বাতায়ন/ছোটগল্প/১ম
বর্ষ/৫ম সংখ্যা/১৫ই মে, ২০২৩
ছোটগল্প
মনোরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
সাগরের বেলা
সাগরকে জাপটে ধরে
রেখেছে বেলা। সমুদ্রে স্নান করতে, বরাবরই খুব ভয় লাগে বেলার। আজ আবার পূর্ণিমা। অন্য
দিনের থেকে সমুদ্র অনেক বেশি উত্তাল। বড় বড় ঢেউ, পর পর এসে আছড়ে পড়ছে। তবে,
এখন সাগর সাথে আছে, তাই ভরসাও আছে। সাগর বলছে, “ঢেউ আসলেই, একটু লাফিয়ে ঢেউয়ের
মাথায় চড়ে বসতে হয়। দেখবে, ঢেউ তোমায় হালকা করে ভাসিয়ে, দুলিয়ে আবার নামিয়ে
চলে যাবে। এটাই তো মজা। তা নইলে কিন্তু ফেলে ডুবিয়ে দেবে। আমার সাথে শুধু তাল
রেখে লাফিয়ে উঠবে। তাহলেই আর ভয় নেই।”
এখন কিন্তু দিব্যি
লাগছে বেলার। ভয়টাও অনেকটা কেটেছে। এক মুহূর্তে ওর মনে হয়, মানুষের সঙ্গে
সম্পর্ক জিনিসটা কেমন অদ্ভুত, তাই না? দিন পনেরো আগেও সে-ভাবে চিনতই না সে, সাগরকে।
সম্বন্ধ করেই ওদের বিয়ে হয়। অষ্টমঙ্গলার দু’দিন পর তার সঙ্গেই চলে এসেছে দিঘায়।
মধুচন্দ্রিমায়। এখন উচ্ছল, ভয়াবহ ঢেউগুলোও টপকে যাচ্ছে তার হাত ধরেই।
সাগরের মুখের দিকে
তাকাল বেলা। পাড়ের কাছে গিয়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের দিকে এখন তাকিয়ে আছে সাগর। বেলা
বলল, “আমার কী মনে হচ্ছে জানো?” সাগরের চোখে জিজ্ঞাসা। বেলা বলল, “আমার মনে হচ্ছে,
সংসারের পথ চলতে গিয়ে যে ঢেউগুলো আসবে, সেগুলোকেও আমরা এক সঙ্গে এভাবেই, পার করে
দিতে পারব। তুমি থাকলে আমাদের ডুবিয়ে দিতে পারবে না ওরা।”
একটু আগেই, সমুদ্রে
নামার সময়ে মণিমালার কথা মনে হচ্ছিল সাগরের। পাড়ের পাথরগুলোর ওপর সমানে এসে আঘাত
করে যাচ্ছে ঢেউয়ের সারি। ঠিক যেমন মণি, বার বার ইচ্ছে করে ওকে আঘাত করত। ওর
ভালবাসাকেই ব্যবহার করে, স্রেফ নিজের স্বার্থের জন্য কাজে লাগিয়েছিল মণি। কলেজের
নোটস্, ভাল ভাল রেফারেন্স বই, সব জোগাড় করে দিত সাগর। এমনকি সাগর, কলেজ ইউনিয়নের
নেতা হওয়ায়, ওর কথায় অনেক প্রফেসরদের কাছেও অতিরিক্ত সাহায্য পেয়েছিল মণি।
পরীক্ষায় ভাল রেজাল্টও করেছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে
চাকরি। ব্যাস, তারপরই সাগরের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দেয় মণি। ফোন করলে ধরত না।
অফিসে গেলেও দেখা করত না। যেদিন ওদের বাড়ি গিয়েছিল সাগর, সেদিন মণির দাদা এসে চরম
অপমান করেছিল ওকে। তার বোনের যোগ্য যে সাগর নয়, সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল বিচ্ছিরি
ভাবে। সব শেষ হয়ে যায় সেদিনই। মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছিল সাগর।
তবুও, জীবন তো থেমে
থাকবার নয়। তাই আবার শুরু হয় তার জীবন-সংগ্রাম। আজ, সাগর একটি কলেজে, সাহিত্যের
অধ্যাপক। সফল ব্যক্তিত্ব। তবুও মণিকে কী ভুলতে পেরেছে সে? ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে
ক্ষতবিক্ষত পাড়ের পাথরগুলো দেখে হঠাৎ নিজেকে ওদের মতোই মনে হচ্ছিল তার। মণির
দেওয়া, পর পর আঘাতে এক-সময়
ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল তার ভেতরটা। আজ পয়লা মে। সাগরের প্রিয় গায়ক মান্না দে-র
গানটা মনে পড়ছিল— “আমি সাগরের বেলা, তুমি দুরন্ত ঢেউ / বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া
যাও…”
বেলার কথা শুনে ওর দিকে
চেয়ে থাকে সাগর। লোনা জলে সিক্ত চোখে-মুখে যেন এক স্বতঃস্ফূর্ত আত্মসমর্পণ। সারা
জীবনের জন্য যেন আগাম ভরসা রাখার ইঙ্গিত। পাড়ের উল্টো দিকে তাকাল সাগর। দিগন্ত
বিস্তৃত নীল জলরাশি। কত সভ্যতা, কত জিঘাংসার ইতিহাস কালের নিয়মে তলিয়ে গেছে এই
জলরাশির মধ্যে। শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীও তো আজ সমুদ্র গর্ভে বিলীন। কত শত
অপমানের ইতিহাস বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখে আজও নির্লিপ্ত এই মহাসাগর। তাই হয়তো আজও
সে প্রাণচঞ্চল। অবিরাম ঢেউয়ের পদধ্বনিতে মুখরিত। সাগরের মনে হচ্ছে, থাক না মণির
অপমানের কাহিনি মনের গহিন কোনায় হারিয়ে। প্রয়োজন নেই আর তা খুঁজে বার করার।
জীবন তাকে এক ভরসার হৃদয় উপহার দিয়েছে। মনের স্রোতটাকে সেদিকেই বইয়ে দিয়ে এক
সঙ্গে ঢেউগুলো মোকাবিলা করাই তো জীবনের আনন্দ।
বেলার চোখের পাতা ভিজে
গেছে। এ লোনা জলের উৎস, চোখ না সমুদ্র, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এক অপার্থিব
সৌন্দর্য ছেয়ে আছে ওর মুখময়। ওরা দু’জন এখন অনেকটা এগিয়ে এসেছে পাড় থেকে। একটা
বড় ঢেউ এগিয়ে আসছে। বেলার হাত ধরে সেটাকে মসৃণ ভাবে পার করে দিল সে। ওদের মাটিতে
নামিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঢেউটা। আশপাশের স্নান করতে আসা মানুষদের থেকে এক মুহূর্ত একটা
আড়াল তৈরি করেছে ঢেউ। ওই এক মুহূর্তের জন্যই আপাতত সাগরের জলে ভেজা লোনা ঠোঁট
মিশে যাচ্ছে বেলার গোলাপি ওষ্ঠে।
সমাপ্ত
Nice
ReplyDeleteঅসম্ভব সুন্দর একটা গল্পঃ উপহার দিলি ভাই। গল্পের। চিন্তা ভাবনা, প্রেক্ষাপট সর্বোপরি গল্পের বলিষ্ঠ বাঁধুনি আর ভাষা ব্যবহারের মাধুর্য। সকল। পাঠকের মন জয় করবে।
ReplyDeleteশ্রদ্ধা রইল
DeleteBah! Opurbo !
ReplyDeleteএখন গল্প আরো অনেক সমৃদ্ধ। গল্পটি পড়ে মনে হল সাবেকী যুগে আছি।
ReplyDeleteআমার কাছে প্রেম একটি শাশ্বত অনুভূতি। বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের সাথে তার বহিঃপ্রকাশের পরিবর্তন হলেও মূল মানসিক অবস্থা অপরিবর্তিতই থাকে। বহিঃজগতের পরিবর্তন হয়েছে। হৃদয়টি আজও সাবেকীই রয়ে গেছে। তবুও আপনার বক্তব্য আরো সুস্পষ্ট ভাবে জানালে উপকৃত হব।
Delete