বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/১ম
বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১৯শে আশ্বিন, ১৪৩০
শারদ | ছোটগল্প
মুনমুন মুখার্জি
বন্ধুত্ব
কিছুদিন আগে পর্যন্ত কী সুন্দর ছিল তাদের দুই বন্ধুর সম্পর্কটা।
ইস্কুলে পাশাপাশি বসা, একসাথে টিফিন খাওয়া, ছুটির পরে একসাথে বাড়ি ফেরা। দেড় মাস
বাদে দুর্গা পুজো। তাই নিয়ে দুই বন্ধু রজত ও সিধুর কত চিন্তা, আবেগ, উত্তেজনা, পরিকল্পনা।
দু’জনে ইস্কুলের টিফিন পিরিয়ডে মাঠে বসে কত কথা হত। আবার ছুটির পরে কত হুড়োহুড়ি,
ক্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা। সব যেন হঠাৎ দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেল।
এর আগে যে কখনও ঝগড়া বা মতান্তর হয়নি
তা নয়। আবার তা সহজে মিটেও গিয়েছিল। এবার তেমন কোন আবহ নেই। দু’জনেই ক্লাস এইটের
ছাত্র। একই ক্লাস, একই বিভাগ। দুই বন্ধুর মধ্যে ঝামেলার কারণ হল একটি সারমেয়। অর্থাৎ
একটি ছোট্ট কুকুর ছানা। একদিন বিকেলে রজত ও সিধু স্কুল ছুটির পর একসাথে বাড়ি ফিরছিল।
সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ, বিকেল থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। খানিকটা এগিয়ে কৃষ্ণচূড়া
গাছের তলায় তারা দেখতে পেল খুব সুন্দর একটা ছোট্ট কুকুর ছানা। দু’জনেই তার দিকে ছুটে
গেল। রজত প্রথমে কুকুর ছানাটা কোলে নিয়ে বলল, 'ইশ্, বেচারা একদম ভিজে গেছে। একে এক্ষুনি
বাড়ি নিয়ে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে, গরম দুধ খাওয়াতে হবে।' সিধু তখন হাত বাড়িয়ে
ছানাটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, 'তুই কী করে ওর যত্ন করবি? কাকু-কাকিমা তো অফিস
থেকে ফেরে সেই সাতটা-সাড়ে সাতটা। মিনতি মাসি টিফিন করে দেবে, নাকি এইসব কুকুর ছানাকে
যত্ন করবে? ধুস্! তুই পারবি না, বেকার তোর বাড়ি নিয়ে যাস না। আমার বাড়িতে মা আছেন,
ঠাম্মা আছেন। সবাই আছে। ওরাই ভাল করে দেখভাল করতে পারবে।' কথাটা শেষ করতে না করতেই
রজতের কোল থেকে সিধু কুকুর বাচ্চাটাকে নিয়ে এক ছুটে বাড়ি। দু’জনের বাড়ি একই পাড়ায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় রজত রেগে লাল হয়ে গেল। সে দূর থেকেই সিধুকে ঝাঁঝিয়ে উঠল, 'আমি
প্রথম কুকুর ছানাটাকে দেখলাম, কোলে নিলাম, আদর করলাম, আর তুই একেবারে ছোঁ মেরে নিয়ে
চলে গেলি!' রজতের রাগের সঙ্গে সঙ্গে তার কপালের নীচে ভ্রূ জোড়া ধনুকের মতো হয়ে উঠল।
চোখে খানিক জল চলে এল, কিন্তু সিধু ততক্ষণে বাড়ি পৌঁছে গেছে। খানিক বাদে সন্ধ্যাবেলায়
রজতের মা অফিস থেকে ফিরলেন। তার খানিক বাদে বাবা দেবাংশু বসু। দুজনেই রাজ্য সরকারের
কর্মী। রজতের দুঃখ-কান্না দেখে তারা মনে মনে বেশ হাসলেন রজতের ছেলেমানুষি দেখে। মুখে
বললেন, 'তাতে কী! সিধুর কাছে থাকাও যা, তোমার কাছে থাকাও তো এক। তাই না? সোজা কথা হচ্ছে
কুকুর ছানাটা যাতে ভাল থাকে, তাই না?' কিন্তু রজতবাবুর মুখ ভার। মন খুবই খারাপ। প্রাণের
বন্ধু সিধুর সাথে কথা বলা একদম বন্ধ। ক্লাসেও এই নিয়ে জোর কানাঘুষো চলছে। কিন্তু দু’পক্ষই
চুপচাপ। এদিকে নতুন পুষ্যি পেয়ে সিধুর লেখাপড়া, নাওয়া-খাওয়া, ঘুম সব মাথায় উঠেছে।
ঠাম্মি কিছু না বললেও সিধুর বাবা-মা মনে মনে বেশ একটু বিরক্ত হয়ে উঠছেন। কিন্তু কী
আর করেন? পুষ্যিটা হল এখন ধ্যান-জ্ঞান নয়নের মণি। এভাবেই চলছিল সপ্তাহ খানেক। হঠাৎ
একদিন রোববার সকালে দেবাংশুবাবুর বাড়িতে ফোন আসে যে সিধুর কাল থেকে ধুম জ্বর। তাই
দু'দিন হয়তো স্কুল কামাই হবে, রজত যদি পড়াগুলো একটু জানিয়ে দেয় যেগুলো এই ক’দিন
ক্লাসে হবে, তাহলে খুব ভাল হয়। দেবাংশুবাবু তো শুনেই বললেন, অবশ্যই রজত পড়াগুলো পাঠিয়ে
দেবে। সিধুর শরীর খারাপ শুনে রজতের মনটা যেন কেমন করে উঠল। যতই হোক মনে মনে তো তারা
একে অপরের খুব ভাল বন্ধু এখনও আছে। না-হয়, সামান্য একটা কারণে মনোমালিন্য হয়েছে,
কিন্তু রজতের কাছে সিধুর চেয়ে ভাল বন্ধু তো আর হবে না। তাই সে রবিবার বেলার দিকে নিজেই
সিধুকে দেখতে গেল। রজতের বাবা-মা’ও তার এই মনোভাবে খুশি হলেন। রজত গিয়ে দেখল যে সিধু
খাটে শুয়ে আছে তবে ঘুমোয়নি। সিধুর মাথার কাছে এসে বসল রজত। 'এখন আর জ্বর বেশি নেই।
আগের থেকে কমেছে', বলল সিধু। 'দেখবি, কাল একদম ঠিক হয়ে যাবি', রজত বলল সিধুকে। সিধু
রজতের কাঁধে হাত রেখে বলল, 'আমাকে ক্ষমা করে দে, সেদিন ওভাবে কুকুর ছানাটাকে তোর থেকে
কেড়ে নিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি।' 'ধুস্! তাতে কী!', রজত বলে উঠল। 'মা তো বলেছেন, তোর
কাছে থাকাও যা, আমার কাছে থাকাও তাই। শুধু ভাল থাকলেই হল।' এমন সময় সিধুর বাবা, রমেশকাকু
পেশায় উকিল, কুকুর ছানাটাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মাটিতে নামিয়ে বললেন, 'দেখো তো
রজত চিনতে পারছ কিনা?' সত্যিই তো! রজত দেখল সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে একসা হয়ে কুকুর বাচ্চটার
কী দশা হয়েছিল। এখন কত সুন্দর ফুটফুটে লাগছে। 'সব করেছেন তোমাদের ঠাম্মি', বললেন রমেশবাবু,
'নাও এবার তুমি এইটাকে কিছুদিন নিয়ে রাখো।' 'আমি আবার কেন!', বলে রজত আপত্তি করার
আগেই সিধু রজতের হাত দুটো ধরে বলে, 'প্লিজ, তুই নিয়ে যা। আমার কাছেও থাকবে, তোর কাছেও
থাকবে।' 'একদম ঠিক বলেছিস', রজত হেসে সায় দিল। এদিকে ঠাম্মি নিয়ে উপস্থিত লুচি, আলুর
দম ও মিষ্টি। ঠাম্মির জোর হুকুম, 'না খেয়ে, রজত দাদুভাইয়ের কোথাও যাওয়া হবে না। আচ্ছা
দাদুভাইরা তোমরা এই কুকুর ছানাটার একটা নাম দিলে না তো?' ঠাম্মি বলে উঠল। 'আমি কিন্তু
ওর নাম রেখেছি একটা, টিঙ্কু, নামটা কেমন বল তো? পছন্দ হয় নাকি তোমাদের?’ ঠাম্মি বেশ
মজা করে কথাগুলো বলল। রজত ও সিধু দু’জনেই খুশি, তাদের পুষ্যির নাম শুনে। ঠাম্মি দু’জনের
মুখেই একটা করে রসগোল্লা পুরে দিলেন। শরতের ঝকঝকে নীল আকাশের মতোই দুই বন্ধুর মুখখানি
হাসিতে ভরে উঠল। ক’দিন বাদেই সিধুর জ্বর সেরে গেল। দুই বন্ধু মিলে পুজোর আনন্দে মেতে
উঠল। রজত ও সিধুর এই বন্ধুত্বের পুনর্মিলনে তার বাড়ির লোকেরা খুব খুশি। তারা বুঝতে
পারত তারা দুই বন্ধু, বন্ধুত্বের সম্পর্ক একদম নিখাদ। বন্ধুত্বের মধ্যে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা
সব কিছুকেই ভাগ করে নিতে হয়। সম্পর্ক ভাঙে, আবার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটাই জীবনের মূল
উপকথা।
সমাপ্ত
খুব ভালো ছোটদের গল্প
ReplyDelete