ধারাবাহিক উপন্যাস
পারমিতা চ্যাটার্জি
শেষ থেকে শুরু
[পর্ব – ১৬]
পারমিতা চ্যাটার্জি
শেষ থেকে শুরু
[পর্ব – ১৬]
"আমি চোখের ভাষা পড়তে জানি, তুই জানিস না, তুই বুঝতেই পারিস না যে সুচরিতা তোকে কতটা ভালবাসে, আর মনকলি আমাকে। কারণ মনকলি চাকচিক্য ভালবাসে, আর সুচরিতার নরম মন তোর মতন সহজ সরল ছেলেকে ঠিক চিনে নিয়েছে।"
পূর্বানুবৃত্তি খুব সকাল সকাল বউয়া আর
সুচরিতা বেরিয়ে এল পুরুলিয়ার পথে। সুচরিতা
তার কাঙ্ক্ষিত
ভালবাসা ফিরে পেয়ে ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাসে হই হই করে বলে উঠল, কী অপূর্ব বউয়াদা কী অপূর্ব! গাড়ি থেকে নেমে রাহুলের
গা ঘেঁষে দাঁড়াল, রাহুলের খুব মধুর লাগল সে এক হাতেই
সুচরিতার কাঁধটা জড়িয়ে ধরে বলল, একটু ছবি তুলি?
তারপর…
সুচরিতা
রান্নাঘরে ঢুকে লাখিয়াকে ডেকে বলল, তোমার পোস্ত, ডাল, গরম মশলা গুঁড়ো এসব কোথায়
আছে?
-তোমাকে একটা লিস্ট করে দিচ্ছি, লিস্ট অনুযায়ী সব নিয়ে আসতে পারবে?
লাখিয়া লিস্টটা হাতে নিয়ে যেতে গেলে সুচরিতা পিছু ডেকে বলল,
সুচরিতা ভেতরে গিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বার করে ওর হাতে দিয়ে বলে দিল, তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো কিন্তু।
-হ হ ঠিক আসে, এই যামু আর আইমু।
সুচরিতা দ্রুত অভ্যস্ত হাতে কড়াই ডাল, ধুয়ে একদিকে প্রেসারকুকারে বসিয়ে অন্যদিকে পেঁয়াজ আর লঙ্কা দিয়ে পোস্ত বেটে খুব তাড়াতাড়ি আলু ঝিঙে কাটতে আরম্ভ করল, এর মধ্যে ফ্রিজ থেকে চিকেনটা বার করে টমেটো সস্ আাদা রসুন পেঁয়াজ বেটে আর একটু ভিনিগার দিয়ে ম্যারিনেট করে রেখে দিল। ডালে সিটি পড়ার পর পোস্তটা বসিয়ে আর একদিকে দুধ জাল দিতে বসাল। কিছু সুইট ডিস বানাবে বলে। দুটো ডিম বার করে রাখল। ইতিমধ্যে লাখিয়া এসে গেল।
লাখিয়া বলল, দেহ কাণ্ড আমি তো এঁধে রেকেচি ফের এই এত্যোখানি বেলায় আঁধতে কেনে?
কথা বলতে বলতে সুচি চিকেন কষাটা দমে বসিয়ে দিয়ে পোস্তটা নামিয়ে নিল। সকালের জন্য সেরকম কোন বাজার না থাকায় লাখিয়া পেঁয়াজ ধনেপাতা দিয়ে মুসুর ডালের চচ্চড়ি আর ডিমের ঝোল বানিয়ে ছিল। সুচরিতা খেয়ে চিকেন কষাটা নামিয়ে একটু পুডিং বানিয়ে ফেলল।
পাঁচটার সময় রাহুল বেশ কিলো দুয়ের সাইজের কাতলা মাছ আর আর মাছ নিয়ে এল। সুচি আগে থেকে চায়ের সাথে খাওয়ার জন্য ডিমের চপ বানিয়ে রেখেছিল। মোটামুটি আটটার আগে সব রান্না রেডি করে টেবিলে সাজিয়ে রাখল। দই কাতলা, আর মাছের ঝুরো করল। কয়েক পিস কাতলা মাছ একটু লেবুর রস, টমাটো পিউরি ধনে জিরে সমেত গরম মসলার গুঁড়ো দিয়ে মাছগুলো মাখিয়ে রাখল, খাওয়ার আগে ফ্রাইংপ্যানে সামান্য ঘি দিয়ে মাছগুলো ঢাকা দিয়ে ভেজে ফিস্ তন্দুরি গোছের করে দেবে।
তারপর নিজে খুব সুন্দর করে সাজল, অফ হোয়াইটের ওপর চওড়া পিঙ্কের কাজ করা শাড়ি, তার সাথে ম্যাচ করা গয়না, একরাশ চুলের এলোখোঁপা করে ফুল জড়িয়ে নিল। চোখের কোলে হালকা কাজল বড় টিপ আর হালকা পিঙ্ক রঙের লিপস্টিক। শুধু এইটুকু সাজেই তাকে অপূর্ব স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছিল।
রাহুল বলল, সুচি আজ তোকে এত সুন্দর লাগছে যে চোখ ফেরাতে পারছি না রে।
-ওকে ওকে সরি সরি আর গাল ফোলাতে হবে না।
-তাহলে আমিও তুই বলব যাহ্।
-আরে নামিয়ে দাও, আমার সাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না?
একটু পরেই স্যার এসে গেলেন। সুচরিতাকে দেখে স্যার তো হই হই করে উঠলেন, 'এ যে আমার সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী' তাহলে বিয়ে তো লেগে গেল, আমি তো বিহারি পুরুতের সাথে কথা বলে এলাম।
রাহুল খুব উৎসাহিত হয়ে বলল,
সুচরিতা বলল,
প্রিন্সিপাল স্যার মোটামুটি রাহুলের সাথে আলোচনা করে যা জানালেন তা হল আজ সোমবার সামনের মঙ্গলবার বিয়ের তারিখ। বিহারি পুরুতই মালাবদল করিয়ে সিঁদুরদান করিয়ে দেবেন, তাছাড়া রেজিষ্ট্রেশন তো আছেই।
-চলে গেলাম লণ্ডনে। মনপ্রাণ ঢেলে পড়াশোনা করলাম নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটি থেকে। আবার এমএ কমপ্লিট করলাম, রেজাল্ট এবার খুবই উচ্চমানের। পিএইচডি কমপ্লিট করলাম। নটিংহ্যামেই বছর দুই পড়ালাম। তারপর বাবার ডাক পড়ল, শরীর খুব খারাপ, "একবার ঘুরে যা, অনেকদিন তোকে দেখিনি"। মা অনেক ছোটবেলায় মারা গেছেন বাবা-ই বুকে আগলে বড় করেছেন। বাবার ডাকে আর না এসে পারলাম না। ভাগ্যিস এসেছিলাম স্যার।
ওদের কথার মাঝখানে সুচরিতা এসে গরম ডিমের চপ আর স্যালাড, চা দিয়ে গেল। রাহুল ডেকে সুচরিতাকে বসতে বলল। স্যার ডিমের চপ একটা তুলে নিয়ে কামড় বসাল, রাহুল নিজেও একটা নিল আধখানা ভেঙে সুচরিতার হাতে দিল। রাহুল আর স্যার দুজনেই একসাথে বলে উঠলেন বাহ্ অপূর্ব চপটা হয়েছে তো!
-তুমি কিন্তু তা বলে আমার লক্ষ্মীকে দিয়ে একদম রান্না করাবে না।
-না একদম নয় স্যার, তারপর স্যার বিশ্বভারতীতে ফিরে এসে আপনার মা লক্ষ্মীর দেখা পাই, ওর চোখে তখনই আমার জন্য ভালবাসা আবিষ্কার করলাম, প্রতিদিন রান্না করে আমার জন্য লাঞ্চ নিয়ে আসত, আমি বুঝলাম গভীর ভালবাসা না থাকলে এ বোঝা কেউ স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেয় না। আমি তখনও দ্বিধাগ্রস্ত, নতুন করে কাউকে ভালবাসতে ভয় করছে, অথচ বুঝতে পারছি যে সজলের কথাটাই ঠিক। বছর ছয়েক আগে বিজয়া সম্মেলনে সুচির মুখের দিকে তাকিয়ে গান গেয়েছিল, "হয়তো তোমার জন্য," আমি যখন সজলকে বলতে গেলাম, আমি কি সুচরিতাকে বলব, তোর কথা?
-কেন এভাবে বলছিস?
-অনেকদিন সবার জন্য করতে গিয়ে নিজেকে সবচেয়ে বেশি ঠকিয়েছি। আর অবহেলায় দিন গেছে আমার, আমার জন্য পথ চেয়ে থাকা সুচরিতার। এরপর যখন আমি বুঝতে পারলাম আমিও সুচরিতাকে ভালবেসে ফেলছি তখন ভেতরের একটা ভয় থেকে আবার পুরুলিয়ায় চলে এলাম সুচরিতার ভালবাসাকে অগ্রাহ্য করে, বড্ড বোকা আমি, সবাইকে এক পাল্লায় বসে বিচার করতে যাই, তাই ভুল হয়ে যায়। পুরুলিয়ায় কিছুদিন যাবার পর সুচরিতার জন্য ছটপট করতে লাগলাম, মনে মনে নিজের সাথে নিজেই ঝগড়া করতে লাগলাম, যে আমার জন্য এক পৃথিবী ভালবাসা নিয়ে অপেক্ষা করেছে, এত যত্ন করল এতদিন ধরে তাকেই কষ্ট দিয়ে আমি চলে এলাম। এইভাবে ছমাস যাবার পর রিহার্সালে গান করতে হবে বলে ওকে জোর করে নিয়ে এলাম, তারপর আমাদের এই সংসার চলছে, বিয়ে তো একটা বাহ্যিক নিয়ম।
-ঠিকই তো, এক কাজ করতে পার তোমরা রেজিষ্ট্রেশনটা কাল সেরে রাখতে পার, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
তারপর খাবার খেয়ে তো স্যার উচ্ছসিত,
ইতিমধ্যে রাহুলের সাথে মনকলির ব্যাপারে সমস্যার কথাও হয়ে গেছে, স্যার বললেন,
স্যার রুমালে মুখটা মুছতে মুছতে বললেন ক্যাটারারও বুক করেছি তবে মেনু তো তোমরা ঠিক করবে।
-কেন স্যার আপনিও বলুন না কিছু পছন্দমতন মেনু?
-হ্যাঁ সে তো একশোবার।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment