প্রথম বর্ষ/প্রথম সংখ্যা/১লা
বৈশাখ, ১৪৩০
ছোটগল্প
কৃষ্ণা দাস
পতাকা উড়ছে
মা চলে যাবার পর পুরীর
জগন্নাথ মন্দিরে বছরে একবার করে আসাটা এখন একটা রুটিন হয়ে গেছে। বাবার তেমন ঈশ্বর চিন্তা
নেই। সব সময় বিজ্ঞান-চিন্তায় ও বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় ডুবে থাকেন। তবে আমার মানসিকতাকে
লালন করেন। আমি ঠিক আমার মায়ের মতো হয়েছি। ঈশ্বরে গভীর বিশ্বাস। যদিও আমি ডাক্তার তবু
প্রত্যেক সার্জারির আগে পরমপিতা জগন্নাথকে স্মরণ করতে ভুল হয় না।
এই মন্দিরে প্রতিবার একাই এসেছি। বাবা সেই সময় হোটেলের রুমে বিজ্ঞান জার্নালে ডুবে থাকেন। আমার চেনা পান্ডা আমাকে নিয়ে সুষ্ঠু ভাবে পুজো দিয়ে দেন। জগন্নাথ দর্শন করে গর্ভগৃহে তাঁকে প্রদক্ষিণ করে বেরিয়ে আসি। চুপ করে বসে থাকি মন্দিরের আশেপাশে কোনও নির্জন সিঁড়িতে। মৃদুমন্দ বাতাস বয়। মনে থাকেন জগন্নাথ। ভাল লাগে। আশেপাশে সঙ্গী থাকে বেশ কিছু বানর। তারা আমাকে বিরক্ত করে না কখনও। বরং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
মন্দির থেকে বেরিয়ে
সিঁড়িতে শেষ বার মাথা ঠেকালাম। মনে মনে বললাম ‘হে জগৎপিতা, হে জগন্নাথ, মনে শান্তি
দাও।’
আমার পান্ডাটির দোকানে রেখে যাওয়া ব্যাগ নিলাম। পুজোর ডালা ব্যাগে রেখে পয়সা মেটালাম। পায়ে চটি গলিয়ে বেরোতেই চোখ গেল মন্দির প্রাচীরের ডান দিকে। হাতে ডিএসএলআর নিয়ে অরিত্র না? সেই রকম রোগা লম্বা মাথায় কোঁকড়ানো চুল, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। যদিও মুখে মাস্ক তবু অরিত্রের হাঁটা, দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে আমি নিশ্চিত এটা অরিত্রই। এখানে কী করছে ও? ফটোগ্রাফি? তাও আবার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের? বিষয়টা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। আজ আট বছর হল অরিত্র স্টেটস্-এ। কবে এল দেশে?
“চন্দ্রাবতী!”
চমকে উঠে দেখি অরিত্র আমার সামনে। আমি অবাক হয়ে দেখছি ওকে। ও তাড়াতাড়ি মাস্ক খুলে বলল, “আমি, আমি অরিত্র।”
সত্যি কথা বলতে কী প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলেও আমি সহজ হতে পারছি না।
“চন্দু আমাকে কি চিনতে পারছ না? আমি অরিত্র ঘোষ।”
সম্বিত ফিরে বললাম, “তুমি এখানে হঠাৎ?”
“হঠাৎ নয়। আমি গত মাসে দেশে ফিরে মোটামুটি যতগুলো পেরেছি মন্দিরের ফটো শুট করেছি। একটা অ্যালবাম বের করব। যাই হোক তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল খুব ভাল লাগছে।”
আমি লক্ষ্য করলাম অরিত্রের চোখে-মুখে খুশি। অরিত্র হঠাৎ এ দিক-ও দিক তাকিয়ে বলল, “এখানে একা? নাকি সঙ্গে কেউ আছেন?”
আমি জানি ও আমার স্বামী বা ঐ জাতীয় কাউকে ইন্ডিকেট করছে। মাথা নাড়লাম। “না আমি একা। হোটেলের রুমে অবশ্য বাবা আছেন।”
“আচ্ছা স্যার আর তুমি এসেছ? কতদিন দেখিনি স্যারকে। কেমন আছেন উনি?”
“তুমি নিজেই দেখে যেতে পারো।”
“ওহ্ শিওর শিওর। কোন হোটেলে উঠেছ?”
আমি নাম বললাম। অরিত্র তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডেকে বলল, “উঠে পড়ো।”
অরিত্রর পাশে বসব? কিন্তু কেন? ও আমাকে অপমান করেছিল। সেই অরিত্রের সঙ্গে এক রিকশায় বসব?
আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরিত্র বলে উঠল, “কী চন্দু কী ভাবছ?”
আমি অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি বললাম, “আমি একটু স্বর্গদ্বার মার্কেট ঘুরে হোটেলে ফিরব। তুমি হোটেলে যেতে পারো রুম নাম্বার ৩১২।”
অরিত্র হাসল। “তোমার আপত্তি না থাকলে আমিও তোমার সঙ্গে মার্কেটে যেতে পারি।”
রিকশাওলা দাঁড়িয়ে আছে, একটু বিরক্ত যেন। অরিত্র আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মতামত জানার জন্য। আমি শাড়ির কুঁচি আর ব্যাগ সামলে অগত্যা রিকশায় উঠলাম। অরিত্র উঠে রিকশাওলাকে “স্বর্গদ্বার মার্কেট যাব” বলতেই সে প্যাডেলে চাপ দিল।
আমার পান্ডাটির দোকানে রেখে যাওয়া ব্যাগ নিলাম। পুজোর ডালা ব্যাগে রেখে পয়সা মেটালাম। পায়ে চটি গলিয়ে বেরোতেই চোখ গেল মন্দির প্রাচীরের ডান দিকে। হাতে ডিএসএলআর নিয়ে অরিত্র না? সেই রকম রোগা লম্বা মাথায় কোঁকড়ানো চুল, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। যদিও মুখে মাস্ক তবু অরিত্রের হাঁটা, দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে আমি নিশ্চিত এটা অরিত্রই। এখানে কী করছে ও? ফটোগ্রাফি? তাও আবার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের? বিষয়টা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। আজ আট বছর হল অরিত্র স্টেটস্-এ। কবে এল দেশে?
“চন্দ্রাবতী!”
চমকে উঠে দেখি অরিত্র আমার সামনে। আমি অবাক হয়ে দেখছি ওকে। ও তাড়াতাড়ি মাস্ক খুলে বলল, “আমি, আমি অরিত্র।”
সত্যি কথা বলতে কী প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলেও আমি সহজ হতে পারছি না।
“চন্দু আমাকে কি চিনতে পারছ না? আমি অরিত্র ঘোষ।”
সম্বিত ফিরে বললাম, “তুমি এখানে হঠাৎ?”
“হঠাৎ নয়। আমি গত মাসে দেশে ফিরে মোটামুটি যতগুলো পেরেছি মন্দিরের ফটো শুট করেছি। একটা অ্যালবাম বের করব। যাই হোক তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল খুব ভাল লাগছে।”
আমি লক্ষ্য করলাম অরিত্রের চোখে-মুখে খুশি। অরিত্র হঠাৎ এ দিক-ও দিক তাকিয়ে বলল, “এখানে একা? নাকি সঙ্গে কেউ আছেন?”
আমি জানি ও আমার স্বামী বা ঐ জাতীয় কাউকে ইন্ডিকেট করছে। মাথা নাড়লাম। “না আমি একা। হোটেলের রুমে অবশ্য বাবা আছেন।”
“আচ্ছা স্যার আর তুমি এসেছ? কতদিন দেখিনি স্যারকে। কেমন আছেন উনি?”
“তুমি নিজেই দেখে যেতে পারো।”
“ওহ্ শিওর শিওর। কোন হোটেলে উঠেছ?”
আমি নাম বললাম। অরিত্র তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডেকে বলল, “উঠে পড়ো।”
অরিত্রর পাশে বসব? কিন্তু কেন? ও আমাকে অপমান করেছিল। সেই অরিত্রের সঙ্গে এক রিকশায় বসব?
আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরিত্র বলে উঠল, “কী চন্দু কী ভাবছ?”
আমি অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি বললাম, “আমি একটু স্বর্গদ্বার মার্কেট ঘুরে হোটেলে ফিরব। তুমি হোটেলে যেতে পারো রুম নাম্বার ৩১২।”
অরিত্র হাসল। “তোমার আপত্তি না থাকলে আমিও তোমার সঙ্গে মার্কেটে যেতে পারি।”
রিকশাওলা দাঁড়িয়ে আছে, একটু বিরক্ত যেন। অরিত্র আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মতামত জানার জন্য। আমি শাড়ির কুঁচি আর ব্যাগ সামলে অগত্যা রিকশায় উঠলাম। অরিত্র উঠে রিকশাওলাকে “স্বর্গদ্বার মার্কেট যাব” বলতেই সে প্যাডেলে চাপ দিল।
অনেক দিন পর অরিত্রকে
দেখলাম। বুকের ভেতর অনেক অভিমান যন্ত্রণা ছিল এক সময়। এখন জগন্নাথ আমাকে শান্তি দিয়েছেন।
লোকে বলে প্রথম প্রেমই শ্রেষ্ঠ প্রেম। কথাটার সত্যি-মিথ্যে না জানলেও এটুকু জানি এ
প্রেম ভেঙে গেলে তার যন্ত্রণা অবর্ণনীয়।
“চন্দু মাসিমা এলেন না?”
আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, একটু সময় লাগল কথাটা বুঝতে। বুঝে বললাম, “মা এখন নিজেই জগন্নাথের কাছে।”
অরিত্র ঘুরে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি ওর চোখে ক্ষণিকের জন্য বিষাদ দেখলাম। জিজ্ঞেস করল, “কবে? কী হয়েছিল?”
“আজ পাঁচ বছর। সেরিব্রাল অ্যাটাক।”
দু’জনে আবার চুপ। রিকশার প্যাডেলের ঘটাং ঘটাং শব্দে সরু গলির মধ্য দিয়ে চলেছি। সম্ভবত এটা স্বর্গদ্বার মার্কেটের শর্টকাট রাস্তা।
“চন্দু মাসিমা এলেন না?”
আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, একটু সময় লাগল কথাটা বুঝতে। বুঝে বললাম, “মা এখন নিজেই জগন্নাথের কাছে।”
অরিত্র ঘুরে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি ওর চোখে ক্ষণিকের জন্য বিষাদ দেখলাম। জিজ্ঞেস করল, “কবে? কী হয়েছিল?”
“আজ পাঁচ বছর। সেরিব্রাল অ্যাটাক।”
দু’জনে আবার চুপ। রিকশার প্যাডেলের ঘটাং ঘটাং শব্দে সরু গলির মধ্য দিয়ে চলেছি। সম্ভবত এটা স্বর্গদ্বার মার্কেটের শর্টকাট রাস্তা।
কত কী পুরনো কথা মনে
ভিড় করে আসছে। বাবা প্রিয় ছাত্র অরিত্রের পিএইচডি-র মেন্টর ছিল। বিষয় ছিল মলিকিউলার
ফিজিক্স-এর কোনও একটা পার্ট। আমার সাবজেক্ট সম্পূর্ণ আলাদা। আমি তখন এমবিবিএস-এর ছাত্রী।
কী করে যেন দু’জনের বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। মা জানত সবটা। আমাকে আর অরিত্রকে নিয়ে অনেক
দূর পর্যন্ত ভেবেও ফেলেছিল মা। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি অরিত্রের কাছে আমি মূল্যহীন হয়ে
যাচ্ছিলাম। অরিত্র ঘোর নাস্তিক। আমার ঈশ্বর বিশ্বাসের সঙ্গে কারণে-অকারণে প্রায় জোর
করেই ডিবেটে জড়াত। আমি ওর সঙ্গে তর্কে জিততে পারতাম না। কঠিন কথায় আমার মনকে ক্ষতবিক্ষত
করে দিত। অরিত্র আমাকে কথায় কথায় নিচু করত। বুকের ভেতর কষ্ট নিয়ে আমি লুকিয়ে কাঁদতাম।
সম্পর্কটা দরকচা মেরে গেছিল। ওর পিএইচডি কমপ্লিট হতেই ও চাকরি নিয়ে স্টেটসে চলে গেল।
প্রথম প্রথম দু’একটা দায়সারা ফোন করত। পরে সব বন্ধ। মা বোধহয় বুঝেছিল কিছুটা। আমাকে
বলত, “অরিত্র তোর উপযুক্ত নয়। জগন্নাথ যা করেন ভালর জন্যই করেন।” আমি তা মেনে নিলেও
কোথাও অপমানের কাঁটাটা এখনো খচখচ করে।
হঠাৎ অরিত্র বলে উঠল, “চন্দু তুমি কি এখানে প্রায়ই আসো?”
“হ্যাঁ, প্রতি বছর, কেন?” তাকিয়ে দেখি আমরা সমুদ্রের ধারে মেইন রোডে উঠে পড়েছি।
“একই মন্দির বার বার দেখার কী আছে? অন্য কোথাও যেতে পারো ঘুরতে?”
“আমি তো ঘুরতে আসি না? আমি প্রভু জগন্নাথকে কাছ থেকে অনুভব করতে আসি।”
আমার কথায় অরিত্র হেসে বলল, “তুমি দেখছি একটুও বদলাওনি। সেই বোকা বোকা কথা। আরে বাবা ঈশ্বর বলে যদি কিছু থাকে তা একমাত্র সায়েন্স, আর কিছু না।”
মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। রিকশাওলাকে বললাম, “দাঁড়াও নামব।”
অরিত্র বলে উঠল, “আরে এখনো স্বর্গদ্বার আসেনি। এখানে নেমে কী করবে?”
আমি শাড়ি সামলে নেমে বললাম, “অরিত্র তোমার বিশ্বাস নিয়ে তুমি থাকো। শুধু আমার বিশ্বাসে আঘাত করার অধিকার তোমাকে কখনো দিইনি মনে রাখবে।”
অরিত্র একটু থতমত খেয়ে রিকশা থেকে নেমে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিল। আমাদের হোটেল পাশেই কিন্তু এই মুহূর্তে অরিত্রকে সঙ্গে নিয়ে আমি হোটেলে ফিরতে চাই না। আমি রাস্তা পার হয়ে সমুদ্রতটে নেমে যেতে থাকলাম। না তাকিয়েই বুঝতে পারছি অরিত্র সঙ্গ ছাড়েনি। অচিরেই সামনে এসে দাঁড়াল অরিত্র। “চন্দু তুমি এভাবে রিয়্যাক্ট করবে জানলে আমি বলতাম না। প্লিজ কিছু মনে কর না।”
“আমি হাসলাম। “অরিত্র মন্দিরের মাথার পতাকাটা কখনো খেয়াল করছ?”
অরিত্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
হঠাৎ অরিত্র বলে উঠল, “চন্দু তুমি কি এখানে প্রায়ই আসো?”
“হ্যাঁ, প্রতি বছর, কেন?” তাকিয়ে দেখি আমরা সমুদ্রের ধারে মেইন রোডে উঠে পড়েছি।
“একই মন্দির বার বার দেখার কী আছে? অন্য কোথাও যেতে পারো ঘুরতে?”
“আমি তো ঘুরতে আসি না? আমি প্রভু জগন্নাথকে কাছ থেকে অনুভব করতে আসি।”
আমার কথায় অরিত্র হেসে বলল, “তুমি দেখছি একটুও বদলাওনি। সেই বোকা বোকা কথা। আরে বাবা ঈশ্বর বলে যদি কিছু থাকে তা একমাত্র সায়েন্স, আর কিছু না।”
মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। রিকশাওলাকে বললাম, “দাঁড়াও নামব।”
অরিত্র বলে উঠল, “আরে এখনো স্বর্গদ্বার আসেনি। এখানে নেমে কী করবে?”
আমি শাড়ি সামলে নেমে বললাম, “অরিত্র তোমার বিশ্বাস নিয়ে তুমি থাকো। শুধু আমার বিশ্বাসে আঘাত করার অধিকার তোমাকে কখনো দিইনি মনে রাখবে।”
অরিত্র একটু থতমত খেয়ে রিকশা থেকে নেমে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিল। আমাদের হোটেল পাশেই কিন্তু এই মুহূর্তে অরিত্রকে সঙ্গে নিয়ে আমি হোটেলে ফিরতে চাই না। আমি রাস্তা পার হয়ে সমুদ্রতটে নেমে যেতে থাকলাম। না তাকিয়েই বুঝতে পারছি অরিত্র সঙ্গ ছাড়েনি। অচিরেই সামনে এসে দাঁড়াল অরিত্র। “চন্দু তুমি এভাবে রিয়্যাক্ট করবে জানলে আমি বলতাম না। প্লিজ কিছু মনে কর না।”
“আমি হাসলাম। “অরিত্র মন্দিরের মাথার পতাকাটা কখনো খেয়াল করছ?”
অরিত্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
“আচ্ছা দেখনি? দেখলে খুব অবাক হতে। পতাকা সবসময় যে দিক দিয়ে হাওয়া আসে ঠিক তার বিপরীত দিকে উড়ে যায়। এই তো তোমার সায়েন্স বলে, তাই না?”
অরিত্র মাথা নাড়ল। “অ্যাবসোলিউটলি।”
“জগন্নাথ মন্দিরের চুড়োর পতাকাটা দেখে এসো, তোমার সায়েন্স ফেল করবে।”
“মানে?” অরিত্র উত্তেজিত।
“মানে হাওয়া যে দিক দিয়ে আসে পতাকা সেদিকেই উড়ে যায়।”
অরিত্র হতভম্বের মতো তাকিয়ে আমার মুখে।
“আরো শুনবে? জগন্নাথদেবের ভোগ হয় চুলার উপর একটার পর একটা করে সাতটা মাটির হাঁড়ি বসিয়ে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় সব থেকে আগে রান্না হয়ে যায় সব থেকে উপরের হাঁড়ি। এভাবে সব থেকে শেষে হয় নীচের হাঁড়ির রান্না।”
অরিত্র বিড়বিড় করল, “ইমপশিবল।”
“পশিবল অরিত্র। বিশ্বাস না হলে দেখে এসো। আরো শুনবে? মন্দিরে প্রধান গেট মানে সিংহদ্বারের বাইরে সমুদ্রের হাওয়ার শব্দ শোনা যায়। সিংহদ্বার পার হলেই আর কোনো শব্দ তুমি পাবে না। আরো আছে, মন্দিরের ঠিক মাথার ওপর দিয়ে কোনও পাখি উড়তে দেখা যায়নি আজ পর্যন্ত, এমন কী আজ পর্যন্ত যায়নি কোনও বিমানও।”
অরিত্র কী একটা বলতে যাচ্ছিল। আমি থামিয়ে দিয়ে বলি, “দাঁড়াও দাঁড়াও আরো আছে। পুরী মন্দিরের চূড়ার ছায়া বছরে দিনের কোনও সময়ই নীচে পড়ে না। মন্দিরের উপরে কুড়ি কেজি ওজনের সুদর্শন চক্র পুরী শহরের যে-কোনও জায়গা থেকে দেখা যায়। আড়াল আবডাল কাটিয়ে কীভাবে তা সম্ভব আজও তা রহস্য।”
অরিত্র হতভম্বের মতো আমার কথা শুনছে। আমি আরো বলে চললাম, “তুমি নিশ্চয়ই জানো দিনের বেলা সমুদ্রের দিক থেকে স্থলের দিকে বাতাস বয় যাকে সমুদ্রবায়ু, আর রাতে স্থলভাগ থেকে সমুদ্রের দিকে বাতাস বয় যাকে স্থলবায়ু বলে। সারা বিশ্বে এটাই হয়। অথচ পুরীতে তার বিপরীত। আরো অনেক কিছু আছে তোমাকে বলার মতো। যেমন ধরো হাঁড়ির ওপর হাঁড়ি বসিয়ে যে এক-একটি বিশেষ পদ তৈরি হয় তা জগন্নাথের ভোগ। এই ভোগ সে দু’হাজারই হোক বা কুড়ি হাজারই হোক, যত পূণ্যার্থীই রোজ খান-না কেন এই ভোগ কখনই কম পড়েনি আজ পর্যন্ত। জগন্নাথের প্রসাদ কখনও নষ্ট হয় না। এগুলোকে তোমার সায়েন্স কীভাবে ব্যাখ্যা করবে অরিত্র?”
অরিত্র চুপ।
আমি গভীর শ্বাস নিলাম। “যাক এতদিনে হয়তো বুঝেছ সবকিছু বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করা যায় না। বিজ্ঞানের উপরেও আরো কিছু আছে।”
সমুদ্রের হাওয়ার আমার
চুল এলোমেলো। পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়ে গেল ছোট্ট একটা ঢেউ। আমি আঁচল সামলাচ্ছি অরিত্র
হঠাৎ দুহাত দিয়ে আমার দুটো হাত জড়িয়ে ধরল। আমাকে অবাক করে নিচু গাঢ় স্বরে বলল, “আমাকে
একবার নিয়ে যাবে চন্দু, জগন্নাথের মন্দিরে?”
আমি দেখলাম সকালের নরম আলো ওর চোখেমুখে পড়ে অদ্ভুত দ্যুতি ছড়াচ্ছে। মনে মনে প্রভু জগন্নাথদেবকে প্রণাম করলাম। দেখলাম বিশাল বড় একটা ঢেউ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। সরে গেলাম না, কেন জানি না আজ বড় ভিজতে ইচ্ছা করছে।
আমি দেখলাম সকালের নরম আলো ওর চোখেমুখে পড়ে অদ্ভুত দ্যুতি ছড়াচ্ছে। মনে মনে প্রভু জগন্নাথদেবকে প্রণাম করলাম। দেখলাম বিশাল বড় একটা ঢেউ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। সরে গেলাম না, কেন জানি না আজ বড় ভিজতে ইচ্ছা করছে।
ডীষণ ভালো উদ্যোগ, এই পত্রিকাটি পড়ে অনেক মানুষ সমৃদ্ধ হবেন।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল। 🌹
ReplyDelete