বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
তন্ময় পাল
মনোবাঞ্ছা
"বিক্রম শান্ত হয়ে মা দুর্গার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে মনে মনে প্রার্থনা করছে— চ্যাটার্জীদের বাড়িতে কালার টিভিতে মহালয়া দেখেছি। তুমি যেভাবে অসুরকে বধ করেছ তাতে আমার মনে হয় তুমি সবই পারো। আমার শুধু একটাই আবদার বাবার কারখানাটা খোলার ব্যবস্থা করে দাও।"
-তোকে অনেকক্ষণ থেকে খুঁজছি। তুই দুর্গা মন্ডপে যাবি না?
নির্মলের গলা পেয়ে বিক্রম পেছনে ঘুরে তাকায়।
-যাব তো। আমি তো তোদের অনেক আগেই সক্কাল সক্কাল চলে গেছিলাম, কেউ নেই দেখে আবার বাড়ি ফিরে এলাম।
-দাঁড়া একটু সুবিনয়,
প্রশান্ত
আর বাকি সবাইকে ডেকে নিচ্ছি। আজ খুব মজা হবে।
কথা বলতে বলতেই নির্মল
বিক্রমের হাত ধরে বাকি বন্ধুদের হাঁকডাক করে সবাইকে জড়ো করে একসঙ্গে গ্রামের
দুর্গা মন্ডপে চলে যায়। ওরা সবাই প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস টু থেকে ক্লাস ফোর-এর মধ্যে
পড়ে। একসঙ্গে স্কুল যাওয়া থেকে শুরু করে ছুটির পর খেলাধুলা, দুষ্টুমি, মারামারি সব ওরা
একসঙ্গেই করে। গ্রামের সবাই মজা করে ওদেরকে বলে পুঁচকে গ্যাং।
এদের মধ্যে সবার হাতেই নতুন
খেলনা বন্দুক বা ক্যাপ আছে ব্যতিক্রম শুধু বিক্রম। সেটা লক্ষ্য করে দলের পান্ডা
নির্মল ওকে বলল,
-কী রে ক্যাপ নিয়ে আসিসনি?
-আমার ক্যাপ ফাটাতে ভাল লাগে না, সেই একইরকম শুধু আওয়াজ। আর বেশি আওয়াজ করলে এখানে বড়রাও
তো বকবে।
বন্ধুকে যা হোক একটা অজুহাত
দিয়ে মনের ভেতরের কষ্টটা চেপে রাখে বিক্রম। আসলে কয়েক মাস ধরে বাবার কারখানা
বন্ধ। মা বলছিল হয়তো কারখানা কোনদিন খুলবে না, অন্য কাজ খুঁজতে বাবা মরিয়া। সংসারে বড্ড অভাব। বয়সে ছোট হলেও অভাব মানুষকে
অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। তাই অন্য বাচ্চাদের মতো বাবার কাছে আবদার করার সাধ্য ওর
নেই। এমনকি এবারের পুজোতে এখনও নতুন জামা,
প্যান্ট
পর্যন্ত ওর হয়নি। গত বছরের কেনা জামা-প্যান্ট পরেই হয়তো
ঠাকুর দেখতে বেরতে হবে। অবশ্য একটা আশা আছে। আগামীকাল অষ্টমীর দিন মামা নতুন জামা-প্যান্ট নিয়ে আসতে পারে। মামারবাড়ি থেকে এরকমই একটা চিঠি কয়েকদিন আগে
এসেছে। সেই আশাতেই বুক বেঁধেছে বিক্রম। হয়তো জামা-প্যান্টের
সঙ্গে নতুন ক্যাপও জুটতে পারে।
গ্রামের দুর্গা মন্ডপে ছোট
বড় সবাই জড়ো হয়েছে। অনেক মানুষ কাজের সূত্রে বাইরে থাকেন তারাও অন্তত পুজোর
সময়টা গ্রামে সবার সঙ্গে ছুটি উপভোগ করেন। ইতিমধ্যে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে আনা
হচ্ছে, সপ্তমীর পুজোর প্রস্তুতি
প্রায় সম্পূর্ণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুজোপাঠ শুরু হয়ে যাবে। আশেপাশের বন্ধুদের
উচ্ছ্বাস লাফালাফিতে মন উদাস। বিক্রম শান্ত
হয়ে মা দুর্গার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে মনে মনে প্রার্থনা করছে— চ্যাটার্জীদের বাড়িতে কালার টিভিতে মহালয়া দেখেছি। তুমি
যেভাবে অসুরকে বধ করেছ তাতে আমার মনে হয় তুমি সবই পারো। আমার শুধু একটাই আবদার
বাবার কারখানাটা খোলার ব্যবস্থা করে দাও। আমার নতুন জামা-প্যান্টের
দরকার নেই, কোনও বন্দুকেরও
দরকার নেই। তুমি সব পারো, তুমিই পারবে।
-বাবা তুমি ঘুম থেকে উঠবে না? দেখো না মা! বাবাকে সেই থেকে ডাকছি,
একদম
উঠছে না আর কী সব উলটোপালটা বলছে।
মেয়ের ধাক্কায় এতক্ষণে হুঁশ
ফিরে ঘুম থেকে উঠলেন বছর ৩৬এর বর্তমানে বড় প্রাইভেট ব্যাংকের ম্যানেজার বিক্রম
রায়। এতক্ষণ তাহলে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। একটু নিজেকে সামলে ঢোক গিলে কিছু বলতে
যাবার আগেই তাঁর স্ত্রী সামনে এসে হাজির।
-তুমিই বলেছিলে মহালয়ার দিন খুব ভোরে উঠে মোবাইলে মহালয়া
শুনতে হবে। কাল রাতে খুব খোঁটা দিচ্ছিলে আমি নাকি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে পারি
না। অথচ আমি, মেয়ে দুজনেই রেডি আর তোমার
কোনও পাত্তা নেই। আর ঘুমের মধ্যে কী এত বিড়বিড় করে
বলছিলে?
-কিছু না, একটু স্বপ্নে বিভোর
হয়ে গেছিলাম।
-স্বপ্ন! তুমি আবার এই বয়সে কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছ গো? তাহলে তো আমার কপালে দুর্গতি আছে।
স্ত্রীর রসিকতায় কিছুটা
লজ্জা পেয়ে বিক্রম বলে,
-তুমি আর মেয়ে রিমি ছাড়া আর কে আছে আমার স্বপ্ন দেখার? তবে আজকের স্বপ্নটা সম্পূর্ণ আলাদা, খুব ইন্টারেস্টিং। পরে আমি বলব, একটু ফ্রেশ হয়ে নিই। তুমি ততক্ষণে ফোনে প্রসার ভারতীর
অ্যাপটা অন করো।
বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে
যাওয়ার সময় বিক্রম রায় ভাবতে থাকেন গতকাল কাজ শেষে যখন বাড়ি ফিরছিলেন তখন তাঁর
পুজোতে গ্রামে কাটানো ছেলেবেলার কথা, বাবা-মায়ের কথা বড্ড
মনে পড়ছিল। বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। হয়তো মা
দুর্গাই এই মহালয়ার পুণ্য লগ্নে তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য ২৭-২৮ বছর আগের
নয়ের দশকের শেষের দিকে কোনও এক দুর্গাপুজোর সপ্তমীর সকালে পৌঁছে দিলেন। এ যেন কোনও গল্পে পড়া বা সিনেমায় দেখা টাইম ট্রাভেল করার মতো
ঘটনা। শত অভাব, কষ্ট থাকা সত্ত্বেও
সেই দিনগুলো সত্যি সুখের ছিল। জীবনে প্রায় সবকিছু প্রাপ্তি হওয়ার পরেও
ছেলেবেলায় কাটানো শারদোৎসবের সেই আবেগ,
উন্মাদনা
হয়তো আর কোনদিন পাওয়া যাবে না।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment