প্রথম বর্ষ/দ্বিতীয়
সংখ্যা/১লা মে, ২০২৩
হলদে খাম
কৃতিকণা চিনি
পৃথুর
উদ্দেশ্যে সমু
প্রিয়বরেষু,
প্রণিপাত না করিয়া
আমার এ-হেন সম্বোধনে ইতিহাস বিস্মিত হইলেও, আপনি সেই ভুবন ভুলানো হাসিটিই উপহার
দিবেন, জানি। মনে মনে বলিবেন, “পূর্বের ন্যায় ‘প্রিয় পৃথু’ লিখিলে আরও খুশি
হইতাম সমু। লোকে জানিত, শুধুমাত্র জাদুকরী সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণীই
নহে, সে যুগেও কতটা আধুনিকা ছিলে তুমি। রাজস্থান, হরিয়ানা, দিল্লি, পাঞ্জাব,
মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের নিয়ন্ত্রক রাজাধিরাজ হইয়াও প্রাণ-পণ করিয়াছিলাম
তোমায় পাইবার জন্য, সে কি অকারণ?”
নাহ্! কিছুই অকারণ নহে।
জানিলে প্রীত হইবেন যে, আপনার সভাকবি চারণকবি চাঁদ বারদাই রচিত মহাকাব্য ‘চাঁদ
রাইসা’র কল্যাণে খতিয়ানের নিরিখে এই মুহূর্তে আমরা ভারতের সর্বাধিক জনপ্রিয়
মধ্যযুগীয় প্রণয়ী জুটি। মাঝে শুধু স্রোতের মতন ভাসিয়া যাওয়া আটশত তিরিশ বৎসর!
জন্মান্তরের ফাঁক গলিয়া অদ্য পুনরায় আপনাকে পত্র লিখিতে বসিয়াছি। তবে এ-যুগে আর
পত্র লিখে না কেহ। প্রিয়তমের একটি সন্দেশের আশায় গবাক্ষে আঁখি বিছাইয়া বসিয়া
থাকিতে হয় না। অত্যাধুনিক পরিকাঠামোর সাহায্যে মুহূর্তেই বার্তা পৌঁছাইয়া যায়
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। যদি সে যুগেও এমন সুবিধা থাকিত, তবে আপনার প্রিয় দুধি
পারাবতের ডানা-দুইটির কিঞ্চিৎ আরাম মিলিত।
কোথায় কেমন আছেন আপনি,
বড় জানিতে মন চাহে। আমার ন্যায় কি আপনিও জাতিস্মর? মনে পড়ে সে জনমের কথা?
হস্তিনাপতি, অসীম বীর রাজপুত ক্ষত্রিয় আপনি। পিতা সোমেশ্বর, মাতা বীরাঙ্গনা
কর্পূরি দেবী। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ ছাপাইয়া আফগানিস্তান পর্যন্ত ছড়াইয়া
পড়িয়াছিল আপনার বীরত্বের খ্যাতি। দ্বাদশ শতকের মধ্য ভাগে আপনার তুল্য শক্তিশালী
রাজা আর কেহই ছিল না। দুই-দুইখানি রাজধানী ছিল আপনার, একটি আজমেঢ়ে, অপরটি
দিল্লিতে। তাই, আপনার প্রেমে পড়ে নাই, সমকালীন এমন রাজকন্যা মেলা ভার। আপনার
পূর্বতন দুই স্ত্রী রাজকন্যা শশিব্রত এবং পদ্মাবতীই তার যথেষ্ট উদাহরণ নহে কি?
আমি ব্রাহ্মণকন্যা,
পরশুরামের বংশধর। পিতা কনৌজরাজ জয়চন্দ্র, আপনার কট্টর প্রতিদ্বন্দ্বী। সখীদের
নিকট আপনার জ্ঞান ও শৌর্যের খ্যাতি শুনিয়া এবং আপনার সভাসদ শিল্পী পান্না রায়
অঙ্কিত আপনার ছবি দেখিয়া প্রেমে পড়িলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম, বিবাহ করিতে
হইলে আপনাকেই করিব। তবে, পান্না রায় অঙ্কিত তৈলচিত্রে আমার প্রতিকৃতি দর্শন
করিয়া আপনিও যে প্রেমে পড়িয়াছিলেন, সে কথা আপনি নিজ মুখে বহুবার স্বীকার
করিয়াছেন।
প্রিয় সখী মদনার
সাহচর্যে গোপনে ছদ্মবেশে গহন অরণ্যে অবস্থিত কোটেশ্বর মন্দিরের নির্জন প্রাঙ্গণে
চার চক্ষুর মিলন হইল, হইল ভালবাসার অঙ্গীকার। তাহার পর হইতে আপনার শিক্ষিত
পারাবতের মাধ্যমে নিয়মিত চলিতে লাগিল প্রেমপত্র আদানপ্রদানের কার্য। কিন্তু সে
প্রেমকথা পিতার কর্ণে পৌঁছাইতেও বিলম্ব হইল না। আপনাকে অপদস্থ করিবার অভিপ্রায়ে
তিনি রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করিয়া বিভিন্ন রাজ্যে দূত প্রেরণ করিলেন। সকলে বশ্যতা
স্বীকার করিলেও, আপনি বাঁকিয়া বসিলেন। কনৌজ রাজের রাজসূয় যজ্ঞ পন্ড হইল। ক্রুদ্ধ
পিতা আপনাকে উচিত শিক্ষা দিবার নিমিত্ত আমার স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করিলেন, যাহাতে
আপনি ব্যতীত দেশ-বিদেশের সকল রাজার আমন্ত্রণ রহিল। পিতার আদেশে সভাগৃহের দ্বারদেশে
দ্বাররক্ষীর ন্যায় আপনার একটি প্রস্তর মূর্তি স্থাপন করা হইল। সখী মদনার নিকট এই
সংবাদ শুনিয়া মস্তকে আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। পত্র লিখিলাম, “মনে মনে আপনাকেই স্বামী
রূপে বরণ করিয়াছি, এমতাবস্থায় আমাকে বিবাহ করিয়া আপনার সন্নিধানে লইয়া যান।”
উত্তরে লিখিলেন, “চিন্তা করিও না। নির্দিষ্ট সময়ে যাইয়া তোমাকে বিবাহ করিয়া
লইয়া আসিব। তাহাতে যদি আমাকে মৃত্যুবরণ করিতে হয়, তবে সেই মৃত্যু আমি বীরের
ন্যায় গ্রহণ করিব।” পরবর্তী ঘটনা কাহারও
অজ্ঞাত নহে। ‘পৃথ্বীরাজ কতৃক সংযুক্তা অপহরণ’ নির্দ্বিধায় স্থান করিয়া লইয়াছে
পাঠ্যপুস্তকে।
দিল্লি ফিরিয়া
মহা-সমারোহে বিবাহ সম্পন্ন হইল। চৌহান রাজ পৃথ্বীরাজ এবং তাঁর প্রেয়সী স্ত্রী
সংযুক্তার প্রেমকাহিনি মুখে মুখে ফিরিতে লাগিল। অপরদিকে, আমাদের এহেন বিবাহে
অপমানিত, ক্রোধে অন্ধ পিতা প্রতিশোধ লইতে আফগানিস্তানের মহম্মদ ঘোরীর সহিত হাত
মিলাইলেন। ইতিপূর্বে বহুবার ঘোরী দিল্লি আক্রমণ করিয়া ব্যর্থ হইয়াছিলেন। এইবার
কনৌজ-রাজের নিকট সাহায্যের প্রতিশ্রুতি
পাইয়া নব উদ্যমে দিল্লি আক্রমণ করিলেন। অতঃপর, ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে তরাইনের প্রথম
যুদ্ধে আপনার হস্তে পুনরায় পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী বৎসর ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে
আরবার আক্রমণ করিলেন।
দূত মারফৎ তরাইনের ভয়াবহ
দ্বিতীয় যুদ্ধে আপনার পরাজয় ও বন্দি হইবার সংবাদ আসিতে না আসিতেই, তুর্কি
বাহিনীর সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় অরক্ষিত দিল্লি নগরে অনুপ্রবেশের সংবাদ পাইয়া,
বিধর্মী তুর্কিগণের অত্যাচার আর ধর্ষণের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইতে রাজমাতা কর্পূরি
দেবী-সহ দিল্লিস্থিত চৌহান রাজবংশীয় সকল রমনীগণ সূর্য কুন্ডের পার্শ্ববর্তী
অঞ্চলে গণ-চিতা প্রজ্বলিত করিবার সিদ্ধান্ত লইলেন। রাজপুত-জায়া আমি, তবু এ
সিদ্ধান্তে বক্ষ কাঁপিয়া উঠিল! আমি যে সন্তানসম্ভবা! আমাদের প্রেমগাথার একমাত্র
নিদর্শন, রাজাধিরাজ পৃথ্বীরাজ চৌহানের সন্তান আমার গর্ভে! কেবলমাত্র আমি ছাড়া এ
সংবাদ যে স্বয়ং আপনারও অজ্ঞাত ছিল...
তাই সে কথা অজ্ঞাত এবং
অলিখিতই রহিয়া গিয়াছে চিরকাল। হ্যাঁ, সম্মান রক্ষার্থে অন্যান্য রাজপুত রমণীগণের
সহিত জহরব্রত পালন করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। ইহজীবনে জাতিস্মর আমি। শুনিয়াছি
ত্রয়োদশ বার মানবজন্মের পর মুক্তি মিলে। জানি না, এ আমার কত তম জন্ম! ইহা সত্য,
যে চাঁদ বারদাই রচিত মহাকাব্য পাঠ না করিলে এত সত্বর সকল কথা স্মরণে আসিত কিনা
সন্দেহ। তবে, বিস্মৃতির অবগুণ্ঠন ঘুচিয়া যাইবার পর বুঝিয়াছি, এ-গ্রন্থে বহু কিছু
অলিখিত এবং অনেকাংশই মনগড়া।
যাহা হউক, যে রাজকীয়
প্রেম-স্মৃতি আমার নিদ্রা হরণ করিয়াছে, তাহার কিয়দংশ আপনার সহিত বন্টন করিয়া
লইতে এ পত্রখানি লিখিলাম। অনুরোধ রহিল, প্রিয় সুশিক্ষিত পারাবতটিকে পাঠাইয়া
দিবেন এ পত্রখানি আপনার নূতন ঠিকানায় পৌঁছাইয়া দিতে। জন্ম-জন্মান্তরের প্রেম
লইবেন।
ইতি—
আপনার প্রাণপ্রিয় সংযুক্তা
আপনার প্রাণপ্রিয় সংযুক্তা
'চিঠি লেখা'ও প্রায় বিলুপ্তির পথে। আসুন না, সবাই মিলে বাঁচিয়ে রাখি এই ঐতিহ্যকে... চিঠি লিখি, যার যাকে ইচ্ছে, আর 'হলদে খাম'এ মুড়ে পাঠিয়ে দিই বাতায়নে।
ReplyDeleteExcellent
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ 🙏
DeleteVery nice 👌
ReplyDeleteধন্যবাদ 🙏 ভালো থাকুন।
Deleteঅসাধারণ লাগল। সমৃদ্ধ হলাম
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো পড়ে
ReplyDeleteসুন্দর
ReplyDelete