বাতায়ন/ধারাবাহিক
গল্প/৩য় বর্ষ/৩৩তম সংখ্যা/১৯শে
অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
ধারাবাহিক
গল্প
মোঃ মনিরুল
ইসলাম
ছেঁড়া
ক্যানভাস
[২য় পর্ব]
"হেনা চঞ্চল প্রজাপতির মতো পাখা মেলে উড়তে চাইত। রফিক তার কোমল গোলাপের পাপড়ির মতো লাল ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বলত ঈশ্বরও বোধহয় আমাদের দুজনকে একে অপরের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।"
পূর্বানুবৃত্তি দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প, সেখানে বিভিন্ন
ভাতার আবেদন নেওয়া হবে। হেনা
ভিড় ঠেলে দুরুদুরু বুকে অফিসারের টেবিলের সামনে এলো। হেনা মাথা নিচু করে কাঁপা
হাতে কাগজ এগিয়ে দিল। চেনা এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল তার কানে— “আপনার নাম?” অফিসারের মুখের দিকে তাকাতেই তার হৃদয় কেঁপে উঠল। তারপর…
হেনা একটু দূরে সরে গিয়ে
কাগজের ফাইল হাতড়ে হাতড়ে একটা বছর পাঁচেক আগের ছবি খুঁজে পেল। সেই ছবিটা
আবেদনপত্রে লাগিয়ে দিয়ে পুনরায় কাগজ জমা দেওয়ার জন্য এগিয়ে দিল। অফিসার কাগজ
নিয়ে সই ও ছবির দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে ঠিক আছে বলে রেখে দিতে যাবে। তখন হৃদয়ের
অন্তঃস্থলে যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনের গভীরে যেন একটা খটকা লাগল। সাতবছর আগের
একটা হিমশীতল বাতাস আঘাত করল তার মনের গভীরে। তার হৃদয়টা কেঁপে উঠল। বুকের বাঁ
দিকটা চিনচিন করে উঠল। অফিসার এবার আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকালো সামনে
দাঁড়ানো মহিলার দিকে। হেনার চোখে চোখ পড়তেই সে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সে মনে
মনে বলল এ আমি কাকে দেখছি! তার দৃষ্টিশক্তি যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। সে
বাকরুদ্ধ হয়ে হেনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার গায়ের ফর্সা রং রোদে পুড়ে
তামাটে হয়ে গেছে। মুখের সেই মায়া জড়ানো জেল্লাভাব উধাও। তার চোখের কোণে এক চিলতে স্বপ্ন বেঁচে আছে শুধু ছোট্ট মেয়েটির জন্য। কিছু বলার জন্য
রফিকের ঠোঁট কেঁপে উঠল কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বার হলো না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস
ফেলে চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে ছোট্ট শিশুটির মুখের দিকে একবার লাজুক দৃষ্টি দিয়ে
বলল আপনার হয়ে গেছে।
ঘরে ফিরে রফিকের সারাক্ষণ
হেনার কথা মনে পড়ে। তার মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার করুণ পরিণতির জন্য
নিজেকেই দায়ী করে। এভাবে ধুলোমাখা ছেঁড়া ক্যানভাসে তাদের জীবনের করুণ কাহিনি লেখা হবে সে কখনোই ভাবেনি।
হেনা ছিল গরিব ঘরের
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। তার ইচ্ছা ছিল অনেক লেখাপড়া করে শিক্ষক হওয়ার। বাবা রহমত
দিনমজুরের কাজ করত। বাবার মনে স্বাদ থাকলেও সাধ্য ছিল না। পাড়ার মহিলারা
পুকুরঘাটে, কলতলায় প্রায়ই ওর
মাকে শুনিয়ে বলাবলি করত দিনকাল খারাপ ঘরে লায়েক মেয়ে রাখতে নেই। কিছু ঘটে গেলে
পাড়ায় মুখ দেখাতে পারবে না।
হেনা সুন্দর নৃত্য করত। তার
ছবি আঁকার হাত ছিল দক্ষ শিল্পীর মতো। অসম্ভব সুন্দর তার গানের গলা। চঞ্চল
মেয়েটা পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে মাথার দুদিকে বিনুনি কেটে চুলে লাল ফিতের ফাঁস দিয়ে
চঞ্চল প্রজাপতির মতো স্কুলে আসত। সে স্কুলে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের
অত্যন্ত প্রিয় ছিল। তার চোখে স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে একদিন সরকারি চাকরি
করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। সমাজের কল্যাণ করবে।
দুজনের আলাপ হয় স্কুল থেকেই।
মাঝেমধ্যে স্কুল শেষে দুজনে গিয়ে বসত নদীর ধারে। সেখানে বসে নীল আকাশের দিকে
তাকিয়ে দুজনে কত রঙিন স্বপ্নের জাল বুনেছিল। রফিক হেনাকে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
রফিকের বাঁশির সুরে তার হৃদয়ে সুরের ঝংকার উঠত। এক নয়নে তার মুখের দিকে তাকিয়ে
থাকত। হেনা চঞ্চল প্রজাপতির মতো পাখা মেলে উড়তে
চাইত। রফিক তার কোমল গোলাপের পাপড়ির মতো লাল ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বলত ঈশ্বরও
বোধহয় আমাদের দুজনকে একে অপরের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। রফিক উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যায় কলকাতায়। হেনা ভর্তি হয় মফস্সলের কলেজে।
কলেজে পড়তে পড়তে বাবা-মা ওর অমতে
জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। সে অনেক আপত্তি করেছিল। অভিমান করে কয়েকদিন না
খেয়েছিল। কিন্তু অসহায় বাবা-মার কথা চিন্তা করে অদৃষ্টের
উপর নিজের ভাগ্যকে সঁপে দেয় কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস
বিয়ের মাত্র চারবছরের মাথায় অকালে হারাতে হয়েছে তার স্বামীকে। অকালবৈধব্য আর
একবছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে আজ বেঁচে আছে। তাই আজ সে অসহায় হয়ে লজ্জা বিসর্জন
দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছে সরকারি পরিষেবা নেওয়ার জন্য।
সেদিন রাতে ঘরে ফিরে হেনা
মেয়েকে খাওয়াচ্ছিল। মেয়েটি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
-মা, আজ ক্যাম্পে ওই অফিসারকাকু কেন তোমার দিকে ওভাবে তাকিয়েছিল?
হেনা বেশ অবাক হলো। শিশুর
চোখে লুকোচুরি চলে না। নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে মা মিথ্যা কথা বলতে পারল না।
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-মা কারও হৃদয়ে যদি পুরোনো স্মৃতি জমে থাকে, তাকে আর মনে করতে নেই। হৃদয়ের পুরানো কথা বলতেও নেই। মনে
করলে হৃদয় আরো ভরাক্রান্ত হয়ে উঠবে। মা তুমি যখন বড় হবে সব বুঝতে পারবে…
আলো-আঁধারি ঘরে
হেনার চোখের কোণে জল চলে এলে। নীলা মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
-বাবার জন্য
তোমার বড্ড মনখারাপ করছে। তুমি চিন্তা করো-না আমি আছি। আমি
বড় হয়ে চাকরি করব তোমার সব অভাব পূরণ করে দেব।
মা মেয়ের মাথায় আলতো করে
হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-মা তুমি বড়
হও দীর্ঘজীবী হও।
সে মনে মনে বলল আমার আবেদন
সরকারি খাতায় জমা পড়ে গেছে, কিন্তু তার অন্তরের
আবেদন— যে আবেদন রফিকের চোখেও ধরা দিয়েছিল— সেটা কোনোদিন সরকারি খাতায় নথিভুক্ত
হবে না...!
সমাপ্ত

No comments:
Post a Comment