রাজা অয়দিপাউস
প্রাচীন গ্রিসের একটি রাজ্যে ইডিপাস বা অয়দিপাউস খুবই মহানুভব রাজা ছিলেন। সবসময় তিনি প্রজাদের কল্যাণের কথা ভাবতেন এবং প্রজাদের কল্যাণের জন্য কাজ করতেন। তথাপি তাঁর রাজ্যে দুর্ভিক্ষ-খরা-বন্যা লেগেই ছিল। সব দেখেশুনে রাজা অয়দিপাউস তার রাজ্যের সব পণ্ডিতকে ডেকে সমাধানের পথ জানতে চাইলেন। পণ্ডিতেরা পাঁজিপুথি দেখে অয়দিপাউসকে জানালেন, তার একটি ভয়ানক পাপের জন্য রাজ্যে বিধাতার এত অভিশাপ। অথচ রাজা জ্ঞানত কোনো পাপ করেননি, তবে কী ছিল সেই রহস্য? তা' উদ্ঘাটনের জন্য সাক্ষিসাবুদ হাজির করে অবশেষে জানা গেল আসল সত্য।
রাজা অয়দিপাউস ও রানি ইওকাস্তের স্বগতোক্তির মাধ্যমে, সেই
কলঙ্কিত মুহূর্তের কিংকর্তব্যবিমুঢ়তার এক কল্পসংলাপ এই কাব্যনাটিকা।
রাজা অয়দিপাউস
অয়দিপাউস: হে সর্বশক্তিমান, কেমন বিচার তোমার!
এ
কী বিধির লিখনে আমার ভাগ্য করল প্রতিহত!
এখন
নিষ্ফল বিলাপেও যে আমার পাপমুক্তি হবে না প্রভু।
লজ্জায়,
ঘৃণায়, নিজেরই মাথা করি নত।
রুদ্ধ
কণ্ঠের ন্যায়,
কর্ণও
কেন রুদ্ধ হল না সেই-ক্ষণে!
দেব
কৃপায় সুখ তো ছিল অপরিমিত!
যদিও
পূর্ব-স্বামী লাইয়াসের অকালমৃত্যু—
দাগ
কেটেছিল এই মনে।
এ
কী শুনলাম আজ!
নিজ
কর্ণ স্তব্ধ আজ বিষাক্ত বর্ণনে।
অদৃষ্টে
যা ছিল তাই ঘটল এত সাবধানতা সত্ত্বেও!
দৈববাণী
নিষ্ফল করতে—
সকল
প্রচেষ্টা ব্যর্থ কী কারণে!
সর্বহারা
এই বিধবা ইওকাস্তে মেনে নিয়েছিল সব শর্ত,
নিয়ম
মেনেই রাজধর্ম, সমাজধর্ম
বজায়
রাখতে বিবাহ অয়দিপাউস সনে,
পরিপূর্ণ
হত, শুধু না ত্যাগিলে মোর একমাত্র পুত্র।
আমার
কারণেই রাজ্যবাসী আজ বিপর্যয়মুখী!
আহ্!
কী যন্ত্রণা! কী আত্মগ্লানি! কী অসহায় আজ!
চিরসুখী
রাজার পরিণতি আজ চিরদুখী।
মনে
পড়ে, ডেলফির অরাকলের ভবিষ্যত বাণী:
“তব
কাঙ্ক্ষিত পুত্রসন্তান, হবে পিতৃহন্তা!
আর
বিধবা মাতা ইওকাস্তে, হবে তার রানি!”
নাহ্!
এই
অধম সদ্যজাতকে হত্যা হেতু—
হুকুম
জারি করেন জঙ্গলে আসতে ফেলে,
নিয়তির
পরিহাসে এই নিষ্পাপ প্রাণ পেল ঠাঁই,
মেষপালক
দম্পতির ক্রোড়ে নব জীবন মেলে।
নিয়তির
ফেরে ভাগ্যের লিখন বুঝি খণ্ডানো গেল,
থিবস্
বুঝি সুরক্ষিত, লাইয়াস গেল বেঁচে,
অভিশপ্ত
বাণী বুঝি এবার খণ্ডিত হল।
দত্তক
সন্তান রূপে পরিচিত এই আমি অয়দিপাউস,
শৌর্য,
বীর্যে বলীয়ান হয়েও যখন জানতে পারি;
আমার
জন্মদাতা এঁরা নন, করিনি বিশ্বাস।
ছুটে
গেছি ডেলফির অরাকলের কাছে,
জানতে
পারি আমার হাতেই পিতৃহত্যা,
বিবাহে
আমি ঘোর অজাচারী…
কলিন্থ
ছেড়েছি শুধুমাত্র এই পাপ এড়াতে।
পথে
দাভিলায় তেরাস্তার মোড়ে দুর্ঘটনায় ঘোড়াগাড়ি...
লাইয়াসের
মৃত্যু দুর্ঘটনায় নয়, যুদ্ধেও নয়,
অদৃষ্ট
তাকে নিয়ে গেছে অপত্যের সম্মুখে— মৃত্যুর টানে,
ফলাফলে
যা হবার তাই হল,
নিজ
সৃষ্টির কাছে নিদারুণ পরাজয়, হত্যা।
আর
আমি? পুত্রের মাতা? নাকি স্ত্রী? কে তা জানে?
আহ্!
কী আত্মগ্লানি, কী জ্বালা সারা শরীরে,
এ
অভিশাপ কুড়ানোর থেকে মুক্তি দাও হে ঈশ...
নাহ্!
অসহ্য এ পরিস্থিতির থেকে মুক্তির একটাই উপায়...
আত্মহত্যা।
এ
সম্পর্ক স্থায়ী হতে পারে না, এ বিসদৃশ, বিষদৃশ্য।
যাকে
অজান্তেই সামান্য তর্কাতর্কিতে হত্যা করেছি,
অবিশ্বাস্য
এখনো, যাকে চিনেছি পিতা-মাতা রূপে—
তাঁরা
নন মোর কেউ, জন্মদাতাকে আমিই মেরেছি!
আর
উনি? আমার জন্মদাত্রী! আমার...
মানতে
না পারলেও যে, এটাই ঘটিত সত্য,
আহ্!
এই হতাশার গ্লানি পারছি না সইতে,
বরং,
স্বদৃষ্টি হরণ করেই নিজেকে—
চির
অন্ধকারে করি নিক্ষেপিত।
পারলে
ক্ষমা করো হে সর্বশক্তিমান।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment