বাতায়ন/শারদ/রম্যরচনা/১ম বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১৯শে আশ্বিন, ১৪৩০
শারদ
| রম্যরচনা
ডাঃ নির্মল ভানু গুপ্ত
পুজোর পাঁচালী
কাকু, গাঁজাপাড়া এসে গেছে। একটু তন্দ্রা এসেছিল নলিনবাবুর। এই
গাঁজাপাড়া হল দুর্গা নগরের শেষ স্টপেজ। টোটো থেকে নেমে, ভাড়া মিটিয়ে, বাড়ির
দিকে এগোতেই দেখেন রাস্তা বন্ধ! এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন কেউ আছে কিনা।
- কাকা, ও কাকা, কোথায় যাবেন?
শুনে নলিনবাবু পেছন দিকে ঘুরে দেখলেন চা দোকান থেকে পচা ডাকছে।
চিনতে পেরে পচা বললে,
- ও নলিনকাকু। এখান দিয়ে এখন আর যেতে পারবেন না কাকু, ম্যারাপ
বাঁধা হয়ে গেছে। এখন থেকে পাশের গলি দিয়ে যাতায়াত করতে হবে।
- কেন? কী হয়েছে?
- কী হবে আবার? দুগগো পুজো হবে। আমাদের গাঁজাপাড়ার এবার
স্বন্ন জয়ন্তী। এসপেসাল প্যান্ডেল, থিমের পুজো হবে, তাই।
পুজো আসছে! এই ভেবে নলিনবাবুর বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। এক
বড় প্রাইভেট কোম্পানির অফিসের বড়বাবু বলে কথা। তাই প্রতি বছর পুজোয় অনেক খরচ। এই
দুর্গা নগরের গাঁজাপাড়াতেই তাঁর জন্ম। পুজো আসার আগের সময়টা ছোট বেলায় কত
আনন্দের ছিল! পুজো আসছে, ঠাকুর মণ্ডপে প্রথমে বাঁশের কাঠামো দেখতে যাওয়ার একটা
আলাদা মজা ছিল। সেই বাঁশ যে এখন অন্য দিক দিয়ে আসবে, শুধু তাই নয়, সেটা বড় হয়ে
আসবে তা, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন নলিনবাবু। খড়ের চাপান দেওয়া হত সেই বাঁশের
কাঠামোর ওপর। তারপর মাটি, তারপর ছাঁচের মুখ বসত সেই কাঠামোয়। তখন বোঝা যেত কোনটা কী
ঠাকুর। কী মজাই না হত সে সব দেখে!
আর এখন, যত পুজো এগিয়ে আসে তত রাতের ঘুম উড়ে যায়। এক দল
ছেলে নলিনবাবুর দিকে এগিয়ে আসছে দেখে, মনে হল এইবার বোধ হয় চাঁদা চাইবে। নলিনবাবু
অন্য দিকে তাকিয়ে পার হয়ে গেলেন। পরদিন থেকে পাশের গলি দিয়ে যাতায়াত শুরু হল।
এবার নাকি পুজো উদ্বোধন হবে, মহালয়ার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদে। বড় বড়
সেলিব্রিটিরা আসবে। সেদিন থেকে আবার রাস্তা খুলে দেবে। সবে সেপ্টেম্বরের আজ ১০
তারিখ। পুজো অক্টোবরের পনেরো তারিখ। তত দিন এ গলি সে গলি করে চালাতে হবে। নলিনবাবু
যতক্ষণ অফিসে থাকেন ততক্ষণ অফিসের কাজ করে সময় কেটে যায়। কিন্তু বাড়ির দিকে
যাবার সময় চিন্তা বাড়তে থাকে।
আজ নলিনবাবু বাড়িতে ঢুকে বসার ঘরে চেয়ারে এসে বসলেন। ছোট
মেয়ে আন্নাকালী দৌড়ে গিয়ে জলের গ্লাসে জল নিয়ে বাবার গা ঘেঁসে দাঁড়াল। অন্য
সময় হলে মেয়েকে আদর করেন, আজ একটু একটু করে জল খাচ্ছেন আর দেখছেন ছোট মেয়ে কী
বলে। বললেন,
- কী চাই?
মেয়ে গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
- বাবা, আমার কিন্তু এবার পুজোয় একটা নীল আর একটা কালো জিন্সের
প্যান্ট দিতে হবে আর তার সাথে লাল রঙের একটা টপ। আর একটা টি–শার্ট কালো রঙের তাতে
চুমকি বসানো থাকবে। আর চুড়িদারের সেট একটা গোলাপি রঙের আর শ্রী লেদার থেকে দু’
জোড়া জুতো।
নলিনবাবু মজা দেখার জন্য বললেন,
- ব্যাকরণ মুখস্থ হয়েছে?
শুনে আন্নাকালী মুখটা বেঁকিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। নলিনবাবু হা
হা হা করে হেসে উঠলেন। চা নিয়ে এলেন কমললতা, নলিনবাবুর স্ত্রী। সঙ্গে গোলমরিচ আর
চিনি মেশানো চিঁড়ে ভাজা, একটা প্লেটে।
- কী হল এত হাসছেন কেন?
- এই তোমার মেয়েকে ব্যাকরণ জিজ্ঞেস করাতে ছুটে পালাল, তাই।
চিঁড়ে ভাজা চিবুতে চিবুতে নলিনবাবু বললেন,
- কেউ এসেছিল?
কমললতা বললেন,
- না তো। কেন কারোর আসার কথা ছিল না কি?
- না, না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
নলিনবাবু ডান হাত দিয়ে একবার চা আর একবার চিঁড়ে খাচ্ছেন।
কমললতা স্বামীর বাম দিকে বসে, দরজার দিকে তাকিয়ে, বাম হাতটা কোলে তুলে নিলেন। নলিনবাবু
বললেন,
- কী ব্যাপার?
কমললতা বললেন,
- কাল তো রবিবার, তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার খেয়ে, বাজার যাব
ভাবছি।
- বেশ তাই হবে।
কমললতা নলিনবাবুর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। বয়স কম, তাই সামলে-সুমলে
রাখতে হয়। যদি বেহাত হয়ে যায়! আগের পক্ষের স্ত্রী সরলা দুটি কন্যা রেখে, আজ
থেকে পনেরো বছর আগে, ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন বড় মেয়ে নীলার বয়স বারো আর ছোট
মেয়ে শীলার বয়স চার, এই অবস্থায় নলিনবাবু চাকরি করবেন, না মেয়েদের মানুষ
করবেন। চল্লিশ বছরের ভাল চাকুরি করা পুরুষ মানুষের পাত্রীর অভাব নেই এই বাংলায়।
ঘটকরা নলিনবাবুর পেছনে ঘুরঘুর করতে লাগল। শেষে একটি মেয়ে মনে ধরল নলিনবাবুর।
নামটিও সুন্দর কমললতা। দেখতে-শুনতেও ভাল, সদ্য যুবতী। পাল্টি ঘর হলে কী হবে খুবই গরিব
পরিবার। নলিনবাবু বললেন সব খরচ আমি করব সাথে ঘটক বিদায় ও আমিই দেব। ধুমধাম করে
বিয়ে হল। সৌভাগ্য হল কমললতার, অমন সুন্দর ভাল চাকুরে বর পেল। সৌভাগ্য হল নলিনবাবুর
এই বয়সে অমন ডাগরডোগর বউ পেল। সৌভাগ্য হল দীনু ঘটকের ভাল রকম ঘটক বিদায় পেয়ে। আর
সৌভাগ্য হল দুই মেয়ের তারা বাপের বিয়ে দেখল নিজেদের চোখে।
বিয়ের পর কমললতার গর্ভে সন্তান এল বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। যথা
সময়েই সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। কিন্তু আবার সেই মেয়ে। তিন তিনটি মেয়ে! আর না। তাই
নলিনবাবু ছোট মেয়ের নাম রাখলেন, আন্নাকালী। যদিও স্কুলে ভর্তি করার সময় কমললতা
ওর নাম বদলে মাধবীলতা রেখেছেন। আর মাধবী বলেই ডাকেন। শুধু নলিনবাবুই কেউ না থাকলে
ওকে আগের নামে ডাকেন। ও চায় না কেউ ওকে ওই নামে ডাকুক। সেটা বুঝতে পেরে নলিনবাবু
লোকের সামনে ওকে মাধবী বলেই ডাকেন। বড় মেয়ে নীলার বিয়ে হয়ে গেছে সাত বছর হল।
মেজো মেয়ে লীলা কলেজে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বিএ পড়ছে। ছোট মেয়ে সেভেনে পড়ে। পরের
দিন রবিবার, নলিনবাবু সকাল সকাল দুপুরের খাবার খেয়ে, একটু জিরিয়ে নিয়ে, কমললতাকে
নিয়ে বাজারের দিকে রওনা হলেন। যাবার সময় মেজো মেয়ে শীলাকে বলে গেলেন,
- আমরা বের হচ্ছি। মাধবীর খেয়াল রাখবে। কেউ এলে দরজা খুলবে
না। জানালা দিয়ে কথা বলবে আর পরে আসতে বলবে।
এবার কমললতাকে বললেন,
- আমার বন্ধুর দোকান, নিউ সাহা শাড়ি হাউসে যাই চলো।
- বেশ। চলুন।
কমললতা নলিনবাবুর থেকে বাইশ বছরের ছোট। তাই প্রথম থেকেই আপনি
আজ্ঞে করেন। দোকানে ঢুকে নলিনবাবু বললেন, সাহাবাবু বৌদিকে শাড়ি দেখান। এই সময়ে দোকানে
ভিড় কম থাকে। সাহাবাবু দুই-তিনজন কর্মীকে নিয়ে উৎসাহের সঙ্গে শাড়ি দেখাতে
লাগলেন। নলিনবাবু ফাঁকা বসে থাকা ক্যাশিয়ারের সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। এখন বেশ
কিছু সময় ধরে কমললতা দোকানদারকে ব্যস্ত রাখবেন। ঘন্টা খানেক পর কমললতা বললেন,
- না এখানে কিছু পছন্দের পাচ্ছি না। চলুন অন্য দোকানে যাই।
নলিনবাবু চুপচাপ দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। কমললতা বললেন,
- এবার প্রিয় নেপাল ব্যবসায়ীর দোকানে চলুন।
- চলো। বলে নলিনবাবু শান্ত ভাবে পরের সেই দোকানের উদ্দেশ্যে
চললেন।
নলিনবাবুর এই রকম আচরণের কারণ নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে পাঠকের।
তাহলে শুনুন, আগের স্ত্রী সরলা ছিল ভীষণ রকমের মুখ চোরা। খুব কম কথা বলতেন।
নলিনবাবু যা কিনে দিতেন তাই আনন্দের সাথে ব্যবহার করতেন। পরের পক্ষের স্ত্রী
কমললতা একটু অন্য রকম। বিয়ের পর বছর কয়েক শাড়ি কিনতে হয়নি। বিয়েতে যা পেয়েছিল
তাই দিয়েই চলে গেছে। তারপর প্রথম দু-এক বছর নলিনবাবু যা কিনে দিয়েছেন, তাই
পরেছেন কমললতা। তারপর যেবার কর্তার আনা শাড়ি, কমললতার একেবারেই পছন্দ হল না, সেবার
থেকেই নিজে দোকানে গিয়ে শাড়ি কিনতে শুরু করলেন। সব বাঙালির মতো দুর্গা পূজার আগেই
কেনাকাটা করেন কমললতা। ততদিনে কর্তার কথার জবাব দেওয়ার সাহস জুটিয়ে ফেলেছেন
কমললতা। প্রথম দিন শাড়ির দোকানে গিয়ে কমললতা প্রথমে তাঁতের শাড়ি দেখলেন। বেশ
কয়েকটা শাড়ি দেখেও মুখটা ব্যাজার করে রেখেছেন। নলিনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
- আপনার একটাও ভাল লাগল?
- হ্যাঁ, এই সবুজটা।
মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে কমললতা সেলস্ম্যানকে বললেন,
- সিল্কের শাড়ি দেখান তো।
গোটা পঁচিশেক সিল্কের শাড়ি দেখার পর বললে,
- আমার তো একটাও পছন্দ হল না। আপনার?
নলিনবাবু বললেন,
- কেন? এই কমলা রঙের আর এই সোনালী রঙের শাড়ি দুটো আমার তো ভালই
লাগছে।
- না। আপনারা বরং কাঞ্জিভরম শাড়ি দেখান দেখি তার মধ্যে কিছু
পছন্দ হয় কিনা।
দোকানদারের কর্মচারীরা সবাই ব্যস্ত দুজন শাড়ি আনছে, দুজন শাড়ি
ভাঁজ খুলে দিয়ে দেখাচ্ছে। ম্যানেজার বা মালিক গোছের ভদ্রলোক বললেন,
- দেখুন ম্যাডাম, দেখুন আমার দোকানে কালেকশন খুব ভাল। এই
ম্যাডামকে যত রকমের শাড়ি আছে সব দেখাও।
ঘন্টা দেড়েক-দুয়েক ধরে শাড়ি দেখতে দেখতে, শাড়ির পাহাড় হয়ে
গেল। নলিনবাবু মাঝে মাঝে এইটা ভাল লাগবে, ওইটা ভাল, করতে করতে এক সময় থেমে গেলেন।
শেষে কমললতার একটাও পছন্দ হল না। ব্যাজার মুখ করে বেরিয়ে এলেন দোকান থেকে। সেই
ম্যানেজার লোকটা মুখে বলল,
- আবার আসবেন ম্যাডাম পুজোর ঠিক আগের সপ্তাহে নতুন কিছু মাল
আসবে।
তবে মনে মনে কী বলল কে জানে? দোকান থেকে বেরিয়ে এসে কমললতা
নলিনবাবুকে বললেন,
- আপনি ক্রেতা না বিক্রেতা।
- কেন? এ কথা বলছ কেন?
- আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল আপনি দোকানি।
- কী করে?
- এইটা নাও, ওইটা নাও, করছিলেন কেন?
- আমার পছন্দ হয়েছিল, তাই।
- শাড়ি কি আপনি পরবেন?
- না, তুমি।
- তাহলে। আমার পছন্দ হবে, তবে তো কিনব।
- তাহলে, আমি কী করব?
- আপনি সাথে আসবেন। চুপ করে হাসি হাসি মুখ করে বসে থাকবেন।
- আচ্ছা।
- আর আমি যদি বলি, কোনটা পছন্দ হয়েছে? তার মানে আমার একটাও
পছন্দ হয়নি। আপনি তখন দোকানদারের মতো এইটা ভাল, ওইটা ভাল, করবেন না। বলবেন, না
পছন্দ হয়নি। ঠিক আছে?
- হুম। কিন্তু তুমি অত শাড়ি বের করে দেখলে, একটাও নিলে না।
আমার খুব খারাপ লাগছিল। ওরা কী মনে করল।
- কিচ্ছু মনে করেনি। আর জিনিস দেখানো ওদের কাজ। পছন্দ হবে তবে
তো কিনব।
- বেশ।
- কোনো জিনিস কেনার সময়, পছন্দ হলে আমি এক পাশে সরিয়ে রাখব।
পরে তার মধ্যে থেকে বেছে নেব।
- আচ্ছা।
- পছন্দ হলেও আমি মুখটা স্বাভাবিক করে রাখব। আপনিও খুব পছন্দ
হয়েছে, এ রকম ভাব দেখবেন না। তাহলে দাম বাড়িয়ে দেবে।
- কেন? ওরা যে বলে ফিক্সড প্রাইস। তাছাড়া শাড়ির মধ্যে দাম তো
লেখা থাকে।
-শুনুন, দু-একটা দোকান ছাড়া বেশির ভাগ দোকানে দাম লেখা থাকে
না।
- থাকে, থাকে, এবিসিডি করে লেখা থাকে।
- আপনি পড়ে বুঝেছেন কোনোদিন, কত লেখা?
- না। ওদের কোড ওরা জানে।
- ওতে ওদের কেনা দামটা লেখা থাকে কোড দিয়ে। এবার ঝোপ বুঝে কোপ
মারে। তাই বেশি পছন্দ হয়েছে বুঝলে ওরা দাম চড়িয়ে বলবে।
- বাবা রে, বাবা। এত সব আছে নাকি?
- নয়তো বলছি কী।
তারপর থেকে নলিনবাবু স্ত্রীর সাথে বাজারে গেলে, বিড়ালের মতো
চুপচাপ বসে থাকেন। কমললতা পছন্দ করে দরাদরি করে দাম ঠিক হয়ে যাবার পর নলিনবাবু
দাম দিয়ে ব্যাগ হাতে করে নিয়ে বেরিয়ে আসেন বাঘের মতো। যেন উনিই বাজার করলেন। এদিনও
তার ব্যতিক্রম হল না। কমললতার পিছন পিছন থুড়ি সাথে সাথে প্রিয় নেপাল ব্যবসায়ীর
দোকানে ঢুকে খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। কমললতা গেলেন দোকানদারদের মাথা
খারাপ করতে। নানা রকমের দু-তিনশো শাড়ি দেখে কয়েকটা পছন্দ করলেন। মেয়েদের জন্য শাড়ি,
জামা, জামাইয়ের জামাকাপড়। তারপর নলিনবাবুকে ডাকলেন,
- শুনছেন? এদিকে একবার আসুন।
নলিনবাবু হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে গেলেন কমললতার দিকে। মনে
ভাবছেন, আজ কত টাকা গচ্চা যাবে কে জানে? কাছে যেতেই কমললতা বললেন,
- দেখুন তো এই ধুতি তিনটের মধ্যে কোনটা আপনার পছন্দ।
- তোমার যেটা পছন্দ সেটাই নাও।
- এই ধনেখালির ধুতিটা নিই?
এছাড়া আর একটা পাঞ্জাবি আর কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কিনতে
লাগলেন কমললতা। এমন সময় নলিনবাবুর ফোনটা বেজে উঠল।
- হ্যালো।
- হ্যালো, বাবা, আমি শীলা বলছি।
- হ্যাঁ, বল কী হয়েছে মা।
- একজন লোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
- কোথা থেকে এসেছে? কী নাম?
- বলছে তোমার অফিস থেকে। নাম একটা বলেছে আমার মনে নেই। কী করব?
ঘরে বসতে দেবো?
- একদম না। দরজা খুলবি না। বলে দে কাল অফিস গেলে আমার সাথে
দেখা করতে। আর বলে জানলাটা বন্ধ করে দিবি।
পুজো আসছে তাই সবারই টাকা চাই। যার চাকরি বা ব্যবসা আছে, তার
তো একটা উপায় উপার্জন আছে। এদিকে পচা আর পচার মতো কয়েকজন যেমন কালু, বটা আর ফটকে
এদের বাঁধা রোজগার বলতে কিছু নেই। এদের সংখ্যা এখন প্রচুর। কলকারখানা নেই, আর নতুন
হচ্ছেও না। হলে এদের মতো বেকার যারা, তারা কিছু কাজ পায়। এখন বহু বছর হল এরা
কমিশন, তোলাবাজি, চুরিচামারি করে খায়। এদেরই মতো একজন তার নাম নোকিয়া, নলিনবাবু
আর স্ত্রীর বাজার যাওয়ার সময় ওদের পিছু নিল। নলিনবাবু এক হাতে ছাতা আর অন্য হাতে
কমললতার হাত ধরে রেখেছেন। বুড়ো বয়সের কমবয়সী বউ। যাকে বলে বৃদ্ধস্য তরুণী
ভার্যা। বেহাত না হয়ে যায়, তাই হাত শক্ত করে ধরা। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাট করে নলিনবাবুর মানি ব্যাগটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে ঝেড়ে দিল
নোকিয়া। নোকিয়া নামটা কোথায় যেন শোনা শোনা লাগছে। যেদিন ও জন্মায় সেদিন ওর
বাবা লক্কা একজনের পকেট মেরে যে ফোনটা পেয়ে ছিল তার নাম ছিল নোকিয়া। তাই ওর বাবা
ওই নাম রাখে। একটু পিছিয়ে গিয়ে একটা নির্জন গলিতে ঢুকে নোকিয়া মানি ব্যাগটা বের
করে। বেশ ভারী ব্যাগ! মনে মনে ভাবল,
- উপরবালা যব দেতা হ্যায় ছপ্পর ফারকে দেতা হ্যায়।
যাক এবার পুজোটা ভালই কাটবে। মানি ব্যাগ খুলে দেখে, খুচরো টাকা
আর কয়েন মিলিয়ে সর্ব সাকুল্যে দেড়শো টাকা! আর এক গাদা নাম ঠিকানা লেখা কাগজ! এই
একটা কার্ড রয়েছে মনে হয়! ATM card হলে কথা নেই। চোরাই গলিতে একটা ওস্তাদ আছে, ও
পিন বের করে দেবে আধ ঘণ্টার মধ্যে। তারপর সাড়ে ন হাজার করে ফটাফট তিন-চারবার টাকা
বের করে নিলেই হল। ওমা এটা একটা অফিসের কার্ড! অফিসের নাম ঠিকানা আর বাড়ির ঠিকানা
আছে। যাহ্ এত রিস্ক নিয়ে পকেট মারাটা ফক্কা হয়ে গেল! দিনটা শুধু শুধু নষ্ট হতে
দিলে চলবে না। বাড়ির ঠিকানা তো গাঁজাগলি, সামনেই। নোকিয়া ভাবল বাড়িতে যদি
অফিসের নাম করে ঢোকা যায়, তাহলে কিছু হাতানো যেতে পারে। নলিনবাবু এই আধুনিক যুগেও
ধুতি পাঞ্জাবি পরেন। যাই বলো সাবেকি পোশাক ধুতি পাঞ্জাবির গ্ল্যামারই আলাদা।
তাছাড়া এই গ্রীষ্ম প্রধান দেশে, এত ভাল আরামদায়ক পোশাক হয় না বলেই ধারণা
নলিনবাবুর। শীতকালে ভেতরে লাক্স ইনফার্ণ ধরনের ইনার পরলেই আর শীত লাগে না। আর ওপরে
ফ্যাশনের জন্য একটা দামী শাল নিলেই হল। তবে পাঞ্জাবির তলায় সব সময় উনি একটা
ফতুয়া পরেন, যার মধ্যে একটা পকেট আলাদা করে দর্জিকে দিয়ে সেলাই করিয়ে নেন।
তাতেই বেশি করে টাকা, ATM card, Credit card এই সব রাখেন। আর হিজিবিজি কাগজ অফিসের
আই কার্ড আর খুচরো টাকা আর কয়েন রাখেন মানি ব্যাগে রাস্তায় খরচের জন্য। সেটা
থাকে পাঞ্জাবির পকেটে। নলিনবাবু কমললতাকে বললেন,
- শীলার ফোন এসেছে এই বার বাড়ি যেতে হবে।
দোকানের বিল দিতে হবে বত্রিশ হাজার সাতশো পঞ্চাশ টাকা, অভ্যাস
বশত পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে মানি ব্যাগ খুঁজলেন। দুই পকেটেই নেই, তার মানে কেউ,
ঘর থেকে এই দোকানের মাঝে রাস্তায় পকেট মেরেছে। এসব এখন কমললতাকে বলা যাবে না। শ
খানেক টাকা, কিছু কয়েন আর অফিসের আই কার্ড ছিল। সামান্য এই কয়েকটা জিনিসের জন্য
কমললতাকে উদ্বিগ্ন করার কোনো মানে হয় না। নলিনবাবু ফতুয়ার লুকানো পকেট থেকে,
ক্রেডিট কার্ড বের করে টাকা দিলেন। তারপর রিকশা করে বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়ি ফিরে
রিকশা থেকে নেমে দেখেন বাইরের লোহার গেটটা হাট করে খোলা। সদর দরজার পাশের জানলাটা
বন্ধ। কড়া নেড়ে নেড়ে হাত ব্যথা হয়ে গেল, ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ নেই। কী হল
চিন্তায় মাথা গরম হয়ে উঠছে। ফট করে কমললতা পাশ থেকে বললেন ফোন করুন। ফোন করতে
ওপাশ থেকে শীলার গলা পেয়ে আশ্বস্ত হলেন।
- কী হয়েছে? দরজা খোল। আমরা এসেছি।
- ও, বাবা। আসছি আসছি।
দরজা খুলে দুই মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরল। ঘরে
ঢুকে, দরজা লাগিয়ে ভেতরে এসে বসে সব কথা শুনলেন। শীলা বললে,
- তোমরা চলে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর সেই লোকটা এসে তোমার অফিসের
লোক বলে পরিচয় দিয়ে বলে, দরজা খোল খুব দরকারি কাজে এসেছি, তোমার বাবার সাথে দেখা
করে যাব। তখন আমি তোমায় ফোন করলাম। তারপর তুমি যা বলেছ আমি তাই করেছি। কিন্তু
লোকটা তারপর আবার এসে বলে, মামনি এক গ্লাস জল খাওয়াবে? আমি তাও চুপ করে ছিলাম।
আবার কিছুক্ষণ পরে এসে বলে, খুব দরকার ছিল, নাহলে তোমার বাবার ক্ষতি হবে। এই ভাবে
বারবার বিরক্ত করার পর আমরা এদিকের সব দরজা বন্ধ করে ভিতরের ঘরে গিয়ে টিভি চালিয়ে
দিয়ে বসে ছিলাম। তাই তোমরা ফিরে আসার আওয়াজ পাইনি।
এবার বলি চাঁদা নেবার কথা। এ পাড়া সে পাড়া সব পাড়া থেকেই
নলিনবাবুর কাছে চাঁদা নিতে আসে। ঘোষপাড়া, বোসপাড়া বটতলা, শিবতলা, শিমুলতলা সব
জায়গার চাঁদাই দেন, নলিনবাবু। দূরত্ব অনুযায়ী পঞ্চাশ, চল্লিশ, তিরিশ এই ভাবে।
শুধু পাড়ারটাই অনেক বেশি দিতে হয়। বাকিরা যে যেমন চাঁদা নিয়ে চলে গেছে। সেই দিন
সন্ধেবেলায় পাড়ার ছেলেরা এসে বললে,
- কাকু একটা আবদার আছে।
- কী ব্যাপার?
- আমরা চাই আপনি এবার পুজোর প্রতিমার দামটা দিন।
শুনে নলিনবাবুর মাথাটা গরম হয়ে গেল।
- কেন? সরকার দিচ্ছে পঞ্চাশ হাজার টাকা। আর তো চাঁদা নেবার
দরকার নেই।
- ওই টাকায় কী আর পুজো হয়?
- তাহলে? আমি কী লটারি পেয়েছি? না গুপ্তধন?
- না আমরা আবদার করছি আপনার কাছে।
- দেখো আবদার করলে তো আমি আমার মাথাটা কেটে দিয়ে দিতে পারি
না। গতবার যা দিয়েছি তাই দেবো।
- ঠিক আছে আমরা আলোচনা করে আপনাকে পরে জানাব।
- মানে? আমি কত টাকা চাঁদা দেব সেটা তোমরা ঠিক করবে? এটা কী
মগের মুলুক নাকি।
- এর মধ্যে একটা উঠতি ছোকরা বলে, পাড়ায় থাকবেন আর চাঁদা ঠিক
মতো দেবেন না। সেটা কি ঠিক?
- দেখো, আমার কিন্তু থানার আইসির সাথে ভাল সম্পর্ক আছে।
এরপর নিজেদের মধ্যে খানিক গুজগুজ করে বলল,
- ঠিক আছে গতবার যা দিয়েছিলেন তার থেকে হাজার টাকা বেশি দিন।
- ঠিক আছে বিল কেটে দিয়ে যাও। কাল আমি ATM থেকে টাকা তুলে আনব,
সন্ধেবেলা এসে নিয়ে যেও।
বিল কেটে দিয়ে বলল, আপনারা পুজোয় থাকবেন কিন্তু এবার
প্রত্যেকদিন নানা রকম প্রতিযোগিতা রাখা হচ্ছে, যেমন ফুঁ দিয়ে ধুপকাঠি নেভানো,
অঙ্গভঙ্গি করে কথা বোঝানো ইত্যাদি আরো অনেক। তারপর
- চল চল ব্যাংকের ম্যানেজারের বাড়িতে চল। বলতে বলতে সব চলে
গেল।
নলিনবাবু মনে মনে বললেন,
- দুগ্গা, দুগ্গা, এ বছরের মতো এদিকটা মিটল। এখন অফিস পাড়ার
ব্যাপারটা ভালয় ভালয় মিটলে হয়। মা মাগো রক্ষা করো।
শুভ শারদীয়া
বাহ!
ReplyDeleteবেশ ভালো হয়েছে গল্পটা। তবে রম্যরচনা বলতে পারছি না আমি। রম্যরচনার স্যাটায়ার তেমন নেই মনে হলো।
ReplyDelete