প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

তৈমুর খান সংখ্যা | মগজ ও অঙ্গ

বাতায়ন/ তৈমুর খান সংখ্যা/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/ ৩২তম সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ , ১৪৩২ তৈমুর খান সংখ্যা | সম্পাদকীয়   মগজ ও অঙ্গ "অপরিসীম মেধ...

Tuesday, November 25, 2025

সামান্তার অপেক্ষা [৬ষ্ঠ পর্ব] | মমিনুল পথিক

বাতায়ন/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৩তম সংখ্যা/১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
ধারাবাহিক গল্প
মমিনুল পথিক
 
সামান্তার অপেক্ষা
[৬ষ্ঠ পর্ব]

"মাসুদের মুখ থেকে কষ্ট ও সুখের পার্থক্যটা শুনে সামান্তা যেন কেমন হয়ে গেলেন। জীবনে কষ্টের সাথে কোনদিন পরিচয় হয়নিতাইতো অনুভবেই আসেনি। কিন্তু এখন কেমন যেন কষ্টটা তিনি অনুভব করতে পারছেন। স্বচ্ছ টলটলে লোনা জলে চোখ দুটো ভরে উঠে সামান্তার।"

 
পূর্বানুবৃত্তি সামান্তার স্কুলের হারিয়ে যাওয়া খাতা একটা রেস্তোরাঁয় ফেরত দিল মাসউদ। সামান্তা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কৃতজ্ঞতায় রেস্তোরাঁর বিল দিতে গেল সামান্তা। মাসউদ বাধা দিয়ে তার হাত চেপে ধরল। বিদ্যুৎ খেলে গেল সামান্তার শরীরে। তারপর…

হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে মাসুদ বললেন,
-ম্যাডাম খাতাটি পৌঁছাব কীভাবে?
সামান্তা ভ্রু-জোড়া কুঁচকে বললেন,
-কেন, আমি নিজেই নিয়ে আসব আপনার কাছ থেকে।
জীর্ণশীর্ণ একটি মেসে থাকে মাসুদ ইতস্তত হয়ে বললেন,
-আপনি কষ্ট করবেন? বরং আমিই স্কুলে পৌঁছে দেব।
-দেখুন মাসুদ সাহেব আমি দুদিন স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছি, আপনি চলুন তো এখনি খাতাগুলো নেব।
এই বলে একটি রিকশা ডাকলেন। মাসুদ আর একটা রিকশা ডাকতেই সামান্তা বাধা দিয়ে বললেন,
-একটাই হবে।
-কিন্তু ম্যাডাম আমি একজন পরপুরুষ হয়ে আপনার মতো একজন অচেনা পরনারীর রিকশায় ওঠা কি শোভনীয় হবে?
সামান্তা এবার একটু মুচকি হেসে বললেন,
-দেখুন আমরা মানুষ এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। আর মানুষেরই কেবল আত্মবিশ্বাস থাকে পশুর নয়, সুতরাং মনের চোখ দিয়ে যদি আমরা পরিষ্কার দেখি সেটাই যথেষ্ট বুঝলেন? এখন ঝটপট করে উঠে পড়ুন।
মাসুদ আর কোন কথা বলেননি, সামান্তার কথামতো সুবোধ বালকের মতো রিকশায় উঠে পড়লেন। রিকশার ঝাঁকুনিতে যেন কোন স্পর্শ না লাগে সেজন্য ডান পাশে মাসুদ এমনভাবে কাত হয়েছে যেন পড়ে যাবার উপক্রম।
-কী ব্যাপার মাসউদ সাহেব আপনি তো পড়ে যাবেন দেখছি, সরে আসুন-না আমার দিকে।
বড়ই মায়াভরা কণ্ঠে বললেন সামান্তা।
-না ম্যাডাম ঠিক আছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন মাসউদ। রিকশা চলছেই...। কিছুক্ষণ পর সামান্তা বললেন,
-মাসউদ সাহেব আপনার বাসা আর কতদূ?
-এই যে সামনে মেস ম্যাডাম।
হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেন মাসদ।
-মেস মানে, আপনি বাসায় থাকেন না?
আশ্চর্য হন সামান্তা।
-বাসা কোথায় পাব বলুন, সবে তো নতুন চাকুরি নিয়ে এই শহরে এসেছি।
-তাহলে পরিবার কি গ্রামের বাড়িতে রেখেছেন?
-না ম্যাডাম, পরিবার বলতে মা-বাবা, ভাই-বোন ওনারা সবাই গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
-কেন। স্ত্রী, সন্তান?
-সে সুযোগ আর হল কই?
-দুঃখিত, আমি না জেনে আপনাকে শুধু শুধুই কষ্ট দিলাম, মনে কিছু নিবেন না।
-না ম্যাডাম মনে কী নেব। আমাদের মতো চিতার আগুনের আর মন বলে কিছু আছে নাকি? ম্যাডাম মেস এসে গেছি।
বলতে বলতে রিক্সাওয়ালাকে থামাতে বললেন। সুন্দর পরিপাটি করা মাসদের রুমটি। রুচিশীল স্বভাবের তিনি, দেখলেই বোঝা যায়। আরও দুটো বেড আছে সেখানে, তারা সবাই চাকুরি করেন; এখনও ফেরেননি। সামান্তাকে বসিয়ে রেখে মাসউদ ধলার মাকে চা-নাস্তার জন্যে বাইরে পাঠালেন। ধলার মা স্বামী তালাকপ্রাপ্তা মহিলা। পঁচিশ বছর আগে স্বামী তাকে তালাক দিয়ে আর একটি বিয়ে করেছিল। ধলা তখন পেটে। তারপর বিভিন্ন মেসে রান্না করত। এই মেসে প্রায় বছর পাঁচেক হল। ধলা রিকশা চালায়, মা-ছেলে একটি বস্তিতে থাকে। এই মেসের সবাই তাকে খালা বলেই ডাকে। তিনিও সবাইকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। এখন বয়স হয়েছে, ঠিক মতো রান্না করতে পারেন না। কিন্তু কেউ তাকে ছাড়তেও চায় না।
 
মাসউদ রুমে ঢুকতেই সামান্তা বললেন,
-মাসদ সাহেব কই খাতাগুলো বের করুন।
-দিচ্ছি ম্যাডাম, আগে চা-টা খান, এই অভাগার রুমে প্রথম এসেছেন।
-অমন করে বলবেন না মাসউদ সাহেব, তাহলে কিন্তু ভীষণ কষ্ট পাব। তাছাড়া এই অসময়ে আবার চা কেন?
বলতে বলতেই ধলার মা চা-নাস্তা নিয়ে এলেন। মাসুদ চা খেতে খেতেই খাটের নীচে রাখা ট্রাংক হতে খাতার ব্যাগটি বের করলেন।
-এই যে ম্যাডাম, আপনার আমানত
বলে ব্যাগটি সামান্তার সামনে রাখলেন।
-মাসদ সাহেব আপনার এই ঋণ যে কীভাবে শোধ করব বুঝতে পারছি না।
চা-এ চুমুক দিতে দিতে বললেন সামান্তা।
-ম্যাডাম একটি কথা সবসময় মনে রাখবেন যে, আল্লাহ দুনিয়াতে সবাইকে এক করে পাঠায়নি, অথচ সবাই সৃষ্টির সেরা জীব। সুতরাং মানুষের মাঝে ভেদাভেদ, ভিন্নতা আছে বলেই সবাই একে অপরের পরিপূরক, অর্থাৎ মানুষ মানুষের জন্যে।
-বাহ্‌ চমৎকার গুছিয়ে কথা বলতে পারেন দেখছি, কবিতা লিখেন নাকি?
-আর কবিতা! আমার জীবনটায় তো একটি কবিতা। তবে আগে মাঝে মাঝে লিখতাম, এখন লেখা হয়ে ওঠে না। মাত্রা, ছন্দ, তাল, লয় সব জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
-কেন বলুন তো?
-ও আর একদিন বলব।
-পাওনা রইল কিন্তু, লাভ-আসলে সব বুঝে নেব বুঝলেন মাসউদ সাহেব।
-আচ্ছা, সে সময় আসুক তারপর না হয়...।
এমন সময় সামান্তার মোবাইল বেজে উঠল, রিসিভ করে,
-হ্যালো, আম্মা বলছ, হ্যা আমি আসছি, তোমাকে বলা হয়নি, একটি সুখবর আছে, গিয়েই বলব। তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলেই বলিনি। আচ্ছা আসছি।
মোবাইলটি ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে খাতার ব্যাগটি নিয়ে বললেন,
-মাসদ সাহেব আজ তাহলে উঠি কেমন? কষ্ট দিয়ে গেলাম।
-না ম্যাডাম, এগুলো তো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী, লতার মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। তাইতো কষ্টকে ভয় হয় না, বরং ভয় হয় তার উলটোটা।
 
মাসুদের মুখ থেকে কষ্ট ও সুখের পার্থক্যটা শুনে সামান্তা যেন কেমন হয়ে গেলেন। জীবনে কষ্টের সাথে কোনদিন পরিচয় হয়নি, তাইতো অনুভবেই আসেনি। কিন্তু এখন কেমন যেন কষ্টটা তিনি অনুভব করতে পারছেন। স্বচ্ছ টলটলে লোনা জলে চোখ দুটো ভরে উঠে সামান্তার। আর তাকাতে পারেনি মাসদের দিকে। শুধু বললেন,
-মাসউদ আসি, বাই।
বলে রুম হতে বেরিয়ে গেলেন।
মাসউদও সামান্তার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে হাত ইশারায় বিদায় সম্বোধন জানিয়ে বাইরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে রিকশার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।
 
ক্রমশ

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 8 (Last 7 days)