প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Thursday, April 4, 2024

পূর্বরাগ | আমার মন কেমন করে | চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়

বাতায়ন/পূর্বরাগ/ছোটগল্প/১ম বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/২৩শে চৈত্র, ১৪৩০

পূর্বরাগ | ছোটগল্প

চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার মন কেমন করে


তুমি কখনও বলোনি আমায়—‘ভালবাসি’— কিন্তু অনেক অছিলায় ছুঁয়ে গেছ, মুখের কথায় কোনো প্রশ্রয় ছিল না, কিন্তু স্থির চোখের দৃষ্টি অনেক কিছু বলে যেত।

ভেতরে ভেতরে পাগল ছিলাম আমি। কতবার বলতে গেছি — ভালবাসি। কিন্তু

তোমায়, তা বলতে পারিনি। সেদিন স্যারের কোচিংয়েই বসে, তোমার ফিলজফি বইয়ের সূচির মাথায় লিখেছিলাম— ‘ভালবাসি তোমায়’। লুকিয়ে বইটা তোমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন আর স্যারের পড়া করতে পারিনি। দম বন্ধ হয়ে আসছিল, দু'কানে হাজারো ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনছিলাম। বইয়ের ব্যাগ বুকে চেপে ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম কোচিং থেকে।

তারপর সাতদিন কেটে গেছে, যেতে পারিনি কোচিং, জানি না কেন। ভয়, লজ্জা, নাকি-নাকি— কী জানি, কী!

সেদিন খাতা খুলে লিখতে গিয়ে অনেক আঁকিবুঁকি কাটছিলাম, ভাবলেশহীন ভাবনারা পেনের মাথায় বসে খাতায় আঁক কষছিল তোমার নাম, বার বার। আমার রিভলভিং চেয়ারটা হঠাৎ ঘুরে গেল, দেখি সামনে তুমি। ধড়াস করে উঠল বুক, নিশ্বাস সব বন্ধ হয়ে গেল, শারীরিক উষ্ণতা অনুভব করলাম প্রতিটা রোমকূপে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, ভালবাস আমায়?

মনের উত্তর চোখের জলের ধারায় বেরিয়ে এসেছিল।

আমার চুলগুলো আলতো করে ঘেঁটে দিয়ে বলেছিলে— পাগলি একটা, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। এই এক কথাতেই যেন আমার সবকিছু পাওয়া হয়ে গেল, সে জেনেছে আমি ভালবাসি, সার্থক তাতেই আমি। আমায় ভালবাসে কিনা, এমন একটা যে প্রশ্ন আছে, আমার কাছে সেদিন ধরা দেয়নি।

বেশ কয়েকদিন পর, কলেজের অফ পিরিয়ডে তোমাকে দেখলাম মন্টুদার চায়ের দোকানে। এক কোণে চুপ করে বসে আছ। মুখটা আষাঢ়ের মেঘের মতো কালো, আমি কারণ জানতে চাইলে, তুমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলে, বলেছিলে আমাদের ক্লাসের বৈশাখী তোমার ভালবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আমিও কেঁদেছিলাম খুব।

না— আমাকে ভালবাসোনি বলে কাঁদিনি, তুমি কাউকে না পেয়ে কষ্ট পেয়েছ, সেটা আমি অনুভব করেছিলাম আমার মন দিয়ে। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম বৈশাখীকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনবই। তখন আমি বুঝিনি আমার ভালবাসাটা কোথায়?

আমি কথা রাখতে পারিনি, বৈশাখী যে রুদ্রকে ভালবাসত, তোমাকে না। আমরা দুজনে একসাথে সে শোক পালন করেছিলাম। তখনও আমার মনে এ প্রশ্ন জাগেনি, ভালবাস আমায়? আমি যে নিজেই ভালবেসে নিজেই পূর্ণ। গ্রহণের থেকে, নিজেকে উজাড় করে দেওয়াতেই মশগুল। কিশোরী মনে ভালবাসার প্রাপ্তি কী, সেটা অধরাই থেকে গেছে। দুজন দুজনের পথে হেঁটে গেছি।

মাঝখানে আরও বছরখানেক গড়িয়ে গেছে, ফাইনাল পরীক্ষা প্রায় কাছাকাছি, একটা বইয়ের প্রয়োজনে তোমার বাড়ি গিয়েছিলাম। দিনটা ছিল কালীপুজোর আগের দিন, চোদ্দো প্রদীপের দিন, সব বাড়ির প্রত্যেক ঘর, তুলসীতলায় জ্বলছে একটা করে প্রদীপ। ধোঁয়া ধোঁয়া আলো চারিদিকে, সোজা দোতলায় তোমার ঘরে চলে গিয়েছিলাম। ব্যালকনিতে তোমাকে আর মুনিয়াকে খুব অন্তরঙ্গ ভাবে দেখে ফেলে, লজ্জায় নীচে নেমে এসেছিলাম। নেমে এসেছিলাম তোমাদের দেখে ফেলার অপরাধ বোধের লজ্জায়। বাড়ি ফিরে এসেছিলাম কী এক ভীষণ কষ্টে।

দোষ তোমার না, দোষ তো আমারই ছিল, না বলে গিয়েছিলাম যে আমি। তাহলে কষ্টটা আমাকে পেত না।

তারপর বেশ কয়েক মাস কেটে গেল, জীবন বয়ে গেল গতানুগতিকতায়। সে দিনটা ছিল শীতের শেষের সকাল চোখ বন্ধ করে পড়া মুখস্থ করছিলাম, কদিন পর থেকেই শুরু হচ্ছে পরীক্ষা। তুমি ঝড়ের মতো এলে, ভেঙে পড়লে কান্নায়, বললে— মুনিয়াকে নিয়ে তার বাবা-মা দেশে মানে বিহার চলে যাচ্ছে। মুনিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। খুব কষ্ট হল শুনে, তোমার সাথেই কেন এমন হয় বার বার?

সেদিনও আমি কেঁদেছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল তোমার জন্য। তোমার কষ্টগুলো কখন যেন আমার হয়ে গিয়েছিল বুঝিনি, আমার ছোট্ট বুকে এত কষ্ট ধরে রাখতে পারিনি। বার বার আশ্বাস দিয়েছিলাম তোমাকে, যে আমি মুনিয়া হলে এমনটা কখনওই করতাম না, কিন্তু নিজের জায়গাটা বরাবরের জন্য ফাঁকা ছিল সেটা তো দেখাই হয়নি।

তোমার কষ্টগুলো আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে দিয়েছিল, নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল আমার সত্তা। কী এক অবোধ কষ্টে কখন যেন লুটিয়ে পড়েছিলাম মাটিতে।

আজ প্রায় এগারো বছর পর বাড়ি ফিরলাম মেন্টাল অ্যাসাইলাম থেকে। বাবার অনেক বয়স হয়ে গেছে। মা-কেই দেখে এসেছি অ্যাসাইলামে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। বাবাকে অনেকদিন পর দেখলাম, ভাই হলদিয়া থাকে সস্ত্রীক। আমরা সেই বাড়িতে আর থাকি না, নতুন সাজানো ফ্ল্যাট। মা আমাকে নিয়ে গেল আমার ঘরে, সুন্দর করে সাজিয়েছে মা ঘরটা, ফ্লাওয়ার ভাসে আমার প্রিয় হলুদ গোলাপ, আর আমার খাটের এক পাশে আমার প্রিয় হারমোনিয়ামটা রাখা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম হারমোনিয়ামটার কাছে। হারমোনিয়ামের ঢাকনাটা খুলে, ভিতর থেকে বার করলাম তোমার হাতে লেখা ডায়েরির ছেঁড়া পাতার কিছু টুকরো। পোকায় খাওয়া। এরা সব আমার মনের সঙ্গী। পুরোনো অনেক স্মৃতি মন থেকে মুছে গেছে, কিন্তু এটা আজও ভুলিনি। মা বলল, এবার এগুলো পুড়িয়ে ফেল।

বাবার ঘর থেকে রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছিল— "আমার মন কেমন করে, কে জানে কে জানে, কে জানে কাহার তরে"

 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)