বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য়
বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১
শারদ | ধারাবাহিক গল্প
শাশ্বত বোস
মৃণাল ও একটি অনবহিত সিনে সংবাদ
[১ম পর্ব]
"এই এত বছরে শিয়ালদা ব্রিজের উপর দিয়ে চলা, টিং টিং ঘন্টির ট্রামগাড়িটা চলে গেছে কয়েক লক্ষ বার। ট্রামের ভেতর বসে থাকা মুখটা জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে বাজারটাকে দেখেছে কয়েক অর্বুদ মাইক্রো সেকেন্ড ধরে, ধুলোকাদা জড়ানো একটা হাওয়াকে বুকে আঁকড়ে। রামনিধি আজ রাঁধুনি থেকে হোটেলের কত্তা হয়েছে।"
অঙ্কন- শাশ্বত বোস
খুব ভোরের
জেদি একগুয়েঁ ধোঁয়া আর ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্স পুঁটুলি থেকে ভেসে আসা
ভ্যাপসা গন্ধের মিশেলে, ভিজে যাওয়া সংস্কৃতিশূন্য সকালটার একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। গরম ভাতের
ফ্যান, ডাস্টবিনে
ফুলে ওঠা মাছ কিংবা সারা রাত জেগে বাজারটার এক কোণায় পড়ে থাকা মুটে মজুরের গায়ের তেতো ঘামের গন্ধ, সব কিছু
মিলে মিশে গিয়ে একটানা পচা একটা গন্ধ তৈরি হয় এই সকালটার গায়ে। মশলা
বাজারটা খুলতে এখনো দেরি আছে, এখন শুধু মাছের বাজারটা ঘিরে
শব্দের
আনাগোনা। ভারী
বরফের চাঁই মাটিতে আছড়ে ভাঙার শব্দ, মুটে মজুরদের লরি থেকে মাছ খালাস
করার সময় দেহাতী হিন্দি আর বাংলা মেশানো খিস্তির বলিষ্ঠ বিস্ফোরণ, সস্তার
ঠেলাঠেলি আর মাছ বাজারে দর হাঁকাহাঁকির শব্দ। হারানিধির এসবে অভ্যাস হয়ে গেছে। এই শব্দটা
তার কানের কাছে শ্লেষ্মা মিশ্রিত ঘড়ঘড়ে গলায় বাজে ঘন্টির মতন। একটানা বেজে
চোখের বাসি ঘুমটাকে তাড়িয়ে দেয়, অ্যালার্ম ঘড়ির আর দরকার পড়ে না। এখন তার
তক্তপোষ ছেড়ে উঠে গিয়ে লরির গায়ে ঝুলন্ত বাল্বটা
নেভানোর কথা।
তারপর আস্তে আস্তে হারানকে তুলে পায়খানা বাথরুম সেরে বাজারের পথ ধরতে হবে। বাজারের
মধ্যেই হোটেলটা,
"বেঙ্গল লজ"। একইসাথে লজ ও ভাতের হোটেল। অবশ্য
হারানিধি যখন প্রথম এখানে কাজে লেগেছিল, তখন এটা শুধু ভাতের হোটেলই ছিল। এই হোটেলটার
মালিক ‘শশধর
গুপ্ত’, এই
এলাকার ‘গুপ্ত
দা’, হারানিধির
হাতের ছোলা দিয়ে কুমড়োর তরকারি, হালকা হিং ফোড়ন দিয়ে, সাথে সর্ষে দিয়ে বেগুনের ঝাল দিয়ে
ভাত মেখে খেতে খেতে বলেছিলেন, "কাঠ বাঙাল হয়ে ঘটি বাড়ির রান্না কী করে শিখলে হে?" বাজারের মাঝখানে সদ্য খোলা ভাতের ঝুপড়িটার খাবার
টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হারানিধি উত্তর দিয়েছিল, "আজ্ঞে কত্তা, মায়ের কাছে। ছেলেবেলায়
বাবা মারা গেছেন, আমরা
তিন ভাই বোন, মা
এদিক-ওদিক করে যা পেত, রেঁধে বেড়ে খাওয়াত। মায়ের হাতের
রান্না ছিল অমৃত, ছোলা
দিয়ে মোচার ঘন্ট রাঁধত ঘটি বাড়িকে হার মানিয়ে দেবে।" আশেপাশে
গাছের পাতার চাপে পৃথিবীটার সব ফুটো বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা সময়ে শশধর তাঁকে
প্রস্তাব দেয়,
"আমার দোকানে কাজ করবে? উড়ে বাউনটা সেই যে দেশে গেছে আর
ফেরার নাম নেই।
আপাতত মাস গেলে ৩০০ টাকায় ঢোকো, থাকা খাওয়া সব আমার ওখানেই, পরে আস্তে
আস্তে বাড়িয়ে দেওয়া যাবে।"
সেই থেকে হারানিধি,
গুপ্তদার হোটেলে নোঙর ফেলল। এই এত বছরে
শিয়ালদা ব্রিজের উপর দিয়ে চলা, টিং টিং ঘন্টির ট্রামগাড়িটা চলে গেছে কয়েক লক্ষ বার। ট্রামের
ভেতর বসে থাকা মুখটা জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে বাজারটাকে দেখেছে কয়েক অর্বুদ মাইক্রো
সেকেন্ড ধরে, ধুলোকাদা
জড়ানো একটা হাওয়াকে বুকে আঁকড়ে। হারানিধি আজ রাঁধুনি থেকে হোটেলের
কত্তা হয়েছে।
কয়লার উনুনের গনগনে আঁচ, ছাঁকা তেলে কড়া করে ভাজা মাছ, পুইশাঁকের চচ্চড়িতে মেশানো পাঁচফোড়ন
এসব ছেড়ে হারানিধি এখন খাবার সময় খদ্দেরদের দেখভাল করে। কার কী অসুবিধা,
কে কী নেবেন? কার ভাত লাগবে? কার ডাল
তরকারি? কে কী মাছ নেবেন,
কোন টেবিলে কত হল।
গুপ্তদা বাজারটা ও ছাড়া কারুর হাতে ছাড়েন না। নেহাত
পড়াশোনাটা বেশিদূর শেখেনি হারানিধি, নাহলে হয়তো
হিসেবের খাতাটাও ওই দেখত।
আজ থেকে তিরিশ বছর আগের রানাঘাট স্টেশনের বাইরে একটা মাটির দেওয়ালের বাড়িতে, খড়ের চালায়
ভাতের হোটেল খুলে বসা বছর তেইশের তরতাজা যুবক হারানিধি, কলকাতায়
এসেছিল কলোনির বিশুদার হাত ধরে। বাজারের
মাঝের জামগাছটা তখন সদ্য মাথা তুলছে। ওই গাছটাই একদিন আবছা আলো-আঁধারিতে
ভেবে নিয়েছিল ভবিষ্যতে সে বনবীথিকা হবে। আজ এলাকার
ছেলেপুলেরা ঢিল ছুড়ে গাছটা থেকে জাম পারে, ওর শরীর জুড়ে চামড়ায় ফাট দেখা দেয়, মুছে যায় স্মৃতির
জন্মদাগ। গাছটা
জুড়ে কয়েকশত কাক যত্নশীল সংশয়হীনতায়, ঘিঞ্জি বাসা বেঁধেছে নির্লজ্জ
বংশবিস্তারের আশায়।
রোজ বিকেলে নিয়ম করে হারানিধি ওদের মুখে ছুড়ে দেয় এঁটো ডেচকির গায়ে লেগে থাকা
পীতাম্বরী ভাতের দলা।
কাকগুলোর মাঝে বুক চিতিয়ে মাস্তানি করে বেড়ায় একটা শঙ্খচিল, ঐটাই
হারানিধির বাপ।
বাকিগুলো হয়তো ওরই পূর্বপুরুষ সব, জন্মান্তরে অনস্তিত্ত্বের সাজা খাটছে।
বাজারের মাঝখানের পোড়ো বাড়িটার ভাঙা দেওয়ালে, বাড়তি চৌকাঠে আছড়ে পড়ে ফেটে যাওয়া রোদটার গায়ে কান পাতলে বুঝতে পারা যায় রানাঘাটের রিফিউজি কলোনির ‘হারানিধি দাস’ এখন বেঙ্গল
লজের ভরকেন্দ্র।
তাকে ঘিরে হোটেলটা ফিরে পেয়েছে এক নিশ্চিন্ত যোগনিদ্রা, বিরামহীন
আগডুম বাগডুম এর মাঝেও তার নড়েটি যাবার উপায় নেই। তিনশো টাকার মাসিক বেতন এখন প্রায় ছয় হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। গুপ্তদা ওর
ছেলের পড়ার খরচ দেন।
সেরকম কোন অভাব অভিযোগ রাখেননি এককথায়। নিন্দুকেরা কিন্তু বলে হারানিধি ‘শসাবাবুর
গুপ্ত কথা’ জানে। তাই বেঙ্গল
লজে তার এত খাতির।
হারানিধিকে গুপ্তবাবু নিধি বলেই ডাকেন। তাই গল্পের পরবর্তী সময়ে আমরাও সেই
নামটিই ব্যবহার করব।
“ওঠ বাবা হারান। উঠে পর বাবা। ভোর হয়ে গেছে। চট করে ঘরদোরগুলো ঝাড়পোঁছ করে দে দিকিনি। ওই দেখ, ঝি-টা উঠোন ঝ্যাটাচ্ছে। তোকে কতদিন বলেছি ওটার পিছু পিছু থাকতে। ও বেটির হাতটান স্বভাব আছে। ওটাকে এবারে তাড়াতে হবে কত্তাকে বলে।"
ক্রমশ…
অনবদ্য
ReplyDelete