বাতায়ন/দহন/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
দহন | ছোটগল্প
তুষার ভট্টাচার্য
সম্পর্ক
"সমুদ্র-পল্লবী এখন পুরনো বাবা-মা, এবং বড্ড বেশিদিনের পুরনো। সেই জন্মাবার পর থেকেই একটানা সেই একইরকম একঘেয়ে মা-বাবা দেখে আসছিল তাদের ছেলে। বড্ড বাসি আর খুবই পানসে হয়ে গিয়েছিল সম্পর্কটা।"
সমুদ্র আর পল্লবী দুজনে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসেছে। হাতে হাত ঠিকমতো রেখে। সন্তান বলতে একমাত্র পুত্র তাদের। গভীর যত্নে তাকে বড় করেছে। তাকে সুশিক্ষিত হতে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাধ্যের শেষ সীমা ছুঁয়ে বাবা-মা দুজনেই চেষ্টা করে গেছে।
পুত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েই সে তার
নতুন বউ নিয়ে এসেছে। এব্যাপারে সমুদ্র ও পল্লবীর সম্মতি বা অসম্মতি কিছুরই প্রয়োজন
হয়নি। কারণ ছেলে, বউমা, আর বউমার মা-বাবা এই চারজন একটা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং
সেটা কার্যকর করার পক্ষে যথেষ্টই। পুত্র মসৃণভাবে সবকিছু ফাইনাল করে
বিয়ের তারিখটা অবশ্য সমুদ্র আর পল্লবী দুজনকে জানিয়ে দিয়েছিল।
ওদের আগেভাগে জানিয়ে সবকিছু
করলেও ওদের আপত্তির কোন কারণ ছিল না। থাকার কথাও নয়। যাইহোক ঠিকমতোই বিয়েটা হয়ে
গিয়েছিল। বিয়ের পর তাদের ছেলে শুধু যে একটা গোটা নতুন বউ পেয়ে গেছে, তা নয়। তাদের ছেলে এখন নতুন একজোড়া দুর্দান্ত ভালো বাবা-মা
পেয়ে গেছে। এই পৃথিবীর সবাই জানে নতুনের কদর আর আদর অনেক বেশি হয়।
সমুদ্র-পল্লবী এখন পুরনো
বাবা-মা, এবং বড্ড বেশিদিনের পুরনো।
সেই জন্মাবার পর থেকেই একটানা সেই একইরকম একঘেয়ে মা-বাবা দেখে আসছিল তাদের ছেলে।
বড্ড বাসি আর খুবই পানসে হয়ে গিয়েছিল সম্পর্কটা। এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা পুরনো
মা-বাবাদের ঠিকমতো মনে রাখা উচিত।
পদস্থ সরকারি চাকরি থেকে
অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ সমুদ্র তাদের সংসারের সম্পর্কের এই গহন পরিবর্তনের ব্যাপারটা
সবসময় মনে রাখে। কিন্তু পল্লবী সেই ব্যাপারটা ঠিকমতো মনে রাখতেই পারে না। ফলে
মাঝেমধ্যে সে সম্পর্কের নতুন সীমানা বুঝতে গোলমাল করে ফেলে। তাতে ছেলে-বউমা খুব বিরক্ত
হয়। তাদের ভাবনাচিন্তা নতুন ধরনের যুক্তিতে ভরা।
অনেক দিন ধরেই তো পল্লবীর একক
মা-গিরি ফলানো হল। সম্পর্কের এই হেরফের সময়মতো জানাটা প্রত্যেকেরই খুব দরকার।
অনেকটা শিক্ষিত বলে যথাসম্ভব ভদ্র ভাষাতেই ছেলে-বউমা প্রায়ই পল্লবীর প্রতি তাদের
রুক্ষ বিরক্তি প্রকাশ করে।
একবার উচিত-অনুচিত কিছু না
ভেবে পল্লবী খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ছেলে-বউমার বাড়তি অস্বস্তির কারণ হল। তাদের
অস্বস্তি আরও না বাড়িয়ে সমুদ্র প্রায় একাই তাকে নিয়ে এ ডাক্তার ও ডাক্তার করার পরও
সমস্যার সমাধান তেমন কিছুই হল না।
শেষপর্যন্ত পল্লবীকে
হাসপাতালে ভর্তি করতেই হল। ছেলে নিজের অফিস আর নানা জরুরি কাজে তখন খুব ব্যস্ত
ছিল। এইরকম ব্যস্ততার মধ্যে এই অ-জরুরি মায়ের জন্য আলাদা সময় সে কী করেই বা বের
করবে?
ষাটোর্ধ্ব সমুদ্র একা-একাই তার
একান্ত পেশেন্ট পল্লবীকে নিয়ে হাসপাতাল, পরীক্ষানিরীক্ষার জায়গা আর হাসপাতালের ডাক্তারের পিছুপিছু ছুটে হয়রান হতে
থাকল। ডাক্তাররা একবারে বা একেবারে বিশেষ কিছু বলেন না। কারণ তাঁরা হলেন ঈশ্বরের
মতো। ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে কবেই বা মুখফুটে কথা বলেছেন? ডাক্তাররা ঈশ্বরের মতো বলে মর্জিমাফিক হলেও তবু ছিটেফোঁটা
বলেন।
শেষপর্যন্ত জানা গেল পল্লবীর
খারাপ ধরনের হার্নিয়া হয়েছে। সেজন্য সার্জারি করতেই হবে এবং সেটা ঝূঁকিপূর্ণ
শুনে গভীর উদ্বেগে সমুদ্রের খাওয়া-ঘুম উবে গেল। চিকিৎসার জন্য আর্থিক সংস্থান তার
যতটুকু আছে তাতে মোটামুটি হয়ে যাবে বলে মনে হয়। তার ঊদ্বেগের কারণ অন্য। স্বামী
হিসেবে সে জানে পল্লবী স্বভাবে বড় ভীরু প্রকৃতির।
তার আর্ত মুখের ছবি তাকে
ক্রমাগত তাড়িয়ে নিয়ে চলল। আশঙ্কা আর বিষণ্ণতার গহনে একেবারে ডুবে গেল সে। পল্লবীর
চেয়ে তার চেহারাতেই রুগ্ণতার ছায়া অনেক বেশি করে পড়ে গেল। সমুদ্র ছেলেকে সার্জারির
ব্যাপারটা জানাল। বউয়ের সঙ্গে আলোচনার পর নিশ্চিন্ত ছেলে তাকে জানালো এই সার্জারি
সাধারণ ও নিতান্তই নিরাপদ। এই মামুলি সার্জারির দিনে সে অফিস কামাই করতে পারবে না।
কয়েকদিন পর সকাল দশটার দিকে
সার্জারিটা হল। সার্জারির শেষে চালু নিয়মমতো ‘পেশেন্ট বেঁচে আছে এবং সজ্ঞানে আছে’
সেটা সমুদ্রকে একবার দেখিয়ে নিয়েই পল্লবীকে দ্রুত আইসিইউতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। পরদিন
সকাল নটার পর পেশেন্টের সঙ্গে আবার দেখা করতে দেওয়া হবে বলে নার্স তাকে বিদায়
জানাল। ছেলে-বউমা অধ্যুষিত শূন্য বাড়িতে রাতে একা ফিরে এল সমুদ্র।
সমুদ্রের প্রায় বিনিদ্র এবং
অভুক্ত সেই রাতটা অনেক দীর্ঘতায় শেষ হল। পরদিন সকাল নটাতেই কলকাতার হাসপাতালে
পল্লবীর কাছে পৌঁছে গেল সে। কড়াকড়ি নার্স খুব তাড়াতাড়ি খুব অল্পকথায় দেখা-করা শেষ
করার নির্দেশ দিল।
‘কেমন আছ পুলু? রাতে খেয়েছিলে তো? ভালো করে ঘুমাতে পেরেছিলে? কোন কষ্ট হচ্ছে না তো?’
‘মোটামুটি ভালো আছি এখন। খোকা কেমন আছে? আমার কথা ভেবে ভেবে হয়তো তার নাওয়া-খাওয়ার কোন ঠিক নেই।
আমার অপারেশনের চিন্তায় গতরাতে সে ভালো করে ঘুমিয়েছে কিনা কে জানে! ওর দিকে তুমি
একটু খেয়াল রেখো। তাকে বোলো সে যেন সময়মতো ভালোভাবে খাওয়াদাওয়া করে আর তার
শরীর-স্বাস্থ্যের...’
বলতেই থাকল পল্লবী। উদ্বিগ্ন
পল্লবীকে তার ছেলের কথাগুলো সব বলতে দিয়ে সমুদ্র চুপ করে থাকল। খুব অল্প সময়ে
দেখা-করা শেষ করতে হবে, নার্সের নির্দেশ আছে।
...খুব ভিতরের ক’ফোঁটা নিতান্ত অবাধ্য ক্ষীণোষ্ণ নোনাজল গড়িয়ে
গেল আরও ভিতরেই... গোপনে ...।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment