প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

ঝড় | টিকে থাকার সাধনা

বাতায়ন /ঝড়/ সম্পাদকীয়/ ৩ য় বর্ষ/ ১ ম সংখ্যা/ ১লা বৈশাখ,   ১৪৩ ২ ঝড় | সম্পাদকীয় টিকে থাকার সাধনা "প্রত্যেক সাহিত্যসেবীর অন্তরে চিরকালীন...

Saturday, February 10, 2024

যে পথ গেছে আমার ভবিষ্যতের পথে | ক্ষিতীন্দ্র নারায়ণ রায়

 

বাতায়ন/অন্য চোখে/১ম বর্ষ/২৯তম সংখ্যা/২৬শে মাঘ, ১৪৩০

অন্য চোখে
ক্ষিতীন্দ্র নারায়ণ রায়

যে পথ গেছে আমার ভবিষ্যতের পথে


জীবন যেন পায়ে চলা এক বিস্তীর্ণ পথ, চলতে চলতে পথ একদিন দীর্ঘতর হয়। পথের উপর দিন শেষের ছায়া এসে পড়ে, সেই ছায়া ক্রমাগত দীর্ঘতর হয়। একসময় ছায়া আসল মানুষটিকেও ছাড়িয়ে যায়। আমার এই সত্তর বছরের স্মৃতি বারবার পিছু টানে। যে স্মৃতিগুলো পেছনে ফেলে এসেছি, বিস্মৃতির ধুলোবালি সরিয়ে, পরম মমতায় তাদেরকে একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়।

প্রত্যন্ত গ্রাম্য পরিবেশে সবুজ গাছপালার ফাঁকে কেটেছে আমার ছেলেবেলা। কাঠবাদাম ফলসা আম জাম লিচু কাঁঠাল বাঁশবন, সরষের ক্ষেতের মৌ মৌ গন্ধ। বাড়ির চারিদিকে নারকেল আর সুপারির সারি। বিরাট গাব গাছের তলে পুকুর। বর্ষার দিনে সোনা ব্যাঙের গ্যাঙরগ্যাঙ শব্দ। স্কুল থেকে ফিরে শনিবার দুটোর পরে খিড়কির পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা। বিকেল হলে ভলিবলের খেলা। সন্ধেবেলায় কম্বল পেতে সেজকাকার কাছে দুই দিদি সহ পড়তে বসা। মাথার উপর লক্ষ তারার আলোয় ভরা আকাশ। রাতের জ্যোৎস্নার আলোয় লুকোচুরি খেলা। সত্যি বলছি একটুকুও ভুলিনি। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আমি সেজন্য মনে কোনদিন দুঃখ ছিল না। আজ বুঝি এই বাড়ি, দাদু বড়বাবা বাবা নকাকা সেজকাকারা আমাকে মূল্যবোধ বিবেক ও ভাবনা শেখাতে পেরেছিলেন। জীবনে কিছু না পাওয়ার যন্ত্রণা, আবার সচ্ছলতাও দেখেছি কখনও মাথা ঘুরে যায়নি। এই গ্রামের বাড়ি আমাকে ভালবাসতে শিখিয়েছে, সবাইকে নিয়ে চলতে শিখিয়েছে।

নরম মনের মানুষ ছিলেন আমার মা। প্রতিবাদী মন অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানো, মা ও বাবার কাছে শিক্ষা। ছোটবেলার কথা ভাবতে গেলে ঘোষ দাদুর কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের বাড়ির গোয়ালা ছিলেন তিনি। কত রকম স্বরে কথা বলতেন আজও মনে পড়লে চমকে উঠতে হয়। দাদুর গলার স্বর নকল করে জ্যাঠামশাইকে ডাকা। দাদুর কাছে গল্প শুনতাম, ঠাকুমাও গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। ছোটবেলার কথা ভাবতে গেলে মনে পড়ে সেজকাকার কাছে পড়া, পড়া না পারলে কঞ্চির মার খাবার ভয়ে পড়া করা। বর্ষার সময় সজনে গাছের মাথায় ভেজা টিয়া, উঠোনের মাঝে জমা জলে কাগজের নৌকা ভাসানো, রান্নাঘর হতে মা কাকিমার হাতে বানানো খিচুড়ির সুবাস। ঠাকুমার কোলে বসে বক রাক্ষসের গল্প শোনা, দুই দিদির আদরে মানুষ হওয়া। সেজকাকার পায়ের শব্দ হলে গলা ছেড়ে পড়া। এই ভাবেই প্রাইমারি হতে জুনিয়ার হাইস্কুলে ক্লাসের পর ক্লাসে ওঠা। একসাথে জ্যাঠামশায় ও ফুলকাকার সাথে এবং দিদিরা সহ স্কুলে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া, সঙ্গে ছয়টি পোষ্য কুকুর আমাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত। জমিতে নকাকার সাথে চাষ দেখতে যাওয়া, কোন জমিতে ধান, পাট,  কলাই, সরিষা ও পেঁয়াজ চাষ হয় সেই মাটির পরীক্ষা।

সেখালিপুর জুনিয়ার হাইস্কুল হতে জঙ্গীপুর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি হওয়া। তারপর বাবার মামার বাড়িতে থেকে জঙ্গীপুর স্কুল ও কলেজে পড়া সব যেন ছবির মতো আমার চোখে এখনও ভাসে। বাবার দু-একটা কথা এখনও মনে আছে, গরিব হয়ে থাকা পাপ, আর চাকরি পাওয়া যত সহজ, সেটাকে রক্ষা করা বড় কঠিন। নিয়মিত ঠিক সময়ে অফিস যাওয়া ও ছুটির অন্তে অফিস থেকে ফিরে বাড়ি আসা, সততার সহিত কাজ করা। জীবনে কোনদিন কষ্ট হবে না।

১৯৭৩ সালে বিএসসি পাশ এবং চুয়াত্তর সালে লুথারান ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে যোগদান। তারপর ১৯৭৭ সালে উক্ত সার্ভিস ছেড়ে ডিভিসিতে যোগদান এবং ২০১৩-তে অবসর গ্রহণ। সব যেন মনের মাঝে ছবির মতো এক এক দৃশ্য। আধুনিক সময়ের প্রবল ঢেউয়ে কত কী হারালাম। ভালবাসার দিনগুলো নীলকণ্ঠ পাখির মতো দূরে সরে গেল। নীল আকাশে রাতের তারা, মায়াময় ভোর সোনালি সকালগুলো যেন কোথায় হারিয়ে গেল। মন তো স্মৃতির সংগ্রহশালা। সেখানে কথা জমে জমে পাহাড় প্রমাণ হয়ে ওঠে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা অনেক সময় মনে করতে পারি না, আবার কত সামান্য সামান্য ঘটনা মনের মণিকোঠায় জমে থাকে। সেগুলো কখনও কখনও মনে আসে, মনে হয় যেন কালকের ঘটনা। লিখতে বসলে কথার ঢেউ আসে, কষ্ট করে কিছু সংগ্রহ করতে হয় না। ভুলতে পারি না আমার প্রাণের বন্ধু সুকুমার হোতাকে, তার অকৃত্রিম ভালবাসা, এখনও মনকে কাঁদায়। অকালে পৃথিবীর পরপারে চলে গেল অল্প বয়সে আমার মণিকোঠার আগল হতে, জীবনে হারালাম এক অকৃত্রিম বন্ধুকে।

আগে কবিতা লিখতাম এখনো লিখি। এই গল্প লেখা আমার অভ্যাস ছিল না। আজকে সাহস করে লিখলাম, কেমন হবে জানি না। ক্লাস নাইনে ভেবেছিলাম বাংলায় অনার্স নিয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমএ পড়ব। কিন্তু ছোটকাকার রক্ত চক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে বলতে সাহস হল না। সায়েন্স নিয়ে পড়তে লাগলাম, পড়েছিলাম বলে অবশ্য ডিভিসিতে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে অফিসার হতে পেরেছিলাম। বর্তমানে বয়স্ক নাগরিক হয়ে বার্ধক্যের পথে পা বাড়িয়েছি।

 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

১৪৩২-এর নতুন সূর্য


Popular Top 10 (Last 7 days)