বাতায়ন/নৃপেন চক্রবর্তী
সংখ্যা/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/২৯তম সংখ্যা/১৪ই কার্ত্তিক,
১৪৩২
নৃপেন চক্রবর্তী সংখ্যা | ধারাবাহিক গল্প
মমিনুল পথিক
সামান্তার
অপেক্ষা
[১ম পর্ব]
"এবার রীতিমতো ঘামতে শুরু করলেন তিনি। চিন্তা আর অস্থিরতায় শুভ্র দেহের উপরে সাঁটানো অন্তর্বাসটি যেন লোনা ঘামে চুপসে উঠেছে অষ্টবিংশ বয়োষোর্ধ এই যুবতীর।"
মেসের বুয়া দেরিতে আসায়
প্রতিদিনের চেয়ে অফিসে যেতে একটু দেরিই হয়েছিল আজ। তবুও অফিস সময়ের আগেই পৌঁছাতে
চায় মাসউদ। সে জন্যে হয়তো খুব দ্রুতবেগে হাঁটছিলেন নতুন যোগদান করা এই সরকারি
কর্মচারি। গলির মোড়টি পার হতেই বাম পাশে দাঁড়ানো রিকশা হতে ধপাস করে কিছু পড়ার শব্দ
শুনতে পেলেন তিনি। কানের সাথে চোখের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে
জড়িত হওয়ায় সাথে-সাথেই ঘটনাস্থলে নজরটি পড়েছিল তাঁর। দেখলেন, যেখান থেকে পড়ার শব্দটি হয়েছিল সেখান থেকেই একটি রিকশা
দ্রুতবেগে সামনের দিকে হু হু করে ছুটে চলেছে। আর এও বুঝতে পারলেন যে, যাত্রী একজন মহিলা হবেন। দেখতে দেখতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে
দেখেন একটি ব্যাগ সটান হয়ে পড়ে আছে। ব্যাগটি হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রিকশার আরোহীকে হেঁড়ে গলায় ডাক দিলেন- ম্যাডাম, ও ম্যাডাম, এই যে শুনছেন? ম্যাডাম, ও ম্যাডাম আপনার
ব্যাগ পড়েছে; এই খালি, খালি, আরে ভাই দাঁড়াওনা।
ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে নিজের
উপর বিরক্ত হলেন মাসউদ। ততক্ষণে রিকশা তাঁর দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করেছে।
ব্যাগটি নিয়ে যেন বড়ই মসিবতে পড়লেন। কী আর করে, চিন্তিত মনে আবার হাঁটা দিলেন তিনি।
অফিসে গিয়ে আলমারির ভেতর
ব্যাগটি রেখে কাজের মধ্যে ডুব দিলেন মাসউদ। নতুন চাকরি, কাজের প্রতি মনোযোগ না থাকলে স্যারের আশীর্বাদ পাওয়া
যায় না। আর স্যারের আশীর্বাদ ছাড়া প্রমোশনে ভাটা। তাছাড়া
কাজের প্রতি যথেষ্ট যত্ন ও শ্রদ্ধাশীল তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে বেরিয়ে অর্ধযুগ ঢাকায় কয়েক জোড়া স্যান্ডেল ক্ষয় করার পর
চাকুরি নামের সোনার হরিণের দেখা মিলেছে; তাও আবার ছা’পোষা কেরানি।
স্কুলের দরজায় এসে রিকশা থেকে নামার
সময় হতভম্ব হলেন সামান্তা। খাতার ব্যাগটি গেল কোথায়? বাসায় ছাড়লাম না তো?
নাহ্, আসার সময় আম্মা তো নিজেই ব্যাগটি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
তাহলে পড়ল কোথায়? এই রিকশা, আবার চল তো ওই গলির মোড়ে। বলে আবার রিকশায় ঊঠে রাস্তার দু’পাশে যেন মাছরাঙা চক্ষুর মতো দৃষ্টি
নিবদ্ধ করলেন। শেষে গলির মোড় পর্যন্ত গিয়ে না পেয়ে বাসায় মোবাইল করলে তার মা
জানালেন বাসায় খাতার ব্যাগটি নেই। এবার রীতিমতো ঘামতে শুরু
করলেন তিনি। চিন্তা আর অস্থিরতায় শুভ্র দেহের উপরে সাঁটানো অন্তর্বাসটি যেন লোনা
ঘামে চুপসে উঠেছে অষ্টবিংশ বয়োষোর্ধ এই যুবতীর। এমতাবস্থায় কপালে চিন্তার কোঁচকানো রেখা নিয়ে আবার স্কুলে ফিরে এলেন তিনি।
স্কুলে এসে আনমনা অবস্থায়
টিচার্স কমনরুমে ঝিম মেরে বসে আছেন সামান্তা। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়া তিন সপ্তাহ
গত হয়েছে মাত্র। আপাতত ক্লাস নেই, অন্যান্য শিক্ষকরা নিজ নিজ ভাগের খাতা দেখার পর
মার্কলিষ্টসহ খাতা জমা দেওয়া শুরু করেছেন। কিন্তু তার মনে দুশ্চিন্তা ও চোখে-মুখে
অপরাধের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে কীভাবে বলবেন যে, তিনি খাতাগুলো হারিয়ে ফেলেছেন। একে তো বার্ষিক পরীক্ষার
খাতা তার উপর সপ্তাহ দু’য়েক পরেই ফলাফল প্রকাশিত হবে। নিরীহ নিষ্পাপ প্রায় একশত জন
তৃতীয় ও চতুর্থ শেণির শিক্ষার্থীর ইংরেজি নাম্বারটি যে কীভাবে সমন্বয়
করবেন সে চিন্তার রেখা তার দু’গালে ফুটে উঠেছে।
সামান্তা ইংরেজির একজন ভাল
শিক্ষক। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর। বাবার
ইচ্ছে মেয়ে সরকারি চাকুরি করবে কিন্তু মেয়ের কথা হলো, বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়
তিনি নিয়োজিত থাকবেন। বাবা সাহানুর রহমান চৌধুরী জেদি হলেও
মেয়ের ব্যাপারে সাত খুন মাফ। মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কোন কথা নেই। সুতরাং আপাতত
বাড়ি থেকে অনতিদূরে সবুজ কানন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে যোগদান করেছেন।
প্রায় দু’দিন গত হতে চলেছে
মাসউদের ব্যাগটি পাওয়া। অফিসের কাজের ভীড়ে মনেই ছিল না তাঁর। সারাদিন কাজ নিয়েই
ব্যস্ত থাকেন তিনি। একাকী জীবন, সংসারের ঝুটঝামেলা
নেই। অফিসের কর্তা তাঁর কাজকর্মে খুব খুশি। আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি তৈরি করতে
বলে বাইরে গেছেন।
মেস থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে
এসে আলমারিতে ফাইল খুঁজতে গিয়ে ব্যাগটির প্রতি নজর পড়ে তাঁর। ব্যাগটি বের করে
টেবিলে রেখে তাড়াতাড়ি ফাইলের কাজটি সেরে ফেললেন। এরই মাঝে আসরের আজান হওয়ায় পাশের
কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এলেন। এবার ব্যাগটির পালা— কী আছে ব্যাগে? নিজেকে ধিক্কার দেন তিনি। এই ক’দিন কেন ব্যাগটি ফেলে রাখলেন? কারোও প্রয়োজনীয় জিনিসও তো হতে পারে? ব্যাগের চেনটি খুলে ভিতরের কাগজগুলো বের করে একে একে দেখতে
থাকেন। তারপর বোঝার আর বাকি রইল না যে, এগুলো বার্ষিক পরীক্ষার খাতা। কিন্তু কীভাবে এগুলো পৌঁছাবেন? খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় যদিও সিল মারা আছে সেখান থেকে স্কুলের
নামটি পেয়েছেন, কিন্তু সেখানে
স্কুলের ঠিকানা নেই। তিনি এই শহরে নতুন এসেছেন, শহরের রাস্তাঘাট, মানুষজন সবই তাঁর
অচেনা। তাছাড়া এতক্ষণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। সুতারাং আরও একটি দিন অপেক্ষা করতে
হবে খাতাগুলো তার আসল মালিককে পৌঁছাতে।
ইচ্ছে করেই হোক আর অনিচ্ছা
সত্বেও হোক যেহেতু খাতাগুলো হারিয়ে গেছে,
এর
দায়দায়িত্ব সবই তাঁর। এজন্যে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে করেন সামান্তা। প্রিন্সিপাল
ম্যাডামের নিকট গোপন করেও লাভ নেই, এছাড়া আগামী সপ্তাহের
শেষ নাগাদ ফলাফল প্রকাশিত হবে। সামান্তাকে খাতা জমা দেওয়ার তাগাদা না দিলেও
দায়বদ্ধতা বলে একটা কথা। তাছাড়া প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাঁকে খুব ভাল জানেন এবং
স্নেহ করেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চেম্বারে বলতে গিয়েও বলতে পারেননি তিনি। ভাবছেন
আগামীকাল বলব। নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে মাথাটি ভীষণ ধরেছে
তাঁর। শারীরিক অসুস্থতা বলে ম্যাডামের নিকট ছুটি নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি তিনি আজ বাসায়
গেছেন। অন্যান্য কয়েকজন রসিক-বেরসিক শিক্ষক সামান্তা ম্যাডামকে নিয়ে নানারকম
কথাবার্তা বলতে লাগলেন— যার সংক্ষিপ্ত রূপ হল, পরিণয় যোগ্যা এই ম্যাডামের হৃদয় সাগর যৌবনের জোয়ার একেবারে
উথলে উঠেছে। তাই বোধহয় হৃদয়, কায়া, ছায়া তাঁর কাছে কেমন নিরামিষ মনে হয়।
ক্রমশ

No comments:
Post a Comment