বাতায়ন/নৃপেন
চক্রবর্তী সংখ্যা/ধারাবাহিক উপন্যাস/৩য় বর্ষ/২৯তম সংখ্যা/১৪ই কার্ত্তিক, ১৪৩২
নৃপেন চক্রবর্তী সংখ্যা | ধারাবাহিক
উপন্যাস
অজয় দেবনাথ
মউ
[৭ম পর্ব]
Statutory warning.
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। Smoking is harmful to your health.
অ্যালকোহল সেবন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। Alcohol consumption is harmful to your health.
"না বায়োলজিক্যাল সেক্স নয়, নয় তার কাপুরুষতা। এ তার আদর্শ, মূল্যবোধ। শুভ্রার মতো সাড়া জাগানো সুন্দরী বড়লোকের মেয়েরা হয়তো বুঝবে না।"
পূর্বানুবৃত্তি আদর করে শুভ্রাকে অনন্যা বলে মনে
হল সুখের। শুভ্রা উত্তেজিত হয়ে শুধু অন্তর্বাস পরে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পেতে চাইল সুখের সঙ্গ। সুখ
বিয়ের আগে আর চাইল না। তারপর…
সুখের মন মুহূর্তেই নিজের
ছোটবেলায় চলে গেল… বাবার কথা মনে এলেই মনটা শূন্য হয়ে যায়, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা
লাগে। কতদিন বাবার কথা ভেবে সে নীরবে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছে। কিচ্ছু ভাল লাগত
না। স্কুলে, খেলার মাঠে বা কোনও পুজোপার্বণে যখন বন্ধুদের বাবারা তাদের নিতে আসত
কিংবা শাসন বা আদর করত তার চোখ ফেটে জল আসত, বুক ফেটে যেত চাপা কান্নায়, সে সকলের
অলক্ষ্যে চলে যেত নির্জনে যাতে কেউ তাকে খুঁজে না পায়। কতদিন সে এভাবে বসে থেকেছে
মাঠেঘাটে, বাঙরের ধারে, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধুই বাবার কথা ভেবেছে। মনে মনে,
একা একা বাবার সঙ্গে কাল্পনিক কথা বলেছে। তার বিশ্বাস ছিল বাবা নিশ্চয়ই ওপর থেকে
তার কথা শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে তার মনের ব্যথা। পরে অনেক বড় হয়ে বুঝেছে যে চলে
যায় সে চলেই যায় আর কখনই ফিরে আসে না, তার ফিরে আসার রাস্তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
মা কত পরিশ্রম করেছে তাকে মানুষ
করার জন্য, তার সঠিক শিক্ষার জন্য, সে যাতে একটু ভাল থাকে তার জন্য। এই বড়ি দিচ্ছে
তো এই আচার তৈরি করছে, তারপর সেইসব জিনিস মহাজনের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। বাকি সময়ে
সেলাইয়ের কাজ, আসন তৈরি, কাঁথা সেলাই আর সেলাই মেশিনে জামাকাপড় সেলাই তো ছিলই,
এমনকি কাজের চাপ থাকলে রাত জেগেও মহাজনের কাজ সময় মতো জোগান দিয়ে গেছে শুধু তার
সুখকে একটু ভাল রাখার জন্য, তাও টেমির আলোয়, তখন ইলেকট্রিকের লাইন নেওয়ার মতো
অবস্থা ছিল না। আর তখন ইলেকট্রিকের যা অবস্থা! ঘনঘন লোডশেডিং নাহলে ভোল্টেজ ড্রপ,
তার থেকে টেমির আলোর বেশি জোর। অথচ বাবা যখন মারা যায় তখন কতই-বা বয়স মায়ের,
চাইলেই মা নিজের জীবনটা অন্যভাবে সাজাতে পারত। আসলে মায়েরা বোধহয় এমনই হয়।
ছোট থেকেই তখন বোধহয় ক্লাস
থ্রি-ফোর হবে, সে-ও মায়ের কষ্ট দেখে আর তাড়াতাড়ি বড় হবার ছোট-স্বপ্নের তাগিদে,
মায়ের হাতে হাতে কাজ করার চেষ্টা করেছে। মা করতে দিতে চায়নি বকাঝকা করেছে আবার
কাছে টেনে নিয়ে আদরও করেছে বাপ-মরা ছেলে কোথায় কোথায় আদাড়েপাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে ভেবে।
তার থেকে কাছে থাক, তার আদরের ছোঁওয়ায় থাক।
পড়াশোনায় ছোট থেকেই সে ভাল ছিল,
সবসময় যে পজিশন পেয়েছে তা নয় তবে প্রথম আট-দশের মধ্যেই সে থাকত। বাবা না থাকায় এবং
মায়ের এই কষ্টের কথা জেনে স্কুলের মাস্টারমশাই বা দিদিমণিরা সবসময়ই তার দিকে বিশেষ
নজর দিয়েছেন। ক্লাস এইট থেকেই বাচ্চাদের প্রাইভেটে পড়ানো শুরু করেছে। লেখাপড়া
চর্চার পাশাপাশি দুটো পয়সা এসেছে, মায়ের সঙ্গে যেটুকু পারে সহযোগিতা করেছে, তাতে
মায়ের বিশেষ সুবিধা হয়তো হয়নি কিন্তু নিজের পড়ার কিছুটা খরচ আর নিজে শুধু লেখাপড়া
কেন্দ্রিকই থাকতে পেরেছে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এভাবেই, তারপর তো কলকাতায় হস্টেলে
থেকে কলেজ। কলেজের টিআইসি স্কুলের হেডস্যারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তার সুপারিশে এবং
উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের কারণে হস্টেল পেতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। হেডস্যারের ঋণ সে
কোনদিন ভুলতে পারবে না।
১০
না বায়োলজিক্যাল সেক্স নয়, নয় তার
কাপুরুষতা। এ তার আদর্শ, মূল্যবোধ। শুভ্রার মতো সাড়া জাগানো সুন্দরী বড়লোকের
মেয়েরা হয়তো বুঝবে না। গরিব মানুষের আর কী আছে তার আদর্শ, মূল্যবোধ আর বিশ্বাস
ছাড়া? বিশ্বাস মানে ভগবানের ওপর বিশ্বাস বা কোনো অলৌকিক শক্তির ওপর বিশ্বাসের কথা
নয়। নিজের ওপর বিশ্বাস, নিজের কর্মের ওপর বিশ্বাস। একমাত্র কর্মই মানুষকে বদলে
দিতে পারে। সৎ পথে থেকে নিজেকে প্রস্তুত রেখে সঠিক পদ্ধতিতে উপার্জন করতে পারলে
শুধু নিজের গরিবিয়ানার বদলই নয়, সমাজে, নিজের মনের কাছে মাথা উঁচু করে বাঁচতে
পারে। কেউ অন্তত ব্যাঁকা চোখে তাকাতে বা ব্যাঁকা আঙুল তুলতে পারে না।
সেদিন শুভ্রার শেষ কথাটায় খুব
দুঃখ পেয়েছিল সুখ। শুভ্রাকে বলেনি সে-কথা, বলেনি মানে বলতে পারেনি। শুভ্রার প্রেমে
তখন হাবুডুবু খাচ্ছে সুখ, তবু দুঃখ পেয়েছিল সে। ভেবেছিল সময় লাগবে, কিন্তু আস্তে
আস্তে ঠিকই তার আদর্শ, মূল্যবোধ শুভ্রার মধ্যে চারিয়ে দিতে পারবে সে। ওপর থেকে
দেখা না গেলেও যেমন করে কোনও গাছের শিকড় মাটির গভীরে ধীরে ধীরে চারিয়ে যায়।
সেদিনের পর থেকে দেবাশিসের সঙ্গে
সম্পর্কটাও স্বাভাবিক হয়নি আর। কথাবার্তা প্রায় নেই বললেই চলে, এক ঘরে থাকে, এক
ক্লাসে পড়ে তাই প্রয়োজনীয় যেটুকু কথা। সুখ পারে না, তার বিশ্বাস বা আদর্শে আঘাত
লাগলে কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না। এ যদি তার চারিত্রিক দুর্বলতা হয় তো তাই।
দেবাশিসের জন্য তার কষ্ট হয়, কিন্তু কিছু করার নেই। তার আদর্শ, বিশ্বাসের কেউ
অমর্যাদা করলে তার সঙ্গে কোনরকম আপোষ করতে সে রাজি নয়।
সেদিনের পরেও সুখ গিয়েছিল শুভ্রার
বাড়ি, অনেকবার। শুভ্রা সেদিনের পরে ওই বিষয়ে আর খুব বেশি ঘাঁটাতে সাহস করেনি। বরং
সংযত করেছিল নিজেকে। আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিল শুভ্রা, কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে
যেমন করে প্রকৃতি একটু একটু করে এক ঋতু থেকে আর এক ঋতুতে বদলে যায়, অনেকটা তেমনই।
বুঝতে পারছিল শুধু সুখ।
ক্রমশ

সুখের চরিত্রায়নে লেখকের মুন্সীয়ানা বড় প্রশংসনীয়। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার এক প্রতিচ্ছবি যে এই উপন্যাস " মউ "
ReplyDeleteধন্যবাদ প্রদীপ-দা। আপনি মন দিয়ে পড়ছেন, মন্তব্য করছেন, ভাল লাগছে। সঙ্গে থাকুন।
Deleteপ্রথম পর্ব থেকেই খুব ভালো লাগছে, পরের পর্বগুলোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি
ReplyDeleteতোর ভাল লেগেছে জেনে আমারও ভাল লাগল। পরের পর্ব প্রতি শনিবার।
Delete