প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Friday, January 12, 2024

পিকনিক সংস্কৃতি ও রাজনীতি | তন্ময় কবিরাজ

বাতায়ন/অন্য চোখে/১ম বর্ষ/২৮তম সংখ্যা/২৭শে পৌষ, ১৪৩০

অন্য চোখে
তন্ময় কবিরাজ

পিকনিক সংস্কৃতি ও রাজনীতি


পিকনিক। বাঙালির আদুরে আলাপে বর্তমানে ফিস্টি। পিকনিক ফরাসি শব্দ যার অর্থ প্রকৃতির কোলে বসে খাওয়াদাওয়া করা আর সঙ্গে মজা। যদিও বাংলাতে পিকনিকের দুটি শব্দ রয়েছে, এক চড়ুইভাতি, অন্যটি বনভোজন। উল্লেখ্য যে, চড়ুইভাতি শব্দের প্রথম যাত্রা শুরু হয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন বা হরিচরণের অভিধানে। বনভোজন শব্দের সর্ব প্রথম প্রয়োগ হয় রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন নাটকে। শব্দের অর্থ যাইহোক না কেন, পিকনিক বিবর্তিত হয়েছে সময়ের স্রোতে।

ধর্ম সংস্কৃতি রাজনীতির রঙে পিকনিকের আনন্দ মিশে গেছে, হয়ে উঠেছে মিলন ক্ষেত্র, একঘেয়ে জীবনকে সাময়িক বিদায় জানাবার সাহস, কখনও বা সামাজিক প্রচারের আবেগ হাতিয়ার। যদিও পিকনিকের উৎস নিয়ে মতভেদ বর্তমান। ফ্রান্স, ব্রিটেনকে পিকনিকের আঁতুড় ঘর বললেও ভারতে কিন্তু পিকনিকের অস্তিত্ব ছিল সেই মহাভারত যুগেও। কৃষ্ণ, বলরাম, অর্জুনের পিকনিক হোত, থাকত সুরা পানের সুব্যবস্থা। এমনকি সেই পিকনিকের আড়ালেই ভীমকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার চক্রান্ত করে দুর্যোধন। ছবিটা কিন্তু আজও একই আছে। বরং আরও প্রকট হয়েছে। ভোজপুরি গান আর চড়া অ্যালকোহল ছাড়া আজকের পিকনিক ভাবাই যায় না। মদ্যপ অবস্থায় খুন, ধর্ষণ তো প্রায়শই ঘটছে। তবে ভারতের পিকনিক কালচারে আমেরিকা, পূর্ব এশিয়ার প্রভাব রয়েছে। যদিও ভারত তার মধ্যেও স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। চোখের বালিতে আশালতা বিনোদিনীর পিকনিক বা অরণ্যের দিনরাত্রি বা মার্গারেট মিশেলের গড উইথ দা উইন্ড কিংবা টেনিদার পিকনিক বাঙালি আজও যত্ন করে লালনপালন করে আসছে। গল্পকার মঘাম বলেছেন, পিকনিক আসলে, "দেয়ার আর ফেউ থিংস সো প্লিসন্ট অ্যস এ পিকনিক লাঞ্চ।"

হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার মতো ভারতের পিকনিক ইতিহাসেও রয়েছে শ্রেণী বৈষম্য, বিলাসিতা আর আড়ম্বর। শোনা যায়, ১৯৩৭ সালের জয়পুরের মহারাজা যে বিশাল পিকনিকের আয়োজন করেছিলেন তাতে লরি করে খাবার এসেছিল। খাবারের মেনুতে ভারতীয় খাবারের পাশাপাশি ছিল ইউরোপীয় খাবারের বাহার। পিকনিকের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সেখানে নেই। আনন্দের বৈচিত্র্য আনতে বেড়ে গিয়েছিল অপচয়। ষোড়শ শতকে মীর সৈয়দ আলি দা প্রিন্স অফ দা হাউস অফ তৈমুর শীর্ষক ছবির এঁকে ছিলেন। তাতে দেখা যায়, মুঘল সম্রাট হুমায়ুন পিকনিকে মত্ত আর রাজকর্মচারীগণ ব্যস্ত আয়োজন সামলাতে। যদি আরও পিছন ফিরে তাকানো যায় তাতেও কিন্তু ছবিটা বদল হবে না। খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় শতকে বাৎস্যায়নের কামসূত্রে উদয়ন যাত্রার কথা উল্লেখ রয়েছে, যেখানে ধনীর আনন্দে সাধারণের ভূমিকা শুধু রান্না করে ধনীকে তোষামোদ করা। শৈশবের নস্টালজিক মুড়ি ফিষ্টি গোটা ডিমের ফিষ্টি বা হালফিলের নদী পাড়ে ডিজে গান, সবেতেই আনন্দই প্রধান অ্যাজেন্ডা। শীতকালে নলেন গুড়ের রসগোল্লা আর ফুলকো কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে পৌষের রোদের সেনসেশন পিকনিকের বল্ডনেসকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই পিকনিক ছাড়া শীতকাল পলাশ বিহীন বসন্ত।

কালের নিয়মে ভারতবর্ষে পিকনিকের চরিত্র বদল হয়েছে। কয়েকজন মানুষের পরিবর্তে পিকনিক পেয়েছে ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। গেট টুগেদার হয়েছে সংযত, মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ ভারতের পেরুক্ক উৎসব বা কর্তিকা বনভোজনালুর কথা বলা যেতে পারে। বাংলাতেও সেই ধারা রয়েছে। গ্রামীণ বাংলার লোককথায় মাঠে রান্না পরব হয়। সবাই খড় বিচুলি, হাঁড়ি কড়াই নিয়ে মাঠে রান্না করে, সব সেদ্ধ খাবার। সারাদিন আড্ডা চলে। আস্ত একটা ছুটির মেজাজ। মানুষ তার চেনা জীবনে বৈচিত্র্য আনতে ছন্দ বদল করেছে, গতি পরিবর্তন করেছে। দীর্ঘ দিন সযত্নে অভ্যাস করায় একদিন তা কাস্টম বা প্রথায় পরিণত হয়েছে। সংস্কৃতির অঙ্গে একাকার হয়ে গেছে, যা বাঁচার রসদ সরবরাহ করেছে। পিকনিক শুধু আনন্দ নয়, সংস্কৃতির ধারক বাহক। এদিক থেকে ভারতের পিকনিক বিদেশের থেকে অনেক প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল।

ফরাসি বিপ্লবের পরে চার দেওয়াল ভেঙে মানুষ পার্কে বসত, একসাথে সময় কাটাত। যদিও তাতে দার্শনিকদের প্রভাব ছিল অনেক। সমালোচকরা এটাকেই পিকনিকের সহজপাঠ বলে মনে করেন। তবে খোলা আকাশের নীচে পিকনিকের প্রচলন ব্রিটেনে বিংশ শতাব্দীতে। সেখানে পিকনিক সোসাইটি খোলা হয়। যায় সদর অফিস টটেনহ্যাম স্ট্রিট। সদস্যরা নিয়মিত যাতায়াত করত। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ভাবে দায়িত্ব পালন করত। মজার বিষয়, সেখানে শুধু খানাপিনা নয়, থাকত বিনোদনের সুব্যবস্থা। আজ যেমন চিকেন আর কান ফাটা ডেসিবেল মাইকের ককটেল। তবে আমেরিকার ইতিহাসে পিকনিকে সুন্দর ভাবে শহুরে জীবন গ্রামীণ পিকনিককে গ্রাস করেছে। সাময়িক সুখের হাতছানিতে পিকনিক পেয়েছে সাহিত্যের প্রশ্রয়, সেটা জন হ্যারিসের দা কোর্টসিপ হোক বা জেন অস্টিনের ইমা বা মিশেল ইসাবেলা বিতনের বই। ওয়ার্ডসওয়ার্থও তাঁর বোন ডর্থির প্রকৃতির কোলে ঘুরে বেড়ানো। বিনোদচন্দ শ্রীবাস্তবের হিস্টোরি অফ এগ্রিকালচার ইন ইন্ডিয়া বইতে শুঙ্গ যুগের টেরাকোটাতে পিকনিকের ছবি বর্ণিত হয়েছে। তাই ১৮জুন আন্তর্জাতিক পিকনিক দিবস হিসাবে পালিত হয়।

তবে পিকনিকেও বাদ যায়নি রাজনীতি। যার প্রমাণ মিলেছে ফস্টারের এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া বইতে বা লেডি দাফরিনের লেখায়। ফস্টার লিখেছিলেন, পিকনিকে শয়ে - শয়ে টাকা খরচ করার কথা। লেডি দাফরিনের লেখায়, পিকনিকে ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক অস্ত্র স্বরূপ। ভোটের দিন বা ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলো পিকনিকের পরিবেশে চুরি করে নেয় মানুষের অধিকার। আনন্দের বদলে আসে বন্দি যন্ত্রণা যা গরিব সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। তবু সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষ পিকনিক ভালবাসে। বিভিন্ন আর্থিক সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যেও পিকনিক তাই আজও রয়ে গেছে নিজের ছন্দে, আগামীতেও থাকবে। শীতকাল যেন সেই পিকনিকের নব প্রতিশব্দ।

 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)