বাতায়ন/হলদে খাম/১ম
বর্ষ/৮ম সংখ্যা/১৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
হলদে খাম
অজয় দেবনাথ
প্রেমাকে…
০১.০৬.২০২৩
কলকাতা
প্রেমা,
দিনাজপুর, বাংলাদেশ
মনে হয় এতদিনে ফিরে
গেছ তোমার দেশে, ঘরে, সংসারে। যদিও এক বুক আশা আর অনেকগুলো দিন হাতে নিয়েই এসেছিলে।
এক দেশ থেকে অন্য দেশে আসা মোটেই সহজ নয় জানি, ভিসা জোগাড়, স্কুল থেকে ছুটি নেওয়া,
নিরাপত্তা-জনিত সঙ্গী জোগাড় ইত্যাদি…
তবু দেখা হল না, হয়তো
দেখা হবার সময় আসেনি এখনও। যেমন তিরিশ বছর আগে সময় হয়েও হতে দেয়নি তোমার দ্বিধা। অথচ
একজন কুড়ি-একুশ বছরের তরতাজা, চূড়ান্ত আবেগপ্রবণ, তরুণ যুবকের মন-প্রাণ, মগজ-মনন, প্রতিটি
শ্বাসপ্রশ্বাস জুড়ে শুধু তুমি… ওহ্ না, তুমি নও তোমরা। (বারে বারে কেন যে ভুলে যাই!)
তখন তো এখনকার মতো মোবাইল
ছিল না। একটা চিঠি পোস্ট করলে কাঁটাতার পেরিয়ে তোমার কাছ থেকে ঘুরে উত্তর আসতেই কেটে
যেত অন্তত পনেরো দিন। ততদিন হাপিত্যেশ প্রতীক্ষা। তুমি কী করতে তা আজ আর মন থেকে জোর
দিয়ে বলতে সাহস পাই না।
কী করে পারলে আমার প্রাণ-ভরা
আবেগকে দু’ পায়ে দুমড়ে-মুচড়ে ছারখার করে দিতে? থুরি, দু’ পায়ে নয় ছ’ পায়ে। কারণ তোমরা
তো ছিলে সম্মিলিতভাবে তিনজন। বিশ্বাস করো আমি আজও বিশ্বাস করতে পারি না। কেবলই দুঃস্বপ্ন
মনে হয়। সে-দিনের সেই মুহূর্তের পর ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠেছিল আমার পায়ের তলার মাটি।
মনে হয়েছিল মুহূর্তে শুরু হল প্রলয়, মহাপ্রলয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম আমার সমস্ত জগৎ
থেকে। আমার পড়াশোনা, আমার কেরিয়ার, আমার স্বপ্ন-সাধনা, আমার সব কিছু। কিন্তু… জীবন
তো থেমে থাকে না। আমার সেই ‘দেবদাস’ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরতে সময়
লেগেছিল বিস্তর। কতটা তা আজও সঠিক করে বলতে পারি না।
যদিও তার পরপরই আসরে
নেমে পড়েছিল পৃথা। বিভিন্নভাবে চিঠি লিখত আমাকে। আমি কিন্তু আর বিশ্বাস রাখতে পারিনি
তোমাদের চিঠির উপর, কেবলই মনে হয়েছিল এর পিছনে নিশ্চয়ই আরো বড় কোনও রহস্য, চক্রান্ত
লুকিয়ে আছে। অথচ কোন এক অমোঘ টানে চিঠির প্রত্যাশাও উপেক্ষা করতে পারতাম না।
বিচক্ষণ মানুষ তোমার
জামাইবাবু উদয়দা। তিনি আমাদের বরানগরের বাড়িতে এসেছিলেন। আমার বোন রূপার সঙ্গে আলাপ
করিয়েও দিয়েছিলাম। কিন্তু… তখনও পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক নই। ফলে উদয়দা’র যথাযথ আপ্যায়ন
করতে পারিনি। ঘটনাটা ঘটেছিল মে মাসে আর উদয়দা এসেছিলেন পুজোর আগে। আমাকে বিশেষ আমন্ত্রণ
জানিয়েছিলেন সোদপুরে উদয়দা’র এক রিলেটিভের বাড়িতে। গিয়েছিলাম। সেদিন দুর্গা পঞ্চমী
অথবা ষষ্ঠী। সঠিক মনে নেই আর। আপ্যায়ন করেছিলেন যথাযথ।
তিরিশ বছর আগের সোদপুর
আজকের মতো তো আর নয়। একদিকে শরতের উৎসবমুখর রোদ্দুর, পাশাপাশি হেমন্তের বিষণ্ণ সুর।
দু’য়ে মিলে অদ্ভুত পরিবেশ, যা পরিষ্কার আজও মনে পড়ে। আমার দুটো ছবি তুলেছিলেন, পাঠিয়েছিলেন
ফিরে গিয়ে। যার একটা ছবি ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া ছিল। হয়তো তা দেখেই তুমি আমাকে আবারও
খুঁজে পেলে।
ফোন করেছিলে মেসেঞ্জারে।
বলেছিলে অনেক কথা। জানিয়েছিলে তোমার, পৃথার দুঃসহ করুণ পরিণতির কথা। যথেষ্ট দুঃখ পেয়েছিলাম।
ক্ষণিকের জন্য আবেগাপ্লুতও হয়ে পড়েছিলাম। পরে আবারও একদিন ফোনে কথা বলালে শুভ্রার সঙ্গে।
শুভ্রার সঙ্গে কথা বলে বেশ ভাল লেগেছিল। সে-ই তো তোমাদের ত্রয়ীর মূল প্রতিমা। কিন্তু
তুমি ফোনে বড়ই কান্নাকাটি করো, এ আমি একেবারেই নিতে পারি না। আজ যৌবনের উপান্তে এসে
মনে হয়, ‘গতস্য শোচনা নাস্তি’। যা গেছে যেতে দাও। সামনের দিকে এগিয়ে চলো। আমার উপলব্ধি
থেকেই বলছি, জীবনের একমাত্র এই-ই মানে।
তবুও দেখা হল না। যদিও
জেসমিনকে নিয়ে আমার বাড়ির আশপাশ দিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছ আমাকে না জানিয়ে। আমি জেনেছি তোমার
পোস্ট করা ছবি দেখে। অথবা হয়তো জেসমিনের সঙ্গে আমার আলাপ করাতে চাওনি। হয়তো-বা চেয়েছিলে
তিরিশ বছর আগের আবেগে আমার সঙ্গে একা দেখা করবে, নির্জনে। হুঁ… তিরিশ বছর আগের আবেগ
তিরিশ বছর পরে আর ফিরে আসে না প্রেমা।
তাছাড়া আমি চেয়েছিলাম,
উদয়দা-শুভ্রাকে নিয়েই তুমি আসবে। উদয়দা অত্যন্ত গুণী এবং ভাল মানুষ। আর শুভ্রার আসন
আমার মনের মণিবেদিকায় এক অনন্য প্রতিমা হিসেবে। আমার অনন্য প্রতিমাকে আমি একবারও দেখতে
পাব না? কী গো…! তাছাড়া বর্তমানে আমার শরীর, নতুন পত্রিকার ব্যবস্থাপনা নিয়ে নাজেহাল
অবস্থা। তা-ও তুমি বাড়ি এলে কিছুটা সময় কাটাতেই পারতাম।
যাইহোক, অনেক কথাই বলে
ফেললাম। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে আবারও লেখা যাবে। ভাল থেক। সামনের দিকে এগিয়ে চলো। তুমি
তো ভগবানে বিশ্বাস করো, তোমার ভগবান তোমাকে ঠিক পথই দেখাবেন, যদি তুমি নিজের লক্ষ্যে
স্থির থাকতে পারো।
ইতি—
তোমার / তোমাদের কলকাতার
বখাটে, উশৃঙ্খল ছেলে।
No comments:
Post a Comment