বাতায়ন/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৩৩তম সংখ্যা/১৯শে
অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
ধারাবাহিক
গল্প
কামাল কাদের
ঘন
কুয়াশার আড়ালে
[২য় পর্ব]
"অশ্রু বিজড়িত হাসিতে নাগমাকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আকাশটা ঘন কুয়াশা কাটিয়ে রোদের সাথে লুকোচুরি খেলছে।"
পূর্বানুবৃত্তি কাশ্মীর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে আসা
নাগমা কোরাইশী এক ঠগের পাল্লায় পড়ল। পবন রহমান নাগমার ভয়ার্ত
চিৎকার শুনে কিছু না ভেবে ঠগ ছেলেটির পিছনে দৌড়ে তাকে ধরে নাগমার কাছে নিয়ে
এল। তারপর…
অবশেষে প্রায় ৬-৭ মাস পর
একদিন পবনের সাথে নাগমার দেখা হয়ে গেল, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির এক অধিবেশনে। পবন অধিবেশনে যোগদানের জন্য লুকিয়ে
এসেছে। তার পিছনে অনর্থক এক টিকটিকি লেগেছে। তাই বতর্মানে সে আত্মগোপনে আছে। নাগমা
পবনকে জিজ্ঞাসা করল,
-এতদিন কোথায় ছিলেন?
-এখানে-সেখানে পালিয়ে বেরিয়েছি টিকটিকির ভয়ে।
-সেটা আবার কী?
-ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ছাত্রদের
মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদের দ্বারা ডিটেক্টিভ লাগিয়ে দেয়। তারা যে-কোনো ছাত্রকে
সরকারের বিরুদ্ধে কোনও সন্দেহজনক
কাজকর্ম করতে দেখলে পুলিশকে জানিয়ে দেয়। তাদেরকে আমরা বলি টিকটিকি। আমাদের দেশের
এটা একপ্রকার কীটপতঙ্গের নাম, সময়-অসময়ে টিকটিক
শব্দ করে উঠে, বিশেষ করে রাতের
বেলায়।
-আচ্ছা আপনাকে এই সমস্ত পলিটিক্সের ঝামেলায় না গেলেই কি নয়?
কথাটি পাশ কাটিয়ে একটু হেসে
পবন বলল,
-আপনি কি আমাকে মিস করেছেন?
হঠাৎ প্রশ্নটি শুনে কাশ্মীরি
মেয়ে নাগমার ফুটন্ত পদ্মফুলের মতো রক্তিম মুখমন্ডলটি লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। অস্ফুট
স্বরে বলল,
-হয়তো-বা!
অতি ভদ্রভাবে পবন বলল,
-কাউকে তো এই সমস্ত অভাগীদের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে, তা না হলে তারা যাবে কোথায়? গরিব ঘরে জন্ম নেয়াটা কি অপরাধ?
আমাদের
মতো শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা তাদের প্রতিনিধি হয়ে যদি একটু হলেও উপকারে আসি তাতে ক্ষতি কী? জীবনটা সুন্দর যখন আমি সুখী, আরো সুখী যখন আমার সাহায্যে অন্যে সুখী হয়।
-আপনি মানুষটা ভিন্ন ধরণের, এক অসামান্য এবং দুর্লভ মানবিক চেতনার অধিকারী। তাই আপনাকে আমার ভাল লাগে।
আবার কবে দেখা হবে?
-ধন্যবাদ আপনাকে, আমার এত সুন্দর গুণকীর্তন
করার জন্য। আর আমাদের দেখাসাক্ষাৎ?
তা
একমাত্র সময়ই বলতে পারে, সেটা ভবিষ্যতের জন্য
রেখে দিলাম।
এরপর বছরখানিকেরও বেশি সময়
অতিবাহিত হয়ে গেল। কারো সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই। একদিন নাগমা উত্তরার একটা
ফার্মেসিতে কিছু ওষুধপত্র কেনার সময় দেখতে পেল পবনের মতো চেহারার এক ডাক্তার একজন
রোগীর শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা করছে। পবন আবার কবে ডাক্তার হলো? তাহলে সে কি তাকে মিথ্যা কথা বলেছিল? কিন্তু সে তো তেমন ছেলে নয়। ঘন কুয়াশার মতো তার মনের ভিতরে
একটা রহস্য আবির্ভূত হলো। ভিতরে গিয়ে দেখা যাক, পবনকে অতর্কিতে বিস্ময়ে ফেলে রহস্য উদ্ঘাটন করা যায় কিনা!
রোগীটির চিকিৎসার পরামর্শ শেষ হবার পরপরই নাগমা সোজা ভিতরে ডাক্তারের চেম্বার
ঢুকেই প্রশ্ন করল,
-কেমন আছেন পবন সাহেব?
-আমি পবন নই, আমি ডাক্তার সৈকত
রহমান। আপনি কি পবনের খোঁজে এসেছেন?
প্রশ্নটি শুনে নাগমা কিছুটা
হোঁচট খেলো এই ভেবে তাহলে পৃথিবীতে একই চেহারার দুজন মানুষ থাকে। তারপর নিজেকে
সামাল দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল,
-আপনি কি পবন রহমান নন?
-পবন আমার ছোট ভাই। আমার থেকে তিন মিনিটের ছোট। আমাদের
দুজনের মধ্যে অনেকেই গণ্ডগোল করে ফেলে। ভাগ্যিস আজ পর্যন্ত এই ব্যাপারে আমরা কোনও মেয়েঘটিত বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়ি নাই। আজই প্রথম আপনাকে দেখে কথাটি মনে
হলো।
এমন রসিকতা করে কথাগুলি
ডাক্তার সৈকত বলল তাতে নাগমার মনে হচ্ছে যেন পবনই কথা বলে যাচ্ছে।
-উনি এখন কোথায়?
-সে তো তার মা-বাবার সাথে পুরানো ঢাকায় থাকে।
-কিছুক্ষণ আগে আপনি না বললেন, সে আপনার ছোট ভাই,
আবার
বললেন, পবন তার মা-বাবার সাথে
থাকে। আমি কিছু বুঝতে পারলাম না।
-না বুঝারই কথা। ব্যাপারটা আপনাকে খোলসা করে বলি, পবন আমার আপন
ভাই, চাচাতো ভাই এবং খালাতো ভাই, যেটাই ধরুন না কেন। কেমন ধাঁধায় ফেলে দিলাম তাই না! আসল কথা
হলো আমার বাবা এবং চাচা একই পরিবারের দু বোনকে বিয়ে করেছে। তাই আমার চাচি যিনি, খালাও তিনি। আমার বাবা বয়সে বড়। আমরা তিন বোন এবং যমজ দুই
ভাই। পবন এবং আমি। এদিকে আমার চাচার এবং খালার কোনও ছেলেপিলে
হলো না। চাচার ওকালতিতে অনেক নাম-ধাম। প্রচুর টাকা কামাচ্ছে, কিন্তু নিঃসন্তান হওয়াতে তাদের জীবনে কোনও সুখ ছিল না।
তাদের দুঃখ দেখে আমাদের দাদা-দাদির অনুরোধে পবনের যখন
মাসতিনেক বয়স তখন পবনকে আমার মা-বাবা, আমার খালা এবং চাচাকে দত্তক দিয়ে দেয়। সেই থেকে আমরা ভাই
ভাই এবং একে অপরের পরম বন্ধু। এখন কিছু বুঝতে পারলেন কি?
-জী! একদম ভালভাবে বুঝেছি।
-আমার ভাইটা একটু আত্মকেন্দ্রিক, কিন্তু মনটা বড় উদার। যাকে বলে ঝুনা নারিকেল। বাইরের দিকটা
শক্ত, ভিতরের দিকটা বেশ নরম। কারোর
কথা শুনে না, বিশেষ করে নিজের স্বাস্থ্যের
দিকে। খাবারদাবার ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। বেশ কিছুদিন অসুখে ভুগল, এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
কথাটি শুনে নাগমা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে
প্রশ্ন করল,
-কী হয়েছিল তার?
-ওর অ্যাপেন্ডিসাইটিসটি রেপচার হয়ে গিয়েছিল, মানে বার্স্ট আর কী! আমি কাছেই ছিলাম, তাড়াতাড়ি ওকে হসপিটালে নিয়ে অপারেশন করাতে হলো। এ যাত্রায় সে
প্রাণে বেঁচে গেল। সাধারণত রেপচার হয়ে গেলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়। একটা
সুখবর হলো পবন এখন আর সিগারেট খায় না। সেই যে অপারেশন হবার
পর সে যখন চোখ মেলল তখন থেকে অ্যানেসথেটিকের ধকলে বা অন্য
কোনও কারণে তা আমি বলতে পারব না, পবন সিগারেটের গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
-খুব একটা ভাল খবর আমাকে দিলেন।
একটু আবেগজড়িত কণ্ঠে নাগমা
বলল,
-উনার সাথে আমাকে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবেন?
-নিশ্চয়ই! তা ব্যাপারটি কী? ও হ্যাঁ, বুঝেছি।
-ওকে ধরে আমি খুব করে পিটুনি দেব।
নাগমার অভিমান ভরা জবাব। সৈকত
পবনকে ওর মোবাইলে ফোন করল, জিজ্ঞাসা করল,
-কী করছিস?
-বাবার সাথে তর্ক করছি।
-এবার কী বিষয়ে হচ্ছে?
-বাংলাদেশ এখন কোন পথে যাচ্ছে? ক্যাপিটালিজম, সোশালিজম না
কমুনিজমের দিকে?
-রাখ তোর ‘ইজম’, তোকে এক সারপ্রাইজ দিবো, এক্ষুনি চলে আয় আমার
চেম্বারে।
-সারপ্রাইজটি কী?
-সেটা জানালে তো আর সারপ্রাইজ রইল না।
-ঠিক আছে আমি চলে আসছি,
তবে
জ্যামে কতক্ষণ লাগবে তা জানি না।
-ওকে, আমরা অপেক্ষা করব।
পবন ভাবল আমরা বলতে সৈকত কী বোঝাতে
চাচ্ছে!
অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেল।
এদিকে নাগমা পবনের দেরিতে অস্থির, উৎকণ্ঠিত চিত্তে চেয়ে
আছে রাস্তার দিকে কখন ওকে এক নজর দেখবে,
কতদিন হল দেখা হয়নি। নাগমা
দেখল পবন স্কুটার থেকে নেমে রাস্তার এপারে আসল। সে তাড়াতাড়ি ফার্মেসি থেকে বের হয়ে
সোজা পবনের মুখোমুখি। জিজ্ঞেস করল,
-তুমি যে অসুস্থ কেন আমাকে জানওনি?
-জানালে কী হতো?
-কাউকে ভাল লাগলে তুমি কী করে জানবে, না দেখা হলে সে কী যন্ত্রণার মধ্যে কাটায়?
-প্রথম দেখাতেই তোমাকে আমার ভাল লেগেছিল। কিন্তু সাহস হয়নি
এগোবার। কারণ হলো রাজনীতির আদর্শের ব্যস্ততার মাঝে আমি তোমাকে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই
দিতে পারব না। তাছাড়া তুমি বিদেশিনী, তোমার কোর্স শেষ হলে
তুমি তোমার দেশে চলে যাবে। আমার কী হবে? অনেক কষ্ট করে নিজের মনকে শক্ত করে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি। মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি
এই ভেবে, পেয়ে হারানোর চাইতে না পাওয়াটা অনেক ভাল।
পবনের কথা শুনে নাগমার দু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। বলল,
-মানুষের জীবনে মায়া,
মমতা, ভালবাসা এগুলো বর্ণনা করে বুঝানো যায় না। এগুলো
টাকার পরিমাণেও মাপা যায় না। এগুলো শুধু হদয়ে অনুভব করা যায়।
-আমি ভুল বুঝেছি,
আমাকে
তুমি ক্ষমা করে দাও।
-এই না হলো কথা!
অশ্রু বিজড়িত হাসিতে নাগমাকে অসম্ভব
সুন্দর দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আকাশটা ঘন
কুয়াশা কাটিয়ে রোদের সাথে লুকোচুরি খেলছে।
সমাপ্ত

No comments:
Post a Comment