাশাপাশি
হাতে হাত রেখে বসেছে দুজনে। মনের কথা বলার জন্য বুকের গুপ্ত কুঠুরিতে কত কথা
একসাথে ভিড় করে হৃৎস্পন্দনটাই বন্ধ করার জোগাড় করেছে। অথচ দুজনেই চুপচাপ। যেন
নীরবতার একফালি কালো মেঘ তাদের ঢেকে রেখেছে। শুধু স্পর্শের তিলক এঁকে মাতোয়ারা
করছে দুজনকে দুজনের শরীর। গুণগুণ করে একটা গান ধরে নীরবতা ভাঙল
পবিত্র, গান শেষ হতেই বিস্ময় খেলে গেল মামণির চোখে-মুখে, কী সুন্দর সুরেলা গলা,
মামণির দুচোখে উপচে পড়ছে খুশির অশ্রু। এদিকে দূরে পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে শেষ
বিকেলের আমন্ত্রণে সূর্যদেব আজকের মতো দিনান্তের ঘন্টা বাজাতে ব্যস্ত, ঘরে ফেরা
সাদা বকের ডানায় আটকে আছে আকাশের বুকে রেখে যাওয়া গোধূলির শেষ আগুন পোড়া রং।
তারা
জানে পরস্পরকে বিশ্বাস, ভালবাসা, শ্রদ্ধার মধ্যে নিহিত থাকে সুখী দাম্পত্য জীবন।
কাঁধে ওই সংকল্প, চোখে হাজারো স্বপ্নের বাসা বাঁধা ভ্রুণ নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে
চলে তারা নতুন জীবন গড়ার লক্ষ্যে। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িতে তাদের ব্যাপারটা
জানাল দুজনেই। নিজ বংশ মর্যাদা ও ঐতিহ্যের কথা ভেবে মামণির বাবা প্রথমে মানতে না
চাইলেও যুগ পরিবর্তনের কথা ভেবে ও একমাত্র মেয়ের মুখ চেয়ে মেনে নিলেন ব্যাপারটা।
অবশেষে দুই বাড়ির আলোচনায় পাঁজিপুঁথি দেখে ঠিক হলো বিয়ের দিন। সাজানো গোছানো
নানারকম ব্যস্ততার মধ্যেই এসে গেল বহু প্রতীক্ষিত সেই দিন। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান
ঘটিয়ে শুভ দিনের নির্ঘন্টে আলোর রোশনাই সানাইয়ের সুর ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে
মামণির সিঁথিকে নিজের হাতে রাঙিয়ে পবিত্র পূর্ণতা দিল তাদের ভালবাসা।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment