প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

ভিক্ষুক গাছ | তৈমুর খান

বাতায়ন/মাসিক/কবিতা/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | কবিতা তৈমুর খান ভিক্ষুক গাছ দু - একটি ভিক্...

Thursday, November 7, 2024

নবান্নের ঘ্রাণ ও চোরের গল্প | নির্মল ভানু গুপ্ত

বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক, ১৪৩১

চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | ছোটগল্প

নির্মল ভানু গুপ্ত

নবান্নের ঘ্রাণ ও চোরের গল্প


"তুমি যথেষ্ট সাহসী। না হলে চোরকে কেউ দরজা খোলেআমি তো ভাবলাম আজ বেঘোরে প্রাণটা যাবে। ওরা ধরতে পারলে আমায় পিটিয়ে এতক্ষণে মেরে ফেলত। ভাগ্যিস তুমি আমায় বাঁচালে। তোমার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারব না।"


বান্ন কী জিনিস এখনকার ছেলেমেয়েরা খুব একটা জানে না। আমাদের ছোটবেলায় এত কেক, পেস্ট্রি, রোল, পিজা বা চাউ ছিল না। আমাদের ছিল পিঠে, পায়েস, নারকেল নাড়ু, গজা, নিমকি, নবান্ন ইত্যাদি।

অগ্রহায়ণ মাস। আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে নতুন চাল এসেছে। আজ সকালে মা সেই চাল, আদা, আখ আর দুধ দিয়ে কাঠের জ্বালে পাটকাঠি দিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে নবান্ন রান্না করেছে। তার গন্ধে চারদিক ম-ম করছিল সকালে। এখন অনেক রাত হয়েছে। অত গন্ধ এখন আর নেই। আজ রাত্রেও যথারীতি জানলায় টোকা তিনবার। বুঝলাম কে এসেছে। জানালাটা একটু ফাঁক করে জিজ্ঞেস করলাম,
- কে?
আমার পরিচিত গলা,
- আমি।
আমি আস্তে করে দরজাটা খুলে ওকে ভিতরে আসতে দিলাম। বললাম,
- কী হয়েছে? আজও তাড়া খেয়েছ নাকি?
- না। এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমাদের বাড়ির থেকে একটা সুন্দর গন্ধ পেলাম, তাই।
- তুমি এত দূর থেকে গন্ধ পেলে কী করে?
- আমাদের চোখ-নাক-কান সব সময় খোলা রাখতে হয়। তা না হলে এই কাজ করি কী করে?
ওকে হাঁড়ির ঢাকা খুলে প্লেটে করে নবান্ন দিলাম খেতে। ও সবটা খেয়ে প্লেটটা চেটে খেল। ভাবছ কে এই লোক? কী কাজ করে? তাহলে গোড়া থেকে বলি।
আজ থেকে দুমাস আগের কথা। আমার ঘুম ছিল প্রবল রকম। এমনকি আমাদের পাশের বাড়িতে বোমা মেরে দরজা ভেঙে ডাকাতি হয়েছিল, আর আমি তা শুনেছিলাম পরদিন। সকালে আমার ছোটবোন বলল,
- ছোদ্দা, জানিস কাল রাত্রে স্বপন্দাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়ে গেছে।
আমি তো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তারপর বোন বলল,
- চল তোকে দেখিয়ে আনি।
আমি নিজে গিয়ে দেখলাম সত্যিই ওদের দরজা ভাঙা। দেয়ালে বোমের দাগ। তারপর থেকে রাত্রে আমার ঘুম আসতে খুব দেরি হতো। আমি খালি ভাবতাম আমাদের বাড়িতে যদি এরকম হয়। তাহলে কী হবে? সেদিন রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে আমি জেগে জেগে গল্পের বই পড়ছি হ্যারিকেনের আলোয়। আমাদের বাড়িতে তখনও ইলেকট্রিক আসেনি। রাত্রে তখন, এখনকার মতো এত গাড়ি চলত না। একটা বাড়ি থেকে আর একটা বাড়ির অনেকটা দূরত্ব থাকত। মাঝে থাকত বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। যার জন্য এ বাড়ির কথা বা সাধারণ আওয়াজ অন্য বাড়িতে খুব একটা যেত না। গল্পের বইয়ের মধ্যে ডুবে আছি। কানে আসছে শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক। হঠাৎ মনে হল দরজার পাশের জানালায় কেউ টোকা দিচ্ছে। মনে হল মনের ভুল! আবার যথারীতি ঝিঁঝিপোকার ডাকটা বেড়ে গেল।
 
আবার টোকা! পর পর তিনবার এবার বুঝলাম, না মনের বা কানের ভুল নয়। ঠিক শুনেছি। অনেক সময় বন্ধুরা দুপুরবেলায় খেলতে যাবার জন্য যেমন ডাকে, সাবধানে, যাতে মায়ের ঘুম না ভেঙে যায়, সেই ভাবে। আমি ভাবলাম কোনও বন্ধু হবে বোধহয়।
জানালাটা একটুখানি খুলে জিজ্ঞেস করলাম,
- কে? কী হল?
জবাব এল,
- আমি, খুব দরকার। বিপদে পড়ে তোমাদের কাছে এসেছি।
- তুমি কে?
- আমি চোর। খুব বিপদে পড়ে গেছি। দরজাটা একটু খুলবে?
শুনে আমার বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। আমি খানিক সামলে নিয়ে বললাম,
- এ আবার কী কথা? রাত্রে কি কেউ চোরকে দরজা খুলে দেয়?
- জানি দেয় না। কিন্তু আমি খুব বিপদে পড়ে তোমার সাহায্য চাইছি।
- বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে। আমি তোমায় দরজা খুলে দিই, আর তুমি পুরো বাড়ি খালি করে সব নিয়ে চলে যাও!
- তোমাদের বাড়িতে চুরি করার মতো কিছু আছে নাকি?
- নেই? আমার প্রাইজ পাওয়া গোটা কুড়ি গল্পের বই, কালীপুজোয় ফাটাবো বলে কুড়ি টাকার বাজি। আমার দুর্গাপুজোর নতুন জামা-প্যান্ট, আরও অনেক কিছু। এগুলো কী কম নাকি?
- আর আছে তোমার বাবার বালিশের তলায় মাইনের খামে দুশো টাকা। তাও কাল মাসকাবারি দোকানে ধার শোধ করতে চলে যাবে। আর তোমার মায়ের গলায় একটা রুপোর হার, কানে পাতলা সোনার কানের দুল। এই তো? আশ্চর্য চোরটা এসব জানল কী করে? বাবা আজকে ছশো টাকা মাইনে পেয়েছেন। দেনাদারেরা এসে চারশো টাকা জোর করে নিয়ে চলে গেছে। শুনেছিলাম চোরেরা সব খবর রাখে। আজ তার প্রমাণ পেলাম। আমি চুপ করে আছি দেখে চোরটা আবার বলল,
- দ্যাখো, আমি ডাকাত কালীর দিব্যি করে বলছি, তোমাদের কোনও ক্ষতি আমি করব না।
দিব্যির কথা শুনে আমি একটু দুর্বল হয়ে পড়লাম। বললাম,
- তুমি তোমার মায়ের নামে দিব্যি কাটো দেখি।
- মায়ের দিব্যি বলছি, তোমাদের কোনও ক্ষতি করব না। তুমি আমায় এখন বাঁচাও।
শুনে আমার খুব কষ্ট হল। আমার মা আমায় বলেন কাউকে অবিশ্বাস না করতে। কিন্তু তা বলে চোরকে বিশ্বাস! জিজ্ঞেস করলাম,
- সাথে আর কে আছে?
- আর কেউ নেই। তাড়াতাড়ি করো। আমি যে এবার ধনে-প্রাণে মারা পড়ব।
কপাল ঠুকে ঠাকুরের নাম নিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। চোরটা টপ করে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগল। আর আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকার জন্য ইশারা করল। ততক্ষণে এক দল লোক চোর চোর বলে চিৎকার করতে করতে চলে গেল মোড়ের দিকে।
এতক্ষণে হ্যারিকেনের অল্প আলোয় খেয়াল করলাম, চোরটার হাতে একটা বড় মতো পুঁটলি। ভাল করে দেখে মনে হল, বেশ ভারী। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- তোমার ওটার মধ্যে বোম নেই তো?
- না।
- তোমার কাছে বন্দুক নেই তো?
- নারে বাবা, আমি ডাকাত নই। আমি চোর। আমাদের কাছে ওসব থাকে না।
- তুমি আমায় মারবে না তো?
- না, না। আমায় একটু জল দিতে পারো? গলাটা ভয়ে শুকিয়ে গেছে।
আমি বালতির ঢাকা খুলে অ্যালুমিনিয়মের গ্লাসে জল দিলাম। চোরটা সব জল খেয়ে বলল,
- আর এক গ্লাস জল দাও।
দিলাম। সেটাও এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিল। চোরটার মুখে আর মাথায় একটা কালো কাপড় বাঁধা। কেউ চিনতে না পারে, সেই জন্যই বোধহয়।
- ভয় পেয়েছ বললে, তোমাদেরও ভয় হয়। তাহলে চুরি করো কী করে?
- আমরাও তো মানুষ। পেটের দায়ে চুরি করি। আমাদের ভয় থাকবে না?
- না, আমি ভাবতাম আমার মতো ভিতু কেউ নেই।
- তুমি যথেষ্ট সাহসী। না হলে চোরকে কেউ দরজা খোলে? আমি তো ভাবলাম আজ বেঘোরে প্রাণটা যাবে। ওরা ধরতে পারলে আমায় পিটিয়ে এতক্ষণে মেরে ফেলত। ভাগ্যিস তুমি আমায় বাঁচালে। তোমার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারব না।
- তোমার পুঁটলিতে কী আছে?
- তুমি দেখবে?
- ভয় পাবার মতো কিছু নেই তো?
- না। এই দেখো।
আস্তে করে পুঁটলির মুখটা খুলে দেখাল। অল্প আলোয় দেখলাম কতগুলো পিতলের বাসন, আর তার মধ্যে আর একটা পুঁটলি।
- এর মধ্যে কী আছে?
- এর মধ্যে আছে হাজার দুয়েকের বেশি টাকা আর কয়েক ভরি সোনার গহনা।
আমার হাঁ করে থাকা দেখে বলল,
- তাই জন্যই তো বললাম, তোমাদের বাড়িতে চুরি করার মতো কিছুই নেই।
- কেন?
- আমরা বই চুরি করি না। জামা-প্যান্টও চুরি করে বিশেষ লাভ নেই। আর বাকি যা আছে সেগুলো চুরি করার রিস্ক কে নেবে?
- তুমি ইংরেজি জানো?
- হ্যাঁ। কিছু কিছু। আমি হাইস্কুলে পড়েছি। তারপর বাবা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বেঘোরে মারা গেল, তখন আমি সিক্সে পড়ি। তারপর থেকে আমাকেই চুরি করতে বেরোতে হল। না হলে ছোট ছোট তিনটে বোন আর মা দিদাকে খাওয়াবে পরাবে কে?
আমি পুঁটলির দিকে দেখে বললাম,
- এটা তো একটা লুঙ্গি মনে হচ্ছে। এটা তোমার লুঙ্গি?
- না, না। যাদের বাড়ি চুরি করতে গেছিলাম, তাদেরই কারো হবে। হাতের কাছে পেলাম। তাই এটাতেই সব গুটিয়ে নিয়ে চলে এলাম।
- তুমি এখন বাড়ি যাবে তো? তোমার বাড়ি কোথায়?
- হ্যাঁ। আমার বাড়ি ঝিংরি মহল্লায়। সে এখান থেকে ধরো দশ’মাইল হবে।
- এত দূর থেকে চুরি করতে আসো?
- তা না হলে যে চুরির জিনিস ধরা পড়ে যাবে। আমি তাহলে যাই?
- তুমি তোমার কথা রেখেছ। তোমায় আমার খুব ভাল লেগেছে। আবার দেখা হবে কি?
- হ্যাঁ। আমি এ রাস্তায় আবার এলে তোমার সাথে দেখা করে যাব।
তারপর চোরটা আস্তে করে দরজা খুলে বেরিয়ে চলে গেল। আমার মনটা কেমন করে উঠল।
 
সেদিন থেকে আমার রাত্রে আবার ঘুম ঠিকঠাক হতো যেদিন চোরের কাছে জানলাম, আমাদের বাড়িতে চুরি করার মতো কিছু নেই।
 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)