ধারাবাহিক গল্প
পর্ব ১
সীমা ব্যানার্জী-রায়
মিলির ইন্টারভিউ
মিলি এখন পুরোপুরি আঠারো বছরের এক যুবতী। সবে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে। এক পিঠ কালো মেঘের মতন কোঁকড়ানো চুল আর পাতলা ছিপছিপে চেহারায় একটা খুব মিস্টিসুলভ হাবভাব আছে। স্কুলের গণ্ডি পার হবার
সাথে সাথে মায়ের সর্ব প্রথম চিন্তা শুরু হয়, যা এখনও বজায় আছে কোন কোন মেয়েদের বাড়িতে। মেয়ের মা-বাবার হাতে থাকুক-না ডিজিটাল ফোন, থাকুক-না গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স, তাতে কী? মেয়ে মানেই, কর্তব্য মতো তার বিদায়ের দায়িত্বটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতেই হবে। তারপর না-হয় ইনিয়ে বিনিয়ে একটা আস্ত গল্প। কাজেই মিলির মায়ের চাহিদা— এখনই মেয়েকে ভাল পাত্রের হাতে তুলে দিতে হবে। আঠারো থেকে তেইশ বয়সটাই নাকি মেয়েদের বিয়ের আসল বয়স।যেখানে যত
আত্মীয়স্বজন আছে, সবাইকে বলা হল ভাল পাত্র সন্ধানের জন্য। মিলি
বিয়ের নামে কখনোই আপত্তি করেনি। কারণ সে জানত, বিয়ে না করলে
মা-বাবার
বোঝা হয়ে সারাজীবন থাকা মোটেই সুখের নয়। ছোট বেলা থেকে তার ডিভোর্সি মাসিকে দেখেছে, উঠতে
বসতে শুনতে হয়েছিল বিদেশে থাকা এক মামার মুখে যে, ‘একটা ছেলেকে ধরে রাখতে পারিসনি, তুই তো
পড়ে যাবিই জীবন থেকে।’ –কখন বলেছিল? সেই ছোট মাসি
যখন আচমকা পা পিছলে পড়ে গেছিল। মিলির চেয়ে মাত্র চার বছরের বড় সেই মাসি। ডিভোর্স
হবার পর থেকেই মামার বাড়ি ঝকঝকে তকতকে করে রাখত। তার মধ্যেই পড়াশোনা, গানবাজনা
নিয়ে খুব নাম করেছে এখন। আলাদা থাকে। বেশ করে।
মিলির এই বিয়ের
ব্যাপারে একটাই শুধু আপত্তি ছিল। বিয়ের পরে সে কলকাতার বাইরে পা রাখতে চায় না। সে
চায় বাবা-মায়ের বাড়ির
আনাচেকানাচে থাকতে। মনে যদিও একটু ইচ্ছে ছিল বৈকি যে, অন্য
বন্ধুদের মতো সেও অন্তত কলেজের একটা ডিগ্রি
হাতে পাক। মায়ের আসলে খুব চিন্তা ওর কালো রঙের জন্য। আজকালকার দিনেও মেয়েদের কালো
রং নিয়ে কত চিন্তাভাবনা করেন মা-বাবা ও বাড়ির পরিজনেরা। তার বাবা কিন্তু এ’রকম না। বাবার
খুব গর্ব মিলিকে নিয়ে। রং কালো হলেও বাবাকে বলতে শোনে, ‘আমার মিলির
মুখের মতন একটা মুখ দেখাও দেখি। পারবে না। তার ওপরে অত সুন্দর সেতার বাজায় যখন, আমরা
নিজেদের মেয়েকেই দেখি অবাক হয়ে, কি গো দেখি না?’ বাবার
জ্বলজ্বল করা মুখে মাকে এইসব কথা বলতে শুনে তার মনটা আনন্দে টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। মা-ও
তো মেয়ে তাও কেন যে সাত তাড়াতাড়ি নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে চান, সে
বুঝে উঠতে পারে না একদম। বিয়ের পর থেকে এসেই মা এই গুপ্ত বাড়ির গিন্নি। নিজেই
নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এই বাড়িতে। কিন্তু বাবা একেবারে মায়ের উল্টো মেরু। ওর
বাবার অনেক আশা ওকে নিয়ে। তাই সে বাবাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যেতে চায় না। ওকে সবাই ‘ড্যাডিস
গার্ল’ বলেই খ্যাপায় সব সময়। ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে
গিয়ে বাবাই তো ওকে শিখিয়েছে ব্যালকনির এক প্রান্তে সাদা কাগজের একটা বিন্দু থেকে কী
ভাবে একটা পুরো গল্প শুরু হয়।
সবে কলেজে যেতে
শুরু করেছে মিলি। তার প্রথম কলেজ জীবন, তাই বাড়ির ছাদে মা-বাবা ও
আত্মীয়পরিজন মিলে বেশ একটা বড়সড় পার্টির ব্যবস্থা করেছেন। খোলা ছাদে ঝিরিঝিরি
বসন্তের হাওয়া। বাঁধ ভেঙেছে চাঁদের হাসি, তার সঙ্গে মিশে
গেছে অতিথিদেরও হাসি-মস্করা।
রেলিং আর আলসের গায়ে ঝিকিমিকি টুনি বাল্বের তিড়িক তিড়িক নাচ। তার নাম লেখা বাহারি
কেক কাটা হল। তারপর বিরিয়ানি-ফিস ফ্রাই-চিকেন কারির গন্ধে একেবারে ছাদের চারিদিক ম ম করছে। বেশ
চলছিল দিনগুলো।
কিন্তু তারপরেই
জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ এল
ভবানীপুর থেকে। মিলি ভাবল— ‘বাঁচা
গেল’, খুবই কাছে ওর বিয়ে হবে। যখন খুশি তখনই বাবা-মায়ের কাছে চলে
আসতে পারবে। ইন্টারভিউয়ের দিন
চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী ঘরে ঢুকে সকলকে নমস্কার জানিয়ে বসল। যাদের যা প্রশ্ন করার
সবেরই উত্তর দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন বেশ নার্ভাস লাগছিল মিলির। সবার
সামনে সঙ সেজে বসে থাকা। বাবার বেশ কিছু টাকাও গচ্ছা গেল তাদের ডিস
ভরে মিষ্টি খাওয়াতে।
এর ক’দিন পর মিলির বাবা-মা গেলেন পাত্রের বাড়ি। পাত্রের হাইলি কোয়ালিফিকেশনের দিক থেকে বাবার যদিও-বা একটু পছন্দ হয়েছিল কিন্তু মা একেবারেই বেঁকে বসলেন। বাড়িতে এসে বাবা-মায়ের তুমুল তর্ক শুরু হল। শেষে সবার কথার জেরায় বাবা সেই ঘর থেকে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন।
ক্রমশ
বাতায়ন-কে ধন্যবাদ জানাই। সবাই পড়ে যদি আপনাদের মতামত দেন-তাহলে বেশ ভালো লাগবে। ভালো থাকুন সাবি-লেখায় থাকুন।
ReplyDeleteখুব ভাল লাগছে, অপেক্ষায় থাকব
ReplyDeleteসাথে থাকুন ভালো থাকুন
Delete