প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Monday, September 15, 2025

ভদ্রবেশী | অরূপ কুমার দেব

বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
অরূপ কুমার দেব
 
ভদ্রবেশী

"এই পরিবেশটাকে অসুস্থ বানিয়েছেন আপনারাই তো বাবু। আর আপনাদের মতোই কোন এক বাবুর সন্তানই হল সেই মেয়েটা যার শিক্ষার জন্য এত লড়াই করেছিলাম আমরা।"


চারিদিকে অট্টহাসি, রাস্তার ধারে পর পর সবাই দাঁড়ানো কাস্টমারের অপেক্ষায়। পরনে তাদের চুমকি দেওয়া ঝিকমিক করা শাড়ি, চুলে বেলি ফুল, হাতে কাচের চুরি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন এটা পতিতাপল্লি ছাড়া আর কোথায় হতে পারে।


-কী রে আজ তো সেইরকম কাস্টমার পাচ্ছি না।
-মনে হয় বাবুরা আজকাল খুব ভদ্দরলোক হয়ে গেছে।
হেসে হেসে বলে উঠল একজন, কিন্তু এই হাসি সাধারণ হাসির মতো না বেশ অন্যরকম।
-দ্যাখ দ্যাখ একজন আসছে ওটাকে ধরি।
যে আসছে সে হচ্ছে রতন শিকদার। তাদের স্কুলের মাঠে দুর্গাপুজোয় মা দুর্গার প্রতিমার জন্য মাটি নিতে এসেছে এই পতিতাপল্লিতে। তার অবশ্য আসার একটুও ইচ্ছে ছিল না কিন্তু কেউ আসতে চাইছে না বলে তাকেই বাধ্য হয়ে আসতে হলো।
মনে মনে ভাবছে রতন, কীরকম জায়গা রে বাবা! রাস্তার ধারে মেয়েগুলো কেমন করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পোশাক পরিবেশ তো একদম বাজে। ধুর, আমারও মাথাটা গেছে। এরকম জায়গার পরিবেশ এর থেকে আর কেমনই বা হতে পারে।
-কী গো বাবু যাও কই? তোমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করছি যে।
ডান হাতে রঙিন কাচের বোতল, মুখে একটা সদ্য তৈরি করা পান গুঁজে একটা মাঝবয়সি মেয়ে বলে উঠল।
-হাব-ভাব দেখে মনে হল ওদের দলের লিডার হবে।
-আমি এখানে দুর্গা প্রতিমার মাটি নিতে এসেছি।
-সে নেবে ‘খন। তার আগে একটু যদি এদিকে আসো।
-কী বলছেন কী? আমি একজন কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে চাকরি করা মানুষ। আমাকে এসব কুপ্রস্তাব দেন কী করে?
-তোমাদের মতো কত ওরকম শিক্ষিত উঁচু মানুষ দিন শেষে আমাদের কাছে এল আর গেল, সবই দেখলাম গো বাবু।
পাশ থেকে হঠাৎ করে একজন বলে উঠল,
-দিদি এইটা সেই বাবুটা গো।
-কোনটা বল তো!
-আরে সেদিন চম্পার মেয়েকে ইস্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে কত গোল বাধল সেদিন এই বাবুটা ওখানে ছিল।
-তাই ভাবি মুখটা কেন চেনা চেনা লাগছে।
রতন বলল,
-সত্যি আপনারা সেদিন যা ঝামেলা করছিলেন, একটু লজ্জা থাকা দরকার।
-কীসের লজ্জা বাবু? শিক্ষার তো কোন লজ্জা থাকা উচিত না।
-শিক্ষার নয়। কিন্তু আপনারা যে পরিবেশে থাকেন সেটা কোন সুস্থ পরিবেশ না। এখানে শিক্ষা বিলাসিতা মাত্র।
-এই পরিবেশটাকে অসুস্থ বানিয়েছেন আপনারাই তো বাবু। আর আপনাদের মতোই কোন এক বাবুর সন্তানই হল সেই মেয়েটা যার শিক্ষার জন্য এত লড়াই করেছিলাম আমরা।
-দেখুন আমাদের একটা মানসম্মানের ব্যাপার আছে। তাই সেদিন স্কুল কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি আর আমরাও ক্লাবের সদস্যরা স্কুলকে অনুমতি দিতে পারিনি মেয়েটার পড়াশোনার জন্য।
-প্রচুর মানসম্মান দেখাচ্ছেন যে! আপনাদের ক্লাবেরই একজন দিন শেষে আমাদের কাছেই আসে। তাহলে তখন মানসম্মানের কী হয়? শুধু রাতের শেষে আসে তো তাই কেউ দেখতে পায় না বলে মানসম্মান নিয়ে কোন অসুবিধা হয় না, তাই তো?
-ওসব কথা ছাড়ুন আমি মাটি নিতে এসেছি। মাটি নিতে দিন।
-যদি বলি দেব না। আপনারা যেমন মেয়েটার শিক্ষা আটকেছেন ঠিক তেমনি আমরাও আপনাদের দুর্গা পুজো আটকাব তাহলে কী করবেন? আর পতিতালয়ের মাটি ছাড়া দুর্গা মূর্তিও হয় না।
-আপনারা কী ভাবছেন এরকম করে মেয়েটার পড়াশোনা চালু করলে ও ভদ্র শিক্ষিত হয়ে যাবে? না হবে না। বড় হয়ে আপনাদের মতোই তৈরি হবে।
-অনেক বলে দিয়েছেন বাবু। এবার আমি বলি আপনি শুনুন। আপনারা কী ভাবেন বলুন তো আমরা অভদ্র, সারাজীবন এরকমই ছিলাম! আজ্ঞে না, আমরাও আপনাদের মতো ভদ্র সমাজের মানুষ ছিলাম। ওই সুখের জীবন ছেড়ে এই পথে আসতে বাধ্য হয়েছি। আপনাদের মতো ভদ্র সমাজের মানুষরাই আমাদের কাছে আপন মানুষের মতো অভিনয় করে বা কখনো কাজ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই পতিতাপল্লিতে বেচে দিয়েছে। আবার কখন নিজের সংসার বা পেট চালাতে নিজেরাই অতি কষ্টে এই পথ বেছে নিয়েছি। নাহলে আপনি বলুন দিনের পর দিন নিজের শরীরকে একটু একটু করে ক্ষতবিক্ষত করতে দেওয়া বাবুদের কামের তাড়নায় সেটা কেই বা চায়। আমরা সুখে নেই আমাদের অনেক কষ্ট কিন্তু আমরা মুখ বুজে সহ্য করি। আমরা না থাকলে আপনাদের বাড়ির মা, বউ, বোন, দিদিরা শান্তিতে ঘর থেকে বেরতে পারত না, ওই বাবুরা কামের তাড়নায় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। আর সবথেকে বড় কথা স্বয়ং দূর্গা মা’র মূর্তি তৈরি করতে আমাদের মতো পতিতালয়ের মাটি প্রয়োজন। যেটা পবিত্র বলে মনে করা হয় কারণ পবিত্র মাটি ছাড়া মা দুর্গার মূর্তি গড়া অসম্ভব সেখানে আমরা অপবিত্র কেন? আমাদের মেয়েরা শিক্ষার আলো পাবে না কেন? আমরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত কেন? আমরা তো কোন বাবুর কাছে যাই না তারাই আসে আমাদের কাছে তবুও সব দোষ আমাদের হবে কেন? যেসব বাবুরা কামের তাড়নায় আসে তাদের কি কোন দোষ নেই? দিনের বেলায় সেসব বাবুদের কাছেই আমরা বাজে, কলুষিত মেয়ে আবার রাতের বেলায় তাদের কাছেই আমরা অপ্সরা! আমরা তো শুধু নিজের শরীর বেচেছি। কিন্তু সেইসব বাবুরা তাদের মানসিকতাকেই বেচে দিয়েছে সেদিকে তো কারোর কোন খেয়াল নেই। সবাই সবকিছু জানে কিন্তু কারোর আমাদের পাশে থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বা বলার মতো কোন ক্ষমতা নেই। আসলে আমাদের জীবনটাই কেউ বুঝতে চায় না।
সব কথা শুনে রতন কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই প্রথম মেয়েটা তার হাত ধরে পাশের ঝুপড়িতে নিয়ে গেল। রতন আধ খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল কয়েকজন ছেলেমেয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছে।
-ভেতরে না হয় ঢুকলেন না বাবু। কিন্তু দেখুন এরাও তো রক্তমাংসের মানুষ। কেউ ফুচকা, কেউ ঘুঘনি, কেউ এগ রোল বিক্রি করে! সব্বাই আপনাদের অপেক্ষায় থাকে এইরকম উৎসবের সময়। ছোটছোট দোকান, ছাউনি, অথবা নিপাট খোলা আকাশের নিচে। ধারদেনা করে সম্ভার সাজায়। শুধু আপনারা, আপনারা আসবেন এই আশায়। এরা কেউ স্কুল কলেজের শিক্ষক, অধ্যাপক নন। মহামান্য আদালতের বিচারপতিও নন। সরকারি, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীও নন যে প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে মোটা টাকার মাইনে ঢুকে যাবে। বিশ্বাস করুন, এদের আর কোন আগামী নেই, নেই কোন ভবিষ্যৎ। প্রতিটা দিন বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ। না, এদের করোনা হয় না। হলেও টের পান না। এরা অনাহার, অপুষ্টিতে মরে। বেকারত্বের জ্বালায় মরে। জনস্বার্থের প্যারামিটারে এদের ধরা হয় না৷ মরে পচে হেজে ভেজে গেলেও এদের মৃত্যুর হিসেব রাখা হয় না। মাটি, শোলা, পিচবোর্ড দিয়েও যে মা’কে চিন্ময়ী করে তোলা হয়, এবার ওই দেখুন মা দুর্গা! আপনার জন্য বাহারি পানের দোকান সাজাবে রা! আর ওই যে কার্তিক, এগ রোলের দোকান দেবে! আপনার জন্যই অপেক্ষা করবে। তবে একটু মানিয়ে নিতে হবে। ওর ময়ূর পোষার ক্ষমতা নেই। দেশি মুরগি থাকতে পারে৷ আর ওই যে মা লক্ষ্মী! দেখতে পাননি! আরে ওই যে ছেঁড়া, আধময়লা ফ্রক। আর ওই যে গণেশ! ঝালমুড়িটা যা বানায় না! একবার চেখে দেখবেন! ও স্কুলে পড়ত। বাবার কাজটা চলে যাওয়ার পর কৌটো ধরেছে৷ আর ওই যে সরস্বতী! মাস্ক, স্যানিটাইজারের ছোট্ট দোকান! ফুটের পাশে আপনাদের মণ্ডপের ঠিক সামনেই। ফাইবারের টেবিল, গোটা দুই দড়ি৷ নিন না গোটা দুই মাস্ক। এক বোতল স্যানিটাইজারও কিনতে পারেন। আহা, ব্যবহার নাই করলেন। দুটো পয়সা পাবে তো ছোট্ট মেয়েটা৷ জানেন, ও আবার ভিক্ষা করতে পারে না। সরস্বতী বলে কথা। মাস্ক পরেনি বলে ওকে আবার বকবেন না যেন! খিদে পায়, রাক্ষুসে খিদে। বাবু কাকে খুঁজছেন? বাবা ভোলানাথ? ওই যে টেবিলের কাছে! সেলুনের কাজটা তার গেছে! এখন কচুরি ভাজে। করোনার সময় সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং না মেনে মণ্ডপের কাছাকাছি চলে এসেছিল। বেদম মার খেয়েছে। ওই দেখুন পিঠে দাগ এখন আছে। কী ভাবছেন! এত সবকিছুর পরেও তাদের পড়াশুনা করার অভ্যেসটা চলে যায়নি। তারা মনপ্রান দিয়ে চায় সমাজে মাথা উচু করে বাঁচতে। আর এর জন্য তারা স্কুলে যেতে চায়। যার জন্য আপনাদের মতো শিক্ষিত সমাজের অনুমতির প্রয়োজন হয়।
রতন পুরো চুপ করে গেল। কথাগুলো ঠিক তার মনে এসে আঘাত করল। সত্যি তো মেয়েটা কিছু ভুল বলেনি‌।
রতন নরম সুরে বলে উঠল,
-আমি দের পড়াশোনা নিয়ে ক্লাব আর স্কুলের সাথে কথা বলব যদি কিছু করা যায়।
-না বাবু, তার আর কোন দরকার নেই।
-কেন?
-আপনাদের সমাজেরই এক মহানুভব বাবু ওদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। আর যাওয়ার সময় মাটি নিয়ে যাবেন। আমরা কাউকে ফেরাই না আর তার উপর জগৎ জননী মূর্তি তৈরিতে মাটি না দেওয়ায় মতো অপরাধ কোনদিনই করব না।
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 10 (Last 7 days)