প্রথম বর্ষ/দ্বিতীয়
সংখ্যা/১লা মে, ২০২৩
অন্য চোখে
জ্যোৎস্না মন্ডল
প্রবহমান
জানালার পাশে বসে আছি— একা নিরালা নিভৃতে। বিকেলের ঢাল বেয়ে
সন্ধ্যা নামছে একটু একটু করে। একটা সুর বারে বারে পাকদন্ডীর মতো মনের অলিগলিতে
অনুরণিত হচ্ছে। দূরে অপসৃয়মান ত্বিষাম্পতির অন্তিম রক্তরাগ। সেই
ছেলেবেলায় অপরিণত অমল মনে যে গানটি রেখে গেছে তার চরণচিহ্ন, সেই গানটি গেয়ে
উঠলাম গুন গুন করে।
“আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে
অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে—”
জন্মের পর থেকেই সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে বিকশিত হতে থাকে আমার মেয়েবেলা। বাড়ির ভিন্ন ভিন্ন ঘরে শাস্ত্রীয় সংগীতের রেওয়াজ আমার কানে প্রবেশের মাধ্যমে গড়ে তোলে সাংগীতিক সত্তা। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সহজ পাঠ ও আদর্শ লিপি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। অভিভাবকদ্বয়ের মানসিক চাহিদা ফলপ্রসূ হতে থাকে আমার শিক্ষা ও সংগীতে।
“আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে
অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে—”
জন্মের পর থেকেই সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে বিকশিত হতে থাকে আমার মেয়েবেলা। বাড়ির ভিন্ন ভিন্ন ঘরে শাস্ত্রীয় সংগীতের রেওয়াজ আমার কানে প্রবেশের মাধ্যমে গড়ে তোলে সাংগীতিক সত্তা। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সহজ পাঠ ও আদর্শ লিপি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। অভিভাবকদ্বয়ের মানসিক চাহিদা ফলপ্রসূ হতে থাকে আমার শিক্ষা ও সংগীতে।
মাত্র তিন বছর বয়সে জনগণের সম্মুখে সংগীত পরিবেশনের অভিজ্ঞতা
হয়। রবীন্দ্রনাথের “আয় তবে সহচরী” গানটি পরিবেশন করে বিদ্যাসাগর অঞ্চলের বয়স্ক
মানুষদের ভূয়সী শংসা লাভ করেছিলাম। আজও তাদের উত্তরসূরীদের কাছে অন্তরঙ্গ হয়ে
থাকতে পেরেছি ঈশ্বর এবং গুরুজনদের কৃপায়।
রবীন্দ্রনাথের গানের গভীরতা বোধাতীত হলেও সেই গভীরে নিমজ্জিত
হতে থাকি একটু একটু করে। নবম শ্রেণীতে হঠাৎই আমার মেজদির হাত ধরে একদিন পৌঁছে
গেলাম আমাদের বাড়ির খুব কাছেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লোকসংগীত ও গণসংগীত
শিল্পী শ্রী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাড়ি। তিনি বললেল, “লোকগান শিখতে চাইলেই কী শিখন
যায়।” তিনি আমাকে একটি লোকগান গাইতে বললেন। ঐ সময় রুণা লায়লার কয়েকটি গান
ছাড়া আমি বিশেষ কিছুই জানতাম না। অত্যন্ত দ্বিধা নিয়ে গাইলাম “সুজন মাঝি রে, কোন
ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও”। উনি সেই দিনই আমাকে ক্লাসে ভর্ত্তি করিয়ে নিলেন। ওনার
সান্নিধ্যে শুরু হল আমার লোকসংগীত শিক্ষা। শুধু গানই নয়, শিখলাম গানের অর্থ,
গানের প্রেক্ষাপট, গানের ইতিহাস, রচয়িতাদের জীবনী, গায়নশৈলী, আঞ্চলিক গানের ভাষা
ও উচ্চারণ, আরও কত কী। রক্ত-মজ্জা-শিরা-উপশিরায় বইতে থাকে বিভিন্ন অঞ্চলের
জনজীবনের লোকসুর, কৃষ্টি এবং সামাজিক প্রতিবেশ। ১৯৮৭ সালের ২২শে নভেম্বর ওঁর
দেহাবসানের পর মনে হল আমি পিতৃহীনা হলাম। অকূল সমুদ্রে ভাসমান তরি নিয়ে পাড়ে
পৌঁছনো আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল সেদিন। এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত নিলাম
বিখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী শ্রী অমর পালের কাছে লোকগানের তালিম নেব। ভাবনার দ্রুত
বাস্তবায়ন আমার স্বভাবগত। শিখতে শুরু করলাম বিভিন্ন আঙ্গিকের লোকগান। লোকগানের দিক্পাল
শ্রী দিণেন্দ্র চৌধুরীর সান্নিধ্যে লোকগান শিক্ষা গ্রহণ করার বাসনা ছিল আমার বহু
দিনের। একই সময়ে তাঁর কাছেও আরম্ভ হল লোকসংস্কৃতির শিক্ষা। এই দুই ঘরানার
সমন্বয়ে আমার সংগীত জীবন সমৃদ্ধ হতে লাগল। অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই তিন
গুরুর কাছে আমি দীর্ঘ দিন তালিম নিয়ে লোকগানের ভিতকে সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেছি।
তবে লোকগান শুধুমাত্র গুরুমুখী বিদ্যা না হলেও সঠিক গায়নশৈলীর জন্য গুরুগৃহে শিক্ষানবিশ
থাকা অত্যাবশ্যক। শুরু হল লোকগান সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে
গ্রামে ঘুরে বেড়ানো। বিভিন্ন আঙ্গিকের লোকগান সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে এক পরম
তৃপ্তি এবং প্রাপ্তি। এই সংগ্রহের মধ্য দিয়ে অনেক মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে
সম্পর্কিত হলাম, শিখলাম সুরের প্রকারভেদ, উপলব্ধি করলাম মানবিক সম্পর্ক ও তার
ঔদার্য, সহবতবোধ এবং জীবনের সারল্য। এই সংগ্রহের কোনো শেষ নেই— যতদিন বাঁচি ততদিন
শিখি, বেঁচে আছি তাই এখনও
শিক্ষার্থী— সবার কাছে।
বিখ্যাত নাটক নির্দেশক শ্রী বিভাস চক্রবর্তীর পরিচালনায়
ময়মনসিংহের গীতিকা অবলম্বনে “মাধব মালঞ্চী কইন্যা” নাটকে লোকগানে অংশগ্রহণ করে
নিজের পরিধিকে আরো সুবিস্তৃত করতে পেরেছিলাম। এই নাটকে সুরারোপ করেছিলেন শ্রদ্ধেয়
শ্রী দিণেন্দ্র চৌধুরী। সেই সুবাদে তার কাছে আমরা ছিলাম অত্যন্ত প্রিয়, কাছের জন।
সুযোগ ঘটেছিল গান গাইবার পাশাপাশি অভিনয় করার- প্রখ্যাত পরিচালক বিভাস চক্রবর্তীর
পরিচালনায়। এ এক পরম প্রাপ্তি। এই অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটল আমার “কনক
কথা” গীতি আলেখ্যতে। ২০১৮ সালে উত্তম মঞ্চে এই গীতি আলেখ্যটি পরিবেশনার মাধ্যমে
আমার সৃজন সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দীর্ঘ ৪০ বছর একক অনুষ্ঠান করার পর আমার মনে হল
সব লোকগান একক পরিবেশনে সুখশ্রাব্য হয় না। সেজন্য দল গঠনের ভাবনা মনে আসা মাত্রই
২০১৭ সালের ১লা মে শ্রমিক দিবসে গড়ে তুললাম মহিলা লোকগানের দল “রঙ্গিলা নাও”।
মেয়েরা নিজের শিল্পী পরিচয়ে পরিচিতি পাবে তাতেই হবে আমার দল গঠনের সার্থকতা।
শুরু হল আমার জীবনের স্বপ্নের বাস্তব যাত্রা।
ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতে ভালবাসতাম। এখনো পর্যন্ত ৩০০-র অধিক
গান তৈরি করেছি শুধু নিজের বা দলের জন্য নয়। বহু লোকসংগীত শিল্পী আমার গান
গেয়েছেন এবং গাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন - এ আমার জীবনের সুখদায়ক অনুভব। ৩৫টি
গানের রেকর্ডিং সম্পন্ন হয়েছে। নিজের সংগীতায়োজনে বহু গান জনসমক্ষে আজ প্রকাশিত হয়েছে।
সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে লোকসংগীত কর্মশালার আয়োজকগণের আহ্বানে আমার স্বল্প
জ্ঞানার্জনের ভাণ্ডার উজার করে দিতে পারার মধ্যে রয়েছে এক আত্মতৃপ্তি। এভাবেই
নতুন প্রজন্মকে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তোলা আমাদের
দায় ও দায়িত্ব। লোকসংগীত শিল্পী হয়ে এ কথাই বলব, লোকসংগীতের দ্বার সকলের জন্য
উন্মুক্ত হোক। সবার মননে চিন্তনে লোকসংগীত বেঁচে থাকুক- এই প্রত্যাশা।
বাহ! ভালো লাগল বেশ।
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই
ReplyDeleteভালো লাগল - জয়িতা
ReplyDelete