আইডেন্টিটি
২
দ্বিতীয় জন সুজাতা।
বুদ্ধদেবের সুজাতা নন, কিন্তু প্রায় তার মতো। ইনি নবীন কবি, উন্নতিকামী এবং অরক্ষণীয়া।
অবশ্য কবি হলেই তাকে রক্ষণীয়া হতে হবে এমন কথা নেই। স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে পারেননি
ফলে যা হয় বড়ো-মেজো-সেজো সব কবিরাই পিছনে লাইন মারতে শুরু করেছে। আসলে
স্বামী-পরিত্যক্তা নারীকে লুটের মালের মতো ভোগ করতে কে-না চায়!
তা সুজাতা
বুদ্ধদেবের সুজাতার মতোই পায়েসের বাটি থুরি কবিতার খাতা নিয়ে বিভিন্ন কবির দরজায়
দরজায় (পড়ুন দরগায়) হত্যে দেয় যদি তাঁর দয়ায় কবিতার কিছু উন্নতি হয়। কেউ কেউ হয়তো
পরম মমতায় কথা শোনে আবার কেউ কেউ অন্য ধান্ধায় থাকে। তাদের ঘাড়ের লোম খাড়া খাড়া
হয়ে ওঠে, চোখ লাল, গলা দিয়ে অদৃশ্য (এখানেও পড়ুন অশ্রাব্য) গড়ড়… গড়ড়… শব্দ বের হয়।
৩
আর তৃতীয় জন হলেন শ্যাম
ওরফে সেয়ানা। চোখ দু’টো নারায়ণ-ট্যাড়া, (অবশ্য নারায়ণ ট্যাড়া ছিলেন কিনা জানা যায়নি।)
কৃষ্ণের মতোই গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হলেও তিনি মোটেই বাঁশি বাজাতে পারেন না, ফলে
গোপিনীরাও কাছে ঘেঁষে না। ইনিও তথাকথিত একজন কবি ও অন্যের ভাবনা তাকে না বলে, তার
প্রাপ্য সৌজন্যটুকুও না দেখিয়ে বেমালুম হজম করে নিজের নামে প্রচার ও প্রসারে
যথেষ্ট যত্নবান। আদতে ইনিও আর একজন দাদা। দুষ্টু লোকেরা তাকে বিশ্ব-আঁতেল বলে, আর
অধিকাংশ লোকই দুষ্টু।
৪
সুজাতা পিরের দরগায়
ঘুরতে ঘুরতে কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে একদিন মহাদেবের কাছে গেল এবং তপস্যায় বসল।
মহাদেব সহজেই খুশি হলেন। ক্লাস করানোর মতো করে ভরাতে থাকলেন সুজাতার কবিতার খাতা।
বলাই বাহুল্য প্রয়োজনে অনেক কবিতাই নিজে লিখে দিলেন। সুজাতার কবিতা অনেকেরই নজরে
পড়ল। দাদাদেরও চোখ এড়াল না।
তখন বর্ষাকাল।
বাদলের কালো মেঘ কালিদাসের বার্তা না পেয়ে পাগলের মতো এদিক-ওদিক ঘুরছিল, যেন শুধু
আদেশের অপেক্ষা। এদিকে সুজাতা একঘেয়ে জীবনের স্বাদ ছেড়ে অন্য কিছু পেতে চাইছিল।
অনেক তো হল মন-বিনা-প্রেম, জৈবিক চাহিদা মেটানো নেহাত পুরোনো। এবার চাই খ্যাতি। এক
ডাকে না হলেও যাতে অনেকেই কবি হিসেবে তাকে চিনতে পারে।
দাদা সতর্কই ছিল,
মওকা বুঝে বাদলের কালো মেঘেদের কাছে কালিদাসের মতো চিরকুট পাঠিয়ে উত্তরের অপেক্ষায়
রইল। অন্ধকার আকাশ বাদলের মেঘে আরোই অন্ধকার ছিল। কিন্তু দাদার প্রতীক্ষা তারই
মধ্যে চাঁদ-তারা-নক্ষত্র খুঁজে পেল। তার অস্তিত্বের খবর শুধু দাদার অন্তরাত্মাই
জানে।
বাদলের মেঘ সুজাতার
খোঁজে বাড়িতে, অফিসে, সভাসমিতিতে কোথায়-না-কোথায় খুঁজে খুঁজে অবশেষে পেল, যেখানে
দিন শেষ করে রাতের শুরুর মতো দিনের বেলাতেও অন্ধকার। সুজাতা পেল দাদার বার্তা।
দেখল মহাভারতের থেকে ছোট কিন্তু অনেক বড়। অন্ধকারে ঠিক মতো পড়তেও পারল না। কী বুঝল
তা কে জানে! মনে হল পেয়ে গেছে কাঙ্ক্ষিত সিঁড়ি। ভুল হলে বাজারে ছাড়ানো মুরগি অনেকই
তো আছে…
এদিকে শ্যাম সেয়ানা
হলেও দেখল, বড়ো বেগতিক। কিছু একটা পথ খুঁজে বের করতেই হবে। অথচ আলাপটাও গুছিয়ে
হয়নি তখনও। পৃথিবীতে ধর্মের ব্যবসা আর বুজরুকি সব থেকে বড়। অনেক ভেবে সন্ন্যাসী
সেজে, না-বলে ধার নেওয়া জ্ঞানের বাণী বিতরণ শুরু করে দিল। ধর্মপ্রাণ মানুষ অনেকেই
নদীতীরে গাছতলায় সকাল-সন্ধে ভিড় জমালো। সন্ন্যাসীর সাজের আড়ালে সে অনেক কিছু লুকোলেও
ফোঁস লুকোতে পারল না। যদিও মন্দ লোকে বলে যতই ফোঁস থাক-না-কেন আসলে সে ঢোঁড়া সাপ।
সুজাতা একসঙ্গে
দু-নৌকায় পা দিয়ে চলা বুদ্ধির কাজ হবে না ভেবে সিদ্ধান্ত নিল একটা একটা করে দৌড়
দেখে নেওয়াই ভাল। ততদিনে বর্ষা বিদায় নিয়েছে, পেঁজা-তুলোর মতো শরতের নির্ভার মেঘ
আকাশ জুড়ে উড়ে যায় দূর দেশে। শুধু তারই মন নির্ভার হতে পারে না। ওদের মতো ভেসে
ভেসে কবে সে যাবে দেশান্তরে? কিছুই হল না। মিটছে না কিছুই। না পুরোপুরি জৈবিক
চাহিদা, না খ্যাতি… শুধু শুধু…
উদ্দেশ্য সিদ্ধ না
হওয়ায় শ্যাম ফুলের দোকান দিল। দোকানে রকমারি ফুলের বাহার। সবই যে সত্যি ফুল তা নয়,
অনেক সিন্থেটিক ফুলও ছিল, ফলে রুম-ফ্রেশনার, সুগন্ধি ধূপ সঙ্গে ব্লুটুথ স্পিকারে পণ্ডিত
হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাবার আগে বা ইচ্ছে হলেই সেজেগুজে
মেয়েরা আসত ফুল কিনতে, বাঁধা খোঁপা সাজাতে। যদি কোনদিন আসে সুজাতা… হাল ছাড়তে সে
রাজি নয়।
হেমন্তের বিষণ্ণ
বেলায় একা একা বিরসবদনে দাদা ছাদে বসে ভাবছিল… কিছুই ভাল লাগছে না। জম্পেশ কিছু
একটা করতে হবে এবার। ভাবতে ভাবতে, ভাবতে ভাবতে… ভাবনা দৃঢ় হল তার। এমন একটা দল
গড়তে হবে যেখানে সবাই কথা শুনবে, সোজা কথায় ইয়েস-ম্যান দরকার। আর, আবারও কিছু লেখা
দরকার। কিন্তু লেখা তো আসছে না, বাধ্য হয়েই গেল গুদামে আত্মসাৎ করতে। খুঁজতে
খুঁজতে, খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল বেশ কয়েক বছরের পুরনো একটা গল্প। ভাল লাগল গল্পটা,
বেশ আন-কমন, পাবলিক খাবে ভাল। সৌজন্যের ইয়ে… কিছু বাদছাদ দিয়ে নামিয়ে দিল। এবার
একটা কবিতা দরকার। সুজাতা যখন… বুদ্ধদেবের ওপর যদি কিছু পেয়ে যায়, বেশি খুঁজতে হল
না। আবারও পেয়ে গেল। বাদ দিল কিছু, জুড়ে দিল কিছু, আসলে সে নিজেও তো কবি। সৌজন্যের
মা… এরকম আরও কত লেখা কে জানে! পাঠিয়ে দিল বিভিন্ন পত্রিকায়। এবারে কে আর রোখে? আসন্ন
শীতে সে-ই হবে শিরোমণি। রণে-বনে-জলে-জঙ্গলের মতো সর্বত্র শুধুই জলহস্তী দাদা থুরি
কবি।
সেবার অনেক
সকালসকাল বসন্ত এল। বসন্তের মৃদুমন্দ হাওয়ায় গা ভাসিয়ে নিতান্তই বেসুরো হেঁড়ে গলায়
গুনগুন করছিল শ্যাম। বসন্ত কার মনেই না দোলা দেয়! ঠিক সেই সময় সুজাতা ফুল কিনতে
বাজারে যাচ্ছিল। কবি-সভায় যাবে সেজেগুজে, মাথায় ফুল লাগিয়ে। শ্যামের দোকানে ঢুকে
পড়ল। শ্যাম অযাচিত সুযোগ পেয়ে সুজাতাকে অনেকগুলো ফুল দিল উপহার স্বরূপ। কুশল
বিনিময়ের সঙ্গে নিজের ঢাক পেটাতেও ছাড়ল না। সেই-সঙ্গে আরও কত কী…
এদিকে সোশ্যাল-নেটওয়ার্কিং-সাইটের
দৌলতে সুজাতা বিদেশে মিতালি পাতিয়েছে। বেশ নাম করা, মালদার। সুজাতা ভাবল নামযশ…
পেতেই হবে, সেই-সঙ্গে বিদেশের নাগরিকত্ব। কিন্তু তার একটা বাহন দরকার। কাজেই
সুজাতা শ্যামের বেসুরো সুরেই সুর মেলাবার কথা ভাবল। এরপর সুজাতা পায়েসের বাটি হাতে
রোজই শ্যামের দোকানে যায়। তার কবিতার খাতাও ভরে ওঠে শ্যামের হাতের লেখায়। টুকটাক
ছাপা হয় এদিক-ওদিক। কাজেই বিভিন্ন সাহিত্যসভায় ডাকও পায়। অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ
আসে বিদেশ থেকে। সুজাতা যেমন চেয়েছিল…
ইতিমধ্যে কে যেন
রটিয়ে দিল, মহাদেব নেই। চতুর্দিকে খোঁজ খোঁজ খোঁজ… খোঁজ চলতেই থাকল। কিন্তু
মহাদেবকে সশরীরে পাওয়া গেল না কোথাও। সকলেরই ধারণা হল মহাদেব মারা গেছে। দাদা দেখল
এমন মওকা ছাড়া যাবে না। তাঁর উদ্দেশ্যে স্মরণসভার আয়োজন করা যাক। মহাদেবকে সকলেই
মানে অতএব এখানে সে-ই ছড়ি ঘোরাবে, তার কথার অন্যথা হবে না। যে-কোন ঝান্ডার তলায়
থাকা মানুষদের এই এক সমস্যা গণতন্ত্রকে চুলোয় দিয়ে ছড়ি ঘোরানোর লোভ সামলাতে পারে
না। এই সুযোগে সুজাতা ফেলে আসা দিনের কথা ভেবে… অজানা, অচেনা এক মায়ায়… মনকেমনের
সুরে কটা-দিন দাদার গায়ে গা ঘসে… তা অভিনয় ছিল কিনা কে জানে!
স্মরণসভাও হল।
ধ্যাত মাইরি!
মহাদেব আবার মরে নাকি…
সমাপ্ত
দারুণ হয়েছে লেখাটা। পড়ে বেশ মজা পেলাম। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
ReplyDeleteধন্যবাদ, ভাল লাগল। তবে আপনার পরিচয় জানতে পারলে আরও ভাল লাগত।
ReplyDeleteঅজয় দেবনাথ
বাস্তবের ছবি এঁকেছেন । ভালো লাগলো ।
ReplyDeleteবাস্তবের ছবি এঁকেছেন । ভালো লাগলো ।
ReplyDeleteআন্তরিক ধন্যবাদ সুধাংশুবাবু, সঙ্গে থাকুন।
Deleteদারুন লিখেছেন অজয়দা।আসলেই সুজাতা সুবিধা বাদাী, এরকম বহু মেয়ে নিজের স্বার্থের জন্য এরকম করে।আপনাকে শুভকামনা জানাই।
ReplyDeleteমনে হচ্ছে চিনতে পেরেছি, তবু নিজের পরিচয় দিলে স্পষ্ট হোতো। যাইহোক, ধন্যবাদ জানাই দূরের বন্ধুকে।
Deleteঅসাধারণ লেখনী ❤️🙏
ReplyDeleteচিনতে পারলাম কি? লেখার ধরণে অনুমান করতে পারি। তবু নিজের পরিচয় দিলে স্পষ্ট হয়। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
Delete