বাতায়ন/ধারাবাহিক/১ম বর্ষ/৮ম সংখ্যা/৩রা জুন, ২০২৩
ধারাবাহিক
গল্প
৩য় পর্ব
মিত্রা সেনগুপ্ত
অপরাজিতা
পূর্বানুবৃত্তি:
শপিং মলে কেনাকাটা করতে করতে একটা সিসিডি দেখে শ্রমণার কফির তেষ্টা পায়। একটা
পছন্দসই জায়গায় বসে কোল্ড কফির অর্ডার দেয়। হঠাৎ শিখার ডাকে চমকে তীব্র ঘৃণায়
চোখমুখ কুঁচকে যায় শ্রমণার। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে রিয়্যাক্ট করে শ্রমণা। জানতে
পারে রঞ্জন নয়, সোমনাথের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে শিখার। তারপর…
ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে শ্রমণা বলে, “চুপ, তোর রঞ্জনদার স্তুতি
শোনার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই আমার। এতই যখন ভাল মানুষ, বিয়ে করলি না কেন? এত
মাখো-মাখো সম্পর্ক, এত প্রেম…” শ্রমণাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে শিখা বলে, “সে সবই তো
শুনতে হবে তোকে আজ। এই কথাগুলো তোকে না বলা হলে আমি মরেও শান্তি পাব না। রঞ্জনদার সঙ্গে
কোনদিনই আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল না।” “মানে! তুই কি আমার সঙ্গে মজা করছিস?” চেঁচিয়ে
ওঠে শ্রমণা। “আমার কথাগুলো একটু শান্ত হয়ে শোন প্লিজ, রঞ্জনদা আমার দাদার কলেজের
বন্ধু ছিল আর সেই সূত্রেই প্রায় প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল, সেটা নিশ্চয়ই
মনে আছে তোর? সেই স্কুল জীবনেই রঞ্জনদাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন দেখা শুরু। দাদাও চাইত
রঞ্জনদা ওর বন্ধু থেকে আত্মীয় হয়ে উঠুক, মা-বাবারও বেশ স্নেহের পাত্র ছিল রঞ্জনদা।
তোর সঙ্গে রঞ্জনদার আলাপ আমিই করিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু আমার স্বপ্নের কথা বলা হয়নি
কোনদিন তোকে। ভেবেছিলাম আগে রঞ্জনদাকে বলব, আমি ও-কে ভালবাসি তারপর তোকে কিন্তু… তোরা
হঠাৎই খুব ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করলি, তোদের মেলামেশা আমি সহ্য করতে পারতাম না। তুই
যেদিন রঞ্জনদার দিদির বাড়িতে সারাদিন কাটিয়ে এসে তোদের একান্ত ব্যক্তিগত সময়ের
গল্প করছিলি আমায়, আমি রাগে অন্ধ হয়ে গেছিলাম, বাড়ি ফিরে দাদার কাছে কান্নায় ভেঙে
পড়লাম। দাদা বলল কৌশলে তোকে রঞ্জনদার জীবন থেকে সরাতে হবে, সেই মতো আমরা দু’জন
প্ল্যান সাজালাম। রঞ্জনদার লেখার হাতটা বরাবরই ছিল চমৎকার। ওদের কলেজের অনেক
বন্ধুই রঞ্জনদাকে দিয়ে প্রেমপত্র লিখিয়ে নিয়ে যেত প্রেমিকাকে ইমপ্রেস করতে। দাদাও
সেই মতো গল্প সাজাল, মিথ্যে করে বলল দাদা প্রেম করছে, প্রেমপত্র লিখে দিতে হবে
রঞ্জনদাকে। রঞ্জনদা জেদ ধরল আগে তাকে দেখা, আলাপ করা, নাম বল। দাদা বলল, আগে তো
লিখে দে, তারপর সামনেই পরিচয় করিয়ে দেব, রঞ্জনদাও সরল মনে লিখে দিল চিঠি, পর পর
বেশ ক’দিন।
আমি জানতাম রঞ্জনদার হাতের লেখা চিনতে তোর ভুল হবে না। আমি
জানতাম তোর মতো আত্মসম্মানী মেয়ে চিঠিগুলো নিয়ে রঞ্জনদার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না।
জানতাম তুই তোর ভালবাসার এত বড় অপমান সহ্য করতে পারবি না, রঞ্জনদাকে মুছে দিবি তোর
জীবন থেকে। তার চেয়েও বড় কথা আমি জানতাম তুই আমায় তোর থেকেও বেশি বিশ্বাস করিস।
আমি যদি তোকে বলি যে আমরা প্রেম করছি, এই চিঠিগুলো রঞ্জনদা আমায় লিখেছে, তুই চোখ
বুজে সেটাই বিশ্বাস করে নিবি। আমি এটাও জানতাম যে এর ফলে আমায় তোকে হারাতে হবে,
আমাদের সারা জীবনের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে কিন্তু আমি তখন রঞ্জনদাকে নিজের করে
পাবার জন্য পাগল। আমার ভাবনাই মিলে গেল, চিঠিগুলো পড়ে তুই রাগে অন্ধ হয়ে গেলি, আমি
তো জানতাম রাগলে তুই যুক্তি-বুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলিস, তাই তোকে আরো বেশি রাগিয়ে
দিতে আমি বানিয়ে বানিয়ে আমাদের অন্তরঙ্গতার গল্প করতে লাগলাম। তুই চিঠিগুলো আমার
মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলি কলেজ থেকে। যোগাযোগ বন্ধ করে দিলি আমার সঙ্গে।
রঞ্জনদার যোগাযোগের চেষ্টাও ব্যর্থ করে দিলি শক্ত হাতে, কলেজ আসাও বন্ধ করলি। দিন
পনেরো বাদে খবর পেলাম এখানকার ঘরবাড়ি বেচে কাকু-কাকিমা তোকে নিয়ে বিদেশ চলে
যাচ্ছেন। আমি তখনও আমার অপরাধ বুঝতে পারিনি, মনের মধ্যে কী ভীষণ আনন্দ, আমার পথের
কাঁটা দূর হচ্ছে। আমি তখন ধরেই নিয়েছি তুই এক্কেবারে দূরে চলে গেলেই, রঞ্জনদাকে
আমি ঠিক আমার করে নিতে পারব। কিন্তু তুই যখন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলি ঠিক
তখনই আমার জীবনে নেমে এল অন্ধকার, সারাজীবনের জন্য অপরাধী হয়ে গেলাম আমি। তুই চলে
যাচ্ছিস শুনে দিশেহারা হয়ে গেল রঞ্জনদা। তোকে থামাতে পাগলের মতো বাইক ছোটাল
এয়ারপোর্টের দিকে। ব্যস, উল্টো দিক থেকে টাটা সুমো সজোরে ধাক্কা মারল রঞ্জনদার
বাইকে। সাত দিন ধরে চলল যমে মানুষে টানাটানি, কী ভীষণ রক্তপাত! দিন-রাত এক করে
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে চললাম আমি। অবশেষে বেঁচে ফিরল মানুষটা একটা পা হারিয়ে।
আমি আমার সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে কান্নায় ভেঙে পড়লাম মানুষটার সামনে। অনেকক্ষণ পর
শুনতে পেলাম শান্ত স্বর, “বাড়ি যা…”
চোখ তুলে দেখি কী ভীষণ ঘৃণা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রঞ্জনদা। ওই
দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গেলাম। আর কোনদিন রঞ্জনদার মুখোমুখি হইনি, না
আমি, না দাদা, শুধু দূর থেকে খোঁজ রেখে গেছি। আজ আমার তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার দিন।
রঞ্জনদা আমায় ক্ষমা করেনি জানি, তুইও কি করবি না?”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে শ্রমণার দিকে হাত বাড়ায় শিখা… হাত দুটো
সরিয়ে নিয়ে শীতল কঠিন স্বরে শ্রমণা বলে, “রঞ্জন এখন থাকে কোথায়?”
“যেখানে ছিল, যাদবপুর। মেসো-মাসি মারা গেছেন, একাই থাকে
রঞ্জনদা, বাড়িতেই ছাত্র পড়ায়, বিয়েও করেনি। কী করে যে একা-একা কাটায় অসহায় মানুষটা?
এ কী! একী! কোথায় চললি, কিছু তো বল, এ-ভাবে চলে যাস না, শ্রমণা… শ্রমণা…”
যন্ত্রের মতো মেন গেটের দিকে এগিয়ে চলে শ্রমণা। গাড়িতে বসেও
উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকে, ড্রাইভারকে বলে “ফ্ল্যাটে যাব, ওখান থেকে যাদবপুর।” এর
মাঝেই ছোট্ট একটা টেক্সট করে দেয় সুইটিকে, “রেডি হও, এখুনি বেরোতে হবে, তোমায় একটা
surprise দেবার আছে।”
গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজতেই ভিড় করে আসে পুরোনো স্মৃতি…
সেদিন শিখার কাছে রঞ্জনের মাখো-মাখো প্রেমপত্র দেখে লজ্জায়,
ঘেন্নায় নিজেকে শেষ করে দেবে ভেবেছিল শ্রমণা। কিন্তু সেই রাত থেকেই ধুম জ্বর,
অসম্ভব শরীর খারাপ, সাথে বমি। পরের দিন ভোরেই ডাক্তারকাকুকে বাড়িতে ডেকে আনেন
বাবা, ডাক্তারকাকু বেশ কিছু টেস্ট করতে দিলেন, রিপোর্ট হাতে আসতেই বজ্রাঘাত, মা
হতে চলেছে শ্রমণা।
ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে শ্রমণার, ওই লম্পটটার সন্তান তার গর্ভে!
বার বার ভাবে নষ্ট করে ফেলবে, ফেলতেই হবে। কিন্তু পরক্ষণেই বাধ সাধে কোমল মাতৃ-হৃদয়।
বাচ্ছাটার কী দোষ? ও তো শ্রমণার ভালবাসার ফসল, শ্রমণা তো সত্যিই ভালবেসেছিল
রঞ্জনকে।
কে এই বাচ্ছার বাবা! মা-বাবার শত প্রশ্নের মুখেও অনড় থাকে
শ্রমণা। স্পষ্ট জানিয়ে দেয় এই বাচ্ছা ওর, ওর একার এবং ওকে ও জন্ম দেবেই। মেয়ের
জেদের কাছে হার মানে মা-বাবা, তড়িঘড়ি সব বিক্রিবাটা করে পাড়ি জমায় বিদেশে। ওখানে
আগে থেকেই শ্রমণার জেঠু থাকত তাই কোনো অসুবিধাই হয় না। যথা সময়ে কোল আলো করে আসে
সুইটি, সুইটিকে ঘিরেই শুরু হয় শ্রমণার নতুন জীবন।
“ম্যাডাম এসে গেছি।” ড্রাইভারের ডাকে সম্বিৎ ফেরে শ্রমণার। সুইটি
রেডিই ছিল, ওকে নিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে যাদবপুরে রঞ্জনের বাড়ির দিকে। মায়ের চেঞ্জ
দেখে বেশ ঘাবড়ে যায় সুইটি, গোটা রাস্তা একটাও কথা বলে না শ্রমণা, সুইটিও কিচ্ছু
জিজ্ঞেস করে না, মায়ের এই গম্ভীর মুখকে খুব ভয় পায় ও, ও জানে মা নিজে থেকে কিছু না
বললে হাজার চেষ্টা করলেও কিচ্ছু বের করা যাবে না।
অনেক বদলে গেছে রাস্তাঘাট তবুও রঞ্জনের বাড়ি খুঁজে পেতে একটুও
বেগ পেতে হয় না শ্রমণার। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বেল বাজাতেই, রঞ্জন এসে দরজা খোলে। দু’চোখ
ফেটে জল আসে শ্রমণার। সেদিনের সেই দীর্ঘদেহী, সুদর্শন, সুঠাম পুরুষ আজ অসময়ে বয়সের
ভারে নুয়ে যাওয়া এক অসহায় মানুষ।
চোখের জল লুকিয়ে রঞ্জনের পাশ কাটিয়ে মেয়ের হাত ধরে ঘরে ঢোকে
শ্রমণা। বিস্মিত রঞ্জন অস্ফুটে বলে ওঠে, “শ্রমণা তুমি!” খুব স্বাভাবিক গলায় শ্রমণা
বলে, “রেডি হয়ে নাও, মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়িতে আজ পাকা-কথা বলতে যেতে হবে। আর হ্যাঁ
সুইটি, আজ অয়নদের বাড়িতে আমাদের সাথে তোমার বাবাও যাবেন।”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুইটির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, একটাই শব্দ, “বাবা…!”
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment