বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য়
বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১
শারদ | ধারাবাহিক গল্প
সাগরিকা রায়
যে ফিরে আসে
[১ম পর্ব]
"ছেলেকে দোকান গুছিয়ে দিয়ে দুদিন পরে বেরিয়ে গেল নৃপেন। তখন আকাশে সোঁদা গন্ধ নিয়ে মেঘের দল ছুটে যাচ্ছে বীরভূমের দিকে। বিডিও অফিসের পাশের কদম গাছ থেকে জমে থাকা জলের সঙ্গে কদমের সুবাস নেমে আসছে। ভারি সুন্দর এই জীবন। নৃপেন গান ধরেছে, ও দরদী, কী মাছ ধরিছ বঁড়শি দিয়া…।"
বিধান
মার্কেট থেকে এক বস্তা চাউমিন কিনেছে নৃপেন গোঁসাই। এদিকে মেঘ করেছে ঈশান কোনে।
রাধাবাবু হেঁকে বললেন, “দেখ নিপেন, দেরি কোরো না।
এবারে গাড়ি ধরো। রাস্তায় বৃষ্টি পাবে মনে হচ্ছে।”
নৃপেন
গোঁসাইয়ের আরও কিছু কেনাকাটার ছিল। টমেটো সস, ম্যাগি, কুচো নিমকি,
সস্তার সিটিসি চা পাতা, লুজ গুঁড়ো দুধ, একটাকা দামের শ্যাম্পুর পাউচ, গুঁড়ো সাবান,
গায়ে মাখার সাবান, টিপের পাতা, চকলেট, চিপসের প্যাকেট, বিস্কুট... চাহিদা অনুযায়ী মাল
না নিলে লস। এখন আগের মতো দিন নেই। দশ বছর আগেও দুটো দোকান
ছিল যেখানে, এখন সেখানে নাহক পাঁচটা দোকান গজিয়ে উঠেছে। ছেলে অঙ্কুশ বড় হয়েছে।
দোকানদারি ভালই করে। কিন্তু মাঝে মাঝে ঘ্যানঘ্যান করে ওর
মায়ের কাছে, “মাল নেই দোকানে। কাস্টমার এসে মাল না পেয়ে চলে যায় ক্যাংলার দোকানে।
সে চালাক লোক। দোকানে মাল রাখে। কিন্তু দামটা বেশি রাখে বলে লোকে যায় কম। কিন্তু
আমি মাল দিতে না পারলে ওর দোকানেই যাবে লোকে।” দাওয়ায় বসে
বিড়ি খেতে খেতে সেসব দুঃখের কথা শুনতে পায় নৃপেন। টাকা কোথায়? অল্প ধানি জমি
রয়েছে। বীজধান কিনতে গিয়েছিল চটের হাটের সুবলের কাছে। তার কাছেই যা একটু দুঃখের
কথা বলা যায়। সে বীজধানের খালি বস্তা ঝেড়ে গুছিয়ে রাখতে রাখতে হিসেব কষলো, “কিছু
ট্যাকা দিতে পারি। সুদ সমেত দিতে পারবে?”
এক কথায়
রাজি হয়ে গেল নৃপেন, “পারব গো। দাও ট্যাকা। সুদের ওপর পঞ্চাশ পয়সা বেশি দেব।”
লেখাপড়া
নেই, কথায় কথা হয়ে রইল। তিনটি হাজার টাকা নিয়ে বিধান মার্কেটে গিয়ে বাজার করছে
নৃপেন গোঁসাই। একসময় গুরুগিরি করেছে। চারঘর যজমান ছিল। লকডাউনের পরে দেখা গেল
তাদের দুজন মরেছে। বাকি যারা বেঁচেছে, তারা গুরু রাখি না প্রাণ রাখি সে নিয়ে
বিব্রত। ছেলের হাতে দোকান গুছিয়ে দিয়ে ফের বেরিয়ে পড়বে আখড়ায় আখড়ায়। একতারা নামাতে
হবে উঁচু থেকে। দু-পাঁচজায়গায় গান গেয়ে প্রাণ শান্ত করে ফের
ঘরে ফেরা। নৃপেন চিপসের প্যাকেট গুনে নিতে নিতে উদাসের গন্ধ পায়।
শ্যাম্পুর
পাউচ নিল নৃপেন। মোট পঁচিশটা। মানে পঁচিশ ট্যাকা। “তাইলে এখন থাকে শুধু টিপের পাতা
খান দশেকের মতো। গ্রামের মেয়েছেলেরা আসে নিতে। এখন গুঁড়ো
সিঁন্দুর পরার চল উঠে গেছে। নকল টিপ ভাল, ধেবড়ে যায় না।” রাধাবাবুকে টাকা গুনে
দিতে দিতে মনের কথা বলে নৃপেন। মনটা খুশি খুশি। মালপত্র মোটামুটি হয়েছে। এখন রওনা
দিতে হবে। কোর্ট মোড়ে গিয়ে গাড়ি ধরে...!
দার্জিলিং
মোড় পার হতেই নামল বৃষ্টি। রাঙাপানিতে গিয়ে সে বৃষ্টি খানিক থামল, পরে চটের হাটে
এসে ফের শুরু হল। সঙ্গে হাওয়া। নৃপেন ভাবল অঙ্কুশের কাছে ফোন আছে। একবার জানাতে
পারলে ভাল হতো। সে মাধবের রিকশাটা নিয়ে এসে মালগুলি নিয়ে যেত। এত টাকার মাল, ভিজে
নষ্ট হবে? কত টাকার জিনিস বল দেখি?
গোয়ালটুলির
মোড়ে পৌঁছে নামতে হল। এবারে হাঁটা পথ। নেমেই দেখে একটা নীল প্ল্যাস্টিকের শিট নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে অঙ্কুশ। ব্যস। বাপ বেটায় ভাগাভাগি করে মাল পিঠে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল, দু হাতে শিটের দুটি করে কোন ধরে মাথা আর মাল ঢেকে
রাখার চেষ্টা করতে করতে বাড়ি পৌঁছে গেল। দোকানের মাল বুঝিয়ে দিয়ে শুকনো কাপড় পরে
দাওয়ায় বসে বহুদিন পরে গান ধরল নৃপেন গোঁসাই। আজ মার্কেটে দেখা হল কার্তিকের
সঙ্গে। তারা যাচ্ছে বীরভূমে। বাউলয়ের আখড়ায় কটাদিন কি কাটাতে
চায় নৃপেন?
চায় বৈকি। ছেলেকে
দোকান গুছিয়ে দিয়ে দুদিন পরে বেরিয়ে গেল নৃপেন। তখন আকাশে সোঁদা গন্ধ নিয়ে মেঘের দল
ছুটে যাচ্ছে বীরভূমের দিকে। বিডিও অফিসের পাশের কদম গাছ থেকে জমে থাকা জলের সঙ্গে কদমের
সুবাস নেমে আসছে। ভারি সুন্দর এই জীবন। নৃপেন গান ধরেছে, “ও দরদী, কী মাছ ধরিছ বঁড়শি
দিয়া…।”
অঙ্কুশ বাপকে
শিলিগুড়িতে পৌঁছে দিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়েছে। কার্তিকের সঙ্গে এনজেপিতে গিয়ে গাড়িতে উঠেও
পড়েছে নৃপেন। তখন মধ্যরাত। অঙ্কুশের মা ঘুমোতে পারল না আজ। লোকটা বাড়িতে থাকতে চায়
না। বড় উড়ো মন। কিন্তু, আজ লোকটার জন্য মন টানছে খুব।
ভোরে খবর ছড়িয়ে
পড়ল। যে ট্রেনে উঠেছে নৃপেন, সে গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে রাঙাপানির পরেই। খবরটা পেয়ে অঙ্কুশ ছুটে গিয়ে যখন পৌঁছেছে, তখন দলা পাকিয়ে যাওয়া লাশগুলো
বের করার চেষ্টা চলছে। মারাত্মক দুর্ঘটনা হয়েছে। একটি বগি অন্য বগির ওপরে উঠে গিয়েছে।
নৃপেন কোন বগিতে ছিল, ছেলে জানে না। তবু পাগলের মতো ছুটেছে এদিক থেকে ওদিকে। এই গাড়িতেই
যাওয়ার কথা ছিল। টিকিট হাতে নিয়ে দেখেনি অঙ্কুশ। কিন্তু কার্তিককাকার মুখে শুনেছে এই
গাড়িতে যাবেন তাঁরা।
নৃপেনের বডি
পাওয়া গেল না। একটা দুমড়ে যাওয়া হাত-পা-বিহীন বডির পাশে একতারাটা কী করে অক্ষত থেকে
গেল ভেবে আশ্চর্য হওয়ার সময় পায়নি অঙ্কুশ। নৃপেনের বডি বাড়িতে নিয়ে গেল ছেলে। রাতের
অন্ধকারে কোনাখুলির মাঠে ঢিবি করে কিছু বেওয়ারিশ লাশ, কিছু বডিপার্টস জ্বালিয়ে দিল
কর্পোরেশন থেকে।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment