বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/১১তম/৩২শে শ্রাবণ, ১৪৩১
ধারাবাহিক গল্প
পারমিতা দে দাস
শিল্পীর আত্মপ্রকাশ
[৩য় পর্ব]
"গান শেষ করতেই দেখি অনিকেত পাশে এসে বসল আমার। ওর চোখে জল। আমার হাতে হাত রেখে বলল, 'আমাকে শুধরে নাও এ জন্ম আত্মসমর্পণ করেছি তোমার কাছে। তুমিই তো কলম তুমিই শক্তি। আমাকে ছেড়ে যেও না এভাবে...'"
পূর্বানুবৃত্তি আমি শান্ত।
মোমের মতোই নরম। ভালবাসা পেলে লতানো গাছের মতোই আঁকড়ে ধরি কিন্তু তার মানে এই নয়
আমার কোনো প্রতিবাদের ভাষা থাকবে না! অন্য ধর্মের মানুষ হলেও চাচা কখনোই আমাদের
ধর্মকে অসম্মান করে না। বরং বাড়িতে লক্ষ্মী পুজো হলে আমি আর চাচাই এতদিন নারকেল
নাড়ু, তিলের নাড়ু, ভোগ রান্না করেছি। চাচার বাড়িতে ইদের দিন আমাকে আর অনিমিখকে
নিয়ে যেত গোটাদিন চাচা-চাচি ও তাদের দুই মেয়ের সাথে হই হই করে কাটত। ঘরে এক চাপা
নিস্তব্ধতা। আমি জানতাম অনিকেত আবার ক্ষমা চাইবে। আমার চিঠির উত্তর দিতে চাইবে।
আমি চাই না ও আর কিছু বলুক। আমি কিছুই শুনব না আর। তারপর…
অনিকেত আমার কাছে এসে আমার হাতটা ধরে বলল, 'রাই আমি জানি আমি
তোমার প্রতি অনিমিখের প্রতি কোনো কর্তব্য করতে পারি না একজন স্বামী হিসেবে একজন
বাবা হিসেবে যা যা আমার করা উচিত। তোমার বাবা ঠিকই বলত, তুমি হয়তো অন্য কাউকে
বিয়ে করলে অনেক বেশি সুখী হতে। আমার এই উদাসীন জীবন, নিষ্ঠুর আত্মমগ্নতার জন্য
আমি জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি। আর প্রতিটা হারানো টুকরোগুলো জমা করি
আমার বইয়ের প্রতিটা পাতায়।
তবে আমি তোমাকে আর অনিকে নির্ভর করেই বেঁচে আছি। আমি
তোমার থেকে দূরে থাকলেও তোমাকে আমার ভেতরে নিয়ে বাঁচি। অক্ষরবিন্যাসে বাঁচি। আমার
মতো এক বাউন্ডুলে লেখককে বিয়ে করে তুমি তোমার জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নকে
ত্যাগ করেছ। তার বিনিময়ে আমি কিছুই দিতে পারিনি। তবে একটা কথা খুব সত্যি জানো রাই
পাখি যেমন দিন শেষে নীড়ে ফেরে আমার ঠিকানা কিন্তু তুমিই ছিলে এখনো ঠিক তাই আছ।
আমি তোমায় নিয়ে যেতে আসিনি। ক্ষমা চেয়ে আবার ভুল করবো আমি জানি। কোথাও কোনো
স্ক্রিপ্ট নিয়ে লিখতে বসলে আমি জানি আবার আমি সব কিছু ভুলে যাবো। এমনকি নিজেকেও।
তবে আমি চাই তুমি তোমার মতো করে অনিমিখকে তৈরি করো। দেখো ও যেন আমার মতো বাউন্ডুলে
লেখক না হয়। আমি কাল ভোরেই ট্রেন ধরে নেবো। তুমি ডিভোর্স চেয়েছ আমি দিয়ে দেবো।
তবে তুমি ওই বাড়িতে থেকে যাও ওখানে অনির স্কুল পড়াশোনা সব কিছু। ওই বাড়িটা তো
আমার নামেই কেনা। তুমিই তো সব গুছিয়ে রাখো। পুকুর বাগান গাছপালা সবই তো তুমিই
দেখাশোনা করেছ। নিজের হাতে বাড়িটা সাজিয়ে রেখেছিলে। আমি এত দিন খেয়ালও করিনি
দুদিন পর পর আমার বাবার ছবিতে রজনিগন্ধার মালাটাও তুমি পরিবর্তন করো। এসে দেখি
মালাটা শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে। অথচ আগে যখনই বাবার ছবির সামনে দাঁড়াতাম রজনিগন্ধার
মিষ্টি সুবাসে ভরে থাকত ঘরটা। কতবার ওই ছবিটা দেখতে দেখতে বাবাকে নিয়ে কত লেখা
লিখতাম। সেদিন বুঝতে পারলাম কোনোকিছুই জীবন্ত থাকে না জীবন্ত রাখতে জানতে হয়।
তোমাকে বিয়ে করে প্রথম যেদিন বাড়ি নিয়ে যাই, চাচা বলেছিল
সেদিন বাড়িতে লক্ষ্মী এসেছে। দেবী না থাকলে মন্দিরের আর কী মূল্য থাকে বলো! এখানে
আসার সময় চাচা বলেছিল, 'আমি যাতে তোমাকে নিয়ে যাই। আমি তোমার প্রতি দিনের পর দিন
যে অবহেলা করেছি এসব বলার মতো মুখ নেই জানি তবুও বলছি তুমি পারলে ওখানেই থাকো। আমি
চলে যাবো ঝাড়গ্রামের বাড়িতে। তুমি ওখানে থেকেই নিজের জীবনটা নতুন করে গুছিয়ে
নিতে পারো কথা দিচ্ছি স্বামীর অধিকার দেখাতে আসব না। আমি কখনো চাইনি রাই তুমি শুধু
আমার ঘরবাড়ি দেখাশোনা করো। আমাদের সন্তানের জন্য নিজেকে তোমার সাধনা থেকে দূরে
সরিয়ে রাখো। এটাও সত্যি আমি সংসারে সময় দিতে পারি না। শুধু সংসার নয় আমি
নিজেকেও সময় দিতে পারি না। আমার কোনটা প্রয়োজন কোনটা নয় তা নিজেই জানি না। তুমি
শান্তিনিকেতন যাওয়ার আগে প্রেসারের ওষুধগুলো যেভাবে গুছিয়ে দিয়েছিলে ব্যাগে
সেভাবেই পড়ে আছে। তুমি যে কটা দিন মনে করিয়েছিলে খেয়েছিলাম তারপর আর খাইনি।
এমনই আত্মভোলা উদাসীন মানুষ আমি। এখন বুঝতে পারছি বিখ্যাত লেখক হওয়া সহজ কিন্তু
বিখ্যাত মানুষ হওয়া ততটা সহজ ব্যাপার নয়। আমি পুরোপুরি ব্যর্থ একজন মানুষ রাই। এ
কথা বলতে কোনো লজ্জা নেই আমার। আর কথা দেবো না তোমায় কথা দিয়ে যদি না রাখতে
পারি।
অনিকেত কথা শেষ করেই তাকিয়ে রইলো জানলার বাইরে। আকাশে চাঁদ
উঠেছে। চারপাশে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আমরা দুজনেই কথা বললাম না
দীর্ঘক্ষণ। আমার বুকের ভেতর যে ঘূর্ণিঝড়ের সংকেতটা ছিল তা কেটে গেল। কী বলবো, কী
বলবো না, বুঝে উঠতে পারলাম না। বাপ-মা-হারা অনিকেতকে বড় অসহায় লাগছে আজ। মুখ
চোখে দুর্বিপাকের ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। ওকে আগে কখনো এভাবে দেখিনি। চশমার কাচের
ভেতর ওর চোখটা ঘোলাটে লাগছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কুণ্ডলী পাকানো
ধোঁয়া ছাড়ছে। সেই ধোঁয়ার ভেতর উড়ে যাচ্ছে জীবনের সমস্ত অনুতাপ।
অনিমিখ অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওর মুখের আদলটা একদম অনিকেতের মতো। আমি
ওর দিকে একবার তাকালাম আর একবার অনিকেতের দিকে। আমি এই মুহূর্তে এটুকু বুঝতে পারছি
আমি এই দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। কতদূরই বা যেতে পেরেছি আমি! যে সংসার সাজিয়েছি
নিজের হাতে যে ভালবাসার আঁচল বিছিয়ে রেখেছি সেখানে অভাব এসে জড়ো হলে সেই আঁচলেও
টান পড়ে। মনে মনে একটা কথাই বললাম, এই অভাবকে দীর্ঘ কোরো না। লেখার টেবিল ছেড়ে
কখনো কখনো আমার আর অনিমিখের হাত ধরে খোলা আকাশের নীচে বসো।
আমি হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসলাম। নিঝুম রাতের আলো-আঁধারি খেলার
ভেতর গান ধরলাম
“দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে—
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।।”
গান শেষ করতেই দেখি অনিকেত পাশে এসে বসল আমার। ওর চোখে জল।
আমার হাতে হাত রেখে বলল, 'আমাকে শুধরে নাও এ জন্ম আত্মসমর্পণ করেছি তোমার কাছে। তুমিই
তো কলম তুমিই শক্তি। আমাকে ছেড়ে যেও না এভাবে...'
আমি নিরুত্তর রইলাম ফুঁপিয়ে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়লাম অনিকেতের
বুকে। কতদিন পরে কাছে পেলাম অনিকেতকে। ওর শরীরের পুরনো গন্ধ পেলাম। এক হাত দিয়ে
নিভিয়ে দিলাম হ্যারিকেনের নিস্তেজ আলোটা। তার সাথে নিভিয়ে দিলাম সব অনুযোগ
অভিযোগ।
সব ছেড়ে গিয়েও আর যাওয়া হলো না কোথাও…
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment