ডেলিভারি বয়
না আসলে আজ তো আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি তাই ভাবলাম একটু
পুজো দিই। অয়ন চমকে উঠে বলল, 'এই রে, একদম মনে নেই, সরি ডার্লিং হ্যাপি অ্যানিভার্সারি।'
শ্রীতমা একগাল হেসে বলল, ‘তবে আমরা মন্দিরে কখন যাচ্ছি?’ অয়ন বলল, 'আজ নয় আজ তো
অফিস কলিগের বাড়িতে পার্টি আছে ওদের কথা দিয়েছি ওখানে যেতেই হবে। আর তুমি তো জানো
এসব পুজো আমার কাছে বড্ড বোরিং। তুমি যেতে চাইলে ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি গাড়ি
নিয়ে চলে যেও। আর হ্যাঁ তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পোড়ো, আমার ফিরতে অনেকটাই দেরি হবে। আর
আজ তোমায় রান্না করতে হবে না আমি খাবার অর্ডার করে দিচ্ছি তুমি খেয়ে নিও।’ এই
কথা বলে অয়নের অফিসের পিএ রুমেলার সাথে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
শ্রীতমা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, কাজল লেপ্টে চোখের কোন
বেয়ে দু ফোঁটা জল নেমে এলো গালের ওপর। এক হাত দিয়ে চুলের খোঁপাটা খুলে ফেলল,
খোঁপায় লাগানো বাগানের টাটকা গোলাপগুলো মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
তিনটে বছর ধরে এভাবেই অবহেলা পেয়ে আসছে শ্রীতমা। সাজ, শৌখিনতা,
খাওয়াদাওয়া কোনো কিছুই অভাব রাখে না অয়ন, তবে শ্রীতমার জীবনে এসবের থেকেও অনেক
বড় একটা অভাব আছে যে অভাব মানুষকে তিল তিল মেরে ফেলে ভেতর ভেতর সে কথা আর কখনোই
অয়ন বুঝে উঠতে পারল না।
এমন সময় দরজার ওপার থেকে কলিং বেলের শব্দ ভেসে এলো। শ্রীতমা
দরজাটা খুলে খাবারটা নিতে যাবে ঠিক সেই সময় দেখতে পেল, ডেলিভারি বয় এসে গেছে।
যার গায়ে একটা লাল রঙের টি শার্ট পিঠে একটা বড় ব্যাগ সেখান থেকেই খাবারের
প্যাকেটটা বের করে শ্রীতমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু চোখে চোখ পড়তেই দুজনেই
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। মাঝখানে কিছুটা সময় থেমে থাকল, নিস্তব্ধতার
একটা ঢেউ খেলে গেল ওদের দুজনের মাঝে। বহু পরিচিত মুখ যখন অচেনার মধ্যে এসে
সৌজন্যতা পেতে চায় তখনই মানুষ বোধহয় এভাবেই জ্ঞান হারায়। তবে নিস্তব্ধতা ভেঙে
অর্কই প্রথম শ্রীতমাকে প্রশ্ন করল, 'কেমন আছ শ্রীতমা?' কিছু একটা গলার কাছ থেকে
গিলে নিয়ে শ্রীতমা উত্তর দিল, 'ভাল আছি।' তারপর অর্ক প্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে বলল, 'এই
যে তোমার অর্ডারটা, এবার তবে চলি!' শ্রীতমা অর্কের চোখের দিকে নিজের ধীর স্থির চাহনি
রেখে বলল, 'এতদিন পর দেখা হলো এখনই চলে যাবে! ঘরে এসো।' অর্ক ঘড়িতে সময়টা দেখে
নিলো একবার। তারপর শ্রীতমার কথা মতো ঘরে ঢুকল।
ঘরে ঢুকে অবাক হল অর্ক, চারপাশে সাদা ঝকঝকে মার্বেলের মেঝে, চারদিকের
দেওয়ালে কত রকমের ছবি আঁকা, মাথার ওপর ফল্স সিলিং থেকে ঝুলছে আলোর ঝাড়। চারপাশে
কাঠের আর পোড়া মাটির তৈরি নকশা। এ যেন সত্যিই রাজমহল। মনে মনে ভাবল অর্ক, শ্রীতমা
একদিকে ভালই করেছে ওকে ছেড়ে অয়নকে বিয়ে করে। নয়তো এত সুখ কখনোই অর্ক শ্রীতমাকে
দিতে পারত না। শ্রীতমা অর্ককে জিজ্ঞেস করল, 'কী খাবে? চা না কফি?' অর্ক বলল, 'না
না আমি কিছুই খাব না।' শ্রীতমা অর্কের পাশে এসে বসল, অর্কের দিকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস
করল, ‘এখনো মনে পড়ে আমাকে? জানি এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার অধিকার আমার নেই তবু মন
চাইল।’ অর্ক মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে বলল, ‘একটা সময় খুব মনে পড়ত। যখন তুমি
আমায় ছেড়ে তোমার বাবার কথা মতো অয়নকে বিয়ে করলে। আমার সামনে এসে যখন বলেছিলে,
আমার যেটুকু রোজগার তাতে তোমার এক মাসের হাতখরচও হবে না সেদিন তোমাকে ফেরানোর জন্য
অনেক চেষ্টা করেছিলাম। আমিও চেয়েছিলাম তোমাকে ভাল রাখতে, সুখে রাখতে কিন্তু তুমি
আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাওনি। আমি সেদিন বুঝেছিলাম বিলাসিতার খিদে যে এত বড়, যা
মনের খিদেকেও কিনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। নয়তো ছ বছরের সম্পর্ককে এভাবে ভেঙে দিয়ে
চলে যেতে পারে মানুষ! হয়তো পারে। তবে তুমি ছেড়ে যাওয়ার পরে পথেঘাটে পরিচিত-অপরিচিত
সব সময় খেপিয়েছে আমায়, আমার রোজগার নিয়ে তামাশা করেছে। কষ্ট হোতো খুব সেই
সময়গুলো তারপর কবে যেন এই যন্ত্রণাও হজম করে ফেললাম। তবে সত্যি বলতে এখন আর
তোমায় মনে পড়ে না আগের মতো।’
শ্রীতমা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, মুখ থেকে আর কোনো শব্দ
উচ্চারণ করতে পারছে না ও। শুধু ফিশফিশ করে একটা কথা কানে এলো অর্কের 'পারলে আমায়
ক্ষমা করে দিও।'
অর্ক শ্রীতমার দিকে ঠান্ডা চাহনি রেখে বলল, 'দেখো আমার কিন্তু
এসব নিয়ে আর কোনো রাগ নেই, অভিমানও নেই। যদি সেসব এখনো মনের মধ্যে পুষে রাখতাম
তবে আমি কিন্তু গেট থেকেই বিদায় নিতাম, আমরা বন্ধু ছিলাম কোনো একসময় এইটুকু
সম্পর্ক তো আছেই আমাদের মধ্যে।'
এবার শ্রীতমার কপালের ভাঁজ থেকে ঘামের বিন্দু বিন্দু রেখা মুছে
গেল। ওর চোখেমুখে শ্রান্তির ছাপ ফুটে উঠল।
শ্রীতমা অর্কের কাছে আবদারের সুরে বলল, 'তবে আজ ডিনারটা এখানেই
করে যাও।'
অর্ক শ্রীতমাকে বলল, 'আজ নয় আবার যদি কোনোদিন দেখা হয় সেদিন
একসাথে ডিনার করব, আজ আমার স্ত্রী পর্নার জন্মদিন ওকে কথা দিয়েছি আজ রাতে ওকে
নিয়ে ডিনারে যাব। আসলে কী জানো তো বাকি দিনগুলোতে ওকে একদম সময় দিতে পারি না তাই
এই দিনগুলো আমাদের কাছে খুব স্পেশাল। তুমি ভাল থেকো, এবার আসি।' এই বলেই মেইন দরজা
দিয়ে বেরিয়ে গেল অর্ক।
বাইরে বাইক স্টার্ট দিল অর্ক, কিন্তু যাওয়ার সময় আগের মতো
একবারও পিছনে ফিরে তাকাল না শ্রীতমার দিকে। অর্ক চলে গেল পথের ধুলো উড়িয়ে,
শ্রীতমার চোখ ভিজে গেল অতীতের আপশোশ আর অপরাধবোধে। মনে মনে ভাবতে থাকল, যে অর্ককে
ছেড়ে আজ সে অন্যের হাত ধরেছে শুধু মাত্র নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিলাসবহুল জীবনের
কথা ভেবে সেই অর্কই আজ সুখ আর অসুখের মধ্যে বিস্তর তফাৎটা বুঝিয়ে দিয়ে গেল।
সমাপ্ত
Very nice
ReplyDeleteভালো লাগলো
ReplyDelete