বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ছোটগল্প/২য়
বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১
শারদ | ছোটগল্প
নীলাঞ্জনা মল্লিক
অভ্যেস
"সেদিনও খুব মিষ্টি সুরে কোকিল ডাকছিল। ব্রেকফাস্ট করতে করতে ঠোঁট থেকে আপনাআপনিই খসে পড়ে গেল ব্রাউন ব্রেডের টুকরো। চেয়ার উল্টিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন বন্দনা। ওমা! মা কী হল তোমার? পড়ে গেলে কী করে? মাথা ঘুরে গেল নাকি? চোখের সামনে তখন শুধুই ঝাপসা মেয়ে, জামাই, নাতি... সকলেই খুব অস্পষ্ট।"
২১/এ, সূর্য সেন সরণি... একতলা ছিমছাম বাড়ি। বাইরের হলদে রংটার ওপর দীর্ঘ সময়ের
পরত পড়েছে অনেকদিনই। সামনের বারান্দার চটা গ্রিল দেখে বোঝা যায়- ওটা কোনও এককালে
মেরুন রঙের ছিল। তিন কামরার এই একতলা বাড়িজুড়েই বাহান্ন বছরের সুখ-দুঃখের পসরা।
অবসরপ্রাপ্ত রাশভারী শিক্ষক উমেশবাবু। কালো ফ্রেমের মোটা
কাচের চশমার ভেতর চোখদুটো খুব ছোট ছোট দেখায়। দেওয়ালে টাঙানো পাতলা ঠোঁট লম্বা নাক ফর্সা মেয়ে বুবলির
বিয়ের ছবি দেখে সবাই একবাক্যে বলে ওঠে- "এ তো পুরো বাপের মুখ বসানো গো।"
পাশাপাশি দুটো কাচের বয়ামের একটাতে থিন অ্যারারুট বিস্কুট, আরেকটায় কালোজিরে দেওয়া নোনতা। উমেশের
স্ত্রী বন্দনা ফুটন্ত চায়ে আদা ছেঁচে রস ছড়াতে ছড়াতে সামনের
বাড়ির টুকুটুকির ভৈরবী রাগের দিকে কান পাতেন। দু'জায়গায় গলা
মেলে না। ইশ! মেয়েটাকে একটু শুধরে দেওয়ার কেউ নেই?
রান্নাঘরের জানলার একটা চৌকো আকারের কাচ ভেঙে খান খান হয়ে গেছে কয়েকমাস আগে। গতবার
ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত নাতিবাবু এসে মাপে মাপে একটা পিচবোর্ড কেটে আঠা দিয়ে জোড়াতালি
দিয়ে গ্যাছে কোনোভাবে।
- ঝন্টুমিস্ত্রির মোবাইলটা বন্ধ। বাজার থেকে
ফেরার পথে ওর বাড়িতে একবার হাঁক দিয়ে এসো। কবে থেকে জানলাটার ওই অবস্থা হয়ে আছে
বলো তো?
খবরের কাগজে মুখ গোঁজা উমেশ শেষ ঢোকটুকু গিলে, চায়ের কাপটা পাশের টেবলে 'ঠক' শব্দে রেখে সম্মতিসূচক নীরব সাড়া দেন। বারান্দার এককোণে শুকোতে দেওয়া মাছের ব্যাগটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন
- কী মাছ আনব?
খবরের কাগজে মুখ গোঁজা উমেশ শেষ ঢোকটুকু গিলে, চায়ের কাপটা পাশের টেবলে 'ঠক' শব্দে রেখে সম্মতিসূচক নীরব সাড়া দেন। বারান্দার এককোণে শুকোতে দেওয়া মাছের ব্যাগটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন
পাশের মাঠে ফুটবলের হই-হই'য়ের সঙ্গে কাঁচালঙ্কা দেওয়া সর্ষের ঝালের
গন্ধ মিশে যায়। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই উমেশের চারজন ছাত্র আসে। ক্যালকুলাস পড়তে।
উমেশ ওই দুটি ঘন্টায় তিন কাপ চা শেষ করেন। ঠিক এইভাবেই, প্রাত্যহিকের
রুটিন এগিয়ে চলে সময়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। একটা দিনও নড়নচড়ন হয় না।
হঠাৎ যেদিন ছন্দপতন ঘটল, সেদিন সকাল থেকে নরম সুরে কোকিল ডাকছিল খুব। বারান্দায়
ইজিচেয়ারে বসে থাকা উমেশের হাত থেকে চায়ের কাপ ফসকে পড়ে চুরমার। গরম চা মেঝেয় পড়ে
গড়াতে গড়াতে ঘরের চৌকাঠে বাধা পেয়ে আবার দিক পরবর্তন করছে ধীরগতিতে। খাটো ঝুলের
নাইটি আর পাজামা পরা মিনতি ঘর মুছতে মুছতে হঠাৎ চোখ তুলে থ!
- অ মাসিইইইই! মাসি শিগগির এসো গোওওওও!
চেয়ারে ঘাড় হেলানো উমেশের মুখাবয়ব জুড়ে তখনও একইরকম
নির্লিপ্তি। সেদিনই প্রথম ভারী চশমা ছাড়া উমেশের স্থির চোখদুটো দেখতে পেয়েছিল
পাড়াপড়শি আর ছাত্ররা।
রজনিগন্ধার গন্ধ বরাবরই উগ্র লাগে বন্দনার। তার ওপর এত এত ফুলমালা... রোজই
সবাই হাতে করে নিয়ে আসছে।
- ও বুবলি! রজনিগন্ধাগুলো
সরিয়ে দে। এত লোকজন গিজগিজ করছে কেন বল তো? আমার এত ভিড় ভাল
লাগে না। সবাইকে চলে যেতে বল।
- এরকম করতে নেই মা, জানি তোমার মাথার ঠিক নেই। একটু কান্নাকাটি করো না মা! প্লিজ একটু কাঁদো! কাঁদলে হালকা হতে পারবে।
- সব লোকজনকে বল চলে যেতে। কারোর থাকবার দরকার নেই।
- বাবার কাজ হয়ে গেলেই সবাই চলে যাবে মা। তুমি শান্ত হও। তোমাকেও আমি নিয়ে চলে যাব, আমার কাছে।
বন্দনা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। সুতির শাড়ির ওলটপালট কুঁচি। নাতিবাবু তাঁর হাতটা ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে গেল ছাইরঙা শেভরলের দিকে।
- বুবলি, আমাকে নিয়ে চলে যাচ্ছিস? আমার গোপালের কী হবে? কে খেতে দেবে?
- কিচ্ছু চিন্তা কোরো না মা, তোমার গোপালকেও আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে আমার ঠাকুরের সঙ্গে থাকবে।
বুবলির ঝকঝকে কাচঘেরা সিংহাসনে গোপাল ভাল নেই মোটেও। কেমন
প্যাটপ্যাট করে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে চায় যেন!
- মা, সাতটা বাজল তো! তোমার সিরিয়াল? দেখবে না? কিছু তো বলো!
- আমার সব অভ্যেসগুলো তো ওই বাড়িতেই পড়ে আছে রে! আমাকে ওখানে নিয়ে চল।
***
- এরকম করতে নেই মা, জানি তোমার মাথার ঠিক নেই। একটু কান্নাকাটি করো না মা! প্লিজ একটু কাঁদো! কাঁদলে হালকা হতে পারবে।
- সব লোকজনকে বল চলে যেতে। কারোর থাকবার দরকার নেই।
- বাবার কাজ হয়ে গেলেই সবাই চলে যাবে মা। তুমি শান্ত হও। তোমাকেও আমি নিয়ে চলে যাব, আমার কাছে।
বন্দনা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। সুতির শাড়ির ওলটপালট কুঁচি। নাতিবাবু তাঁর হাতটা ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে গেল ছাইরঙা শেভরলের দিকে।
- বুবলি, আমাকে নিয়ে চলে যাচ্ছিস? আমার গোপালের কী হবে? কে খেতে দেবে?
- কিচ্ছু চিন্তা কোরো না মা, তোমার গোপালকেও আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে আমার ঠাকুরের সঙ্গে থাকবে।
***
- মা, সাতটা বাজল তো! তোমার সিরিয়াল? দেখবে না? কিছু তো বলো!
- আমার সব অভ্যেসগুলো তো ওই বাড়িতেই পড়ে আছে রে! আমাকে ওখানে নিয়ে চল।
সেদিনও খুব মিষ্টি সুরে কোকিল ডাকছিল। ব্রেকফাস্ট করতে করতে
ঠোঁট থেকে আপনাআপনিই খসে পড়ে গেল ব্রাউন ব্রেডের টুকরো। চেয়ার উল্টিয়ে মাটিতে
লুটিয়ে পড়লেন বন্দনা।
- ওমা! মা কী হল তোমার? পড়ে গেলে কী করে? মাথা ঘুরে গেল নাকি?
চোখের সামনে তখন শুধুই ঝাপসা মেয়ে, জামাই, নাতি... সকলেই খুব অস্পষ্ট। স্পষ্ট কেবল কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ফতুয়া গায়ে উমেশ। মাছের ব্যাগটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন,
- কী মাছ আনব আজ?
- জ্যান্ত ট্যাংরা পেলে এনো। আর হ্যাঁ, ঝন্টুমিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আসতে ভুলো না। রান্নাঘরের জানলাটা সারাতে হবে।
- কিছু বলছ তুমি? কী বলছ মা? বুঝতে পারছি না তো। অনিমেষ শুনছ? মায়ের কেমন কথা জড়িয়ে যাচ্ছে! আমি ভাল বুঝছি না! ডক্টরকে কল করো শিগগির!
২১/এ, সূর্য সেন সরণি... তালাবন্ধ একতলা বাড়িটার সামনে দুটো নয়নতারা ফুলের গাছ
গজিয়েছে। হাওয়া দিলে ফির ফির করে দোলে, বাহান্ন বছরের
অভ্যেসগুলোকে পাহারা দেয়।
- ওমা! মা কী হল তোমার? পড়ে গেলে কী করে? মাথা ঘুরে গেল নাকি?
চোখের সামনে তখন শুধুই ঝাপসা মেয়ে, জামাই, নাতি... সকলেই খুব অস্পষ্ট। স্পষ্ট কেবল কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ফতুয়া গায়ে উমেশ। মাছের ব্যাগটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন,
- জ্যান্ত ট্যাংরা পেলে এনো। আর হ্যাঁ, ঝন্টুমিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আসতে ভুলো না। রান্নাঘরের জানলাটা সারাতে হবে।
- কিছু বলছ তুমি? কী বলছ মা? বুঝতে পারছি না তো। অনিমেষ শুনছ? মায়ের কেমন কথা জড়িয়ে যাচ্ছে! আমি ভাল বুঝছি না! ডক্টরকে কল করো শিগগির!
***
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment