প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

ডিভোর্স | স্বপ্ন ও বাস্তব

বাতায়ন/ডিভোর্স/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/১০ম সংখ্যা/৯ই শ্রাবণ , ১৪৩২ ডিভোর্স | সম্পাদকীয় "কম্প্রোমাইজ করে কোনক্রমে কাটত সুখের খোলসের আড়ালে অত...

Friday, May 16, 2025

শেষ থেকে শুরু [পর্ব— ২৯| পারমিতা চ্যাটার্জি

বাতায়ন/ধারাবাহিক উপন্যাস/৩য় বর্ষ/৮ম সংখ্যা/১৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
ধারাবাহিক উপন্যাস
পারমিতা চ্যাটার্জি
 
শেষ থেকে শুরু
[পর্ব— ২]

"সুচরিতা রাহুলের কানে কানে বললপ্রেগ্ন্যাসির টেস্ট-কিট একটা কিনে নিয়ে এসরাহুল শুনে তো লাফিয়ে উঠে সুচরিতাকে কোলে উঠিয়ে অজস্র আদরের ছোঁয়া দিয়ে দিল ওর মুঠোঁটচোখের পাতাগলা সর্বত্র।"


পূর্বানুবৃত্তি সজল এল কলকাতায়। আগেরদিন সজলের দাদা-বউদি ওদের ফ্ল্যাটে এসে সব পরিষ্কার করে রান্নার ব্যবস্থা করে রেখেছিল, সকালে ওর মাকে নিয়ে দাদা আসতে গেলে ছোটখাটো ঝামেলা হল। মাকে জীবনে প্রথম বাবার কথার উত্তর দিতে দেখল সজলের দাদা সুপ্রকাশ, মা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, এটা কি বাড়ি ছিল? বাড়ির নামে জেলখানা ছিল, হাতে-পায়ে আমার শেকলের দাগগুলো খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে, এবার আমি নিজে হাতে সব শেকল খুলে দিয়ে যাচ্ছিতারপর…

সবাই চলে গেল, দেখতে৷ দেখতে দিনও কেটে যেতে লাগল জলের মতন। রাহুল সুচরিতার বিয়ের তিনমাস কেটে গেল। সুচরিতা বিশ্বভারতী থেকে রিলিজ লেটার নিয়ে পুরুলিয়ার বলরামপুর কলেজে জয়েন করল।


শান্তিনিকেতনে মাঝে মাঝে গিয়ে ঘর সাজানোর সুন্দর সুন্দর জিনিস নিয়ে আসে তাছাড়া সুচরিতার বাড়ির জিনিসগুলো ওর বাড়িতে যে কাজ করত তাকে সব দিয়ে এল, পুরানো যা কিছু পিছনে ফেলে আসাই ভালো।
ভোরবেলা লখিয়া উঠে ফুলগাছে আরও কিছু ফল, সবজির গাছগাছালি পেছনে কিচেন গার্ডেনে লাগিয়েছে। লাখিয়াকে হাতে ধরে বাগান করা শিখিয়েছে সুচরিতা, গাছপালা ওর ভীষণ পছন্দ। রাহুলের মনে পড়ল সুচরিতার বাবার যে বাড়িটা ছিল সেই বাড়ির সামনে বেশ বড় বাগান ছিল, ছোট্ট সুচি বাবার পিছন পিছন ঘুরে বাবাকে বাগানের কাজে সাহায্য করত। আাসা যাওয়ার পথে ওদের বাড়িটা পড়ত আর ফর্সা রঙের কোঁকড়াচুলে ঘেরা বড় বড় চোখের সুচরিতা হাঁ করে রাহুলের দিকে তাকিয়ে থাকত। রাহুল কোনদিন ওকে বুঝতে পারেনি, ওর চোখদুটো কী বলতে চায়! রাহুলের মনে বিরাজ করত তখন চঞ্চল ছটপটে মনকলি। পাড়ার ফাংশনে মনকলির সাথে গান, সুচরিতার সাথে কখনও গান গাওয়া হয়নি। সজল আর রাহুল দুজনে পয়সাওলা ঘরের ছেলে, দুজনের কন্ট্রিবিউশানেই ফাংশানটা হত।
খুব মজা করতা তারা ফাংশনে। সুচরিতা আর মনকলি একই স্কুলে পড়ত, রাহুলদের বাড়ির তলায় ওদের স্কুলের বাসটা আসত আর রাহুল বারন্দায় দাঁড়িয়ে থাকত। ছটপটে মনকলি সমানে রাহুলকে হাত নেড়ে যেত, এমনকি বাসে উঠেও হাত নাড়ত, রাহুল লজ্জা পেয়ে যেত সে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকত আর হাত নাড়ত না। সুচরিতার মুখটা যে ম্লান হয়ে যেত তা রাহুল কখনও লক্ষ্য করেনি।
সেদিন সকালবেলা সুচরিতার হাতটা জড়িয়ে ধরে রাহুল ঘুমোচ্ছে, লাখিয়ার ডাক পড়ল,
-ও বউদিদি গো, উঠো উঠো বেলা যে গেল
সুচরিতা ওর হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করল, রাহুল ছাড়বার বদলে ওকে আরও জড়িয়ে নিল বেশ শক্ত করে। সুচরিতা হেসে ফেলল,
-কী ছেলেমানুষি কর রোজ সকালে, আজ উঠতে হবে না, চা খাবে না? আমার কিন্তু চা খেতে ইচ্ছে করছে, ছাড়ো প্লিজ।
রোজ এমনি করে ভুলিয়ে রাহুলের কাছ থেকে ছাড়া পায় সে। ঝটপট রান্না বসাল। লখিয়া সব গুছিয়ে রেখেছিল, মোটামুটি বউদিদি কী রাঁধবে তা আগেরদিন রাত থেকে জেনে রাখে, সেই বুঝে তরকারি কেটে রাখে। সকালের চা-বিস্কুট দাদা-বউদিকে দিয়ে ভাতটা বসিয়ে দেয়।
সুচরিতা এসে আজ মুসুরডালে ছোট ছোট পেঁয়াজ-রসুন কুচি নুন আর হলুদ দিয়ে সেদ্ধ বসিয়ে দিল, ভাতটা নামিয়ে অন্যদিকের গ্যাসে আলু পিঁয়াজকলি ভাজা বসাল। এদিকে ডাল সেদ্ধ হয়ে এলে, পাঁচফোড়ন আর রসুন থেঁতো করে ঘিয়ে ফোন দিল, এই ডালটা রাহুলের খুব প্রিয়। টিফিনের জন্য লাখিয়া পরোটার আটা মাখছে, রাহুল ময়দার পরোটা ভালোবাসে না আটার পরোটা খায়। আলু কড়াইশুঁটি সেদ্ধ করা ছিল, চটকে জিরে হিং ফোন দিয়ে ভাজা মশলার গুঁড়ো দিয়ে স্টাফিং তৈরি করে পরোটা বানানো হল, গরজালি মাছের ঝাল ধনেপাতা দিয়ে প্রায় একঘন্টার মধ্যে করে নিল। লাখিয়া অবাক হয়ে দেখত, কত তাড়াতাড়ি বউদি এতরকম রান্না করে ফেলে।
সুচরিতা বেডরুমের সাথে অ্যাটাচ বাথরুমে স্নান করতে গেল, রাহুল অন্য বাথরুমটায় স্নান করতে যায়।
তৈরি হয়ে এসে দুজনে খেতে বসল, হালকা রঙের শাড়িতে সুচরিতাকে খুব সুন্দর লাগে। ওর স্নিগ্ধ চেহারাটা যেন আরও বেশি স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। কতদিন পরে রাহুল সংসার পেল, তাই রাহুলও খুব মন দিয়ে সংসার করে, গুছিয়ে  বাজার, গ্রসারি করে। সুচরিতাকে আদর ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখে। প্রমোদবাবু আর তার স্ত্রীকে প্রায় আসতে বলে, ডিনার খাইয়ে দেয়। প্রমোদবাবুর স্ত্রীও মাঝে মাঝেই রোববার করে এদের খেতে বলে। তাছাড়া ফাংশন রিহার্সাল তো লেগেই আছে। দোল, সরস্বতী পুজো বিজয়া সম্মেলনে তো ফাংশন করে।
সমবয়সী বন্ধু কলিগ এদের সাথেও বেশ ভাল সময় কাটে।
সময় ছুটছে সময় তো আর বসে থাকে না, একবছর হয়ে গেল ওদের বিয়ের। বিয়ের তারিখের দিন সবাই চাইল, রাহুল সুচরিতার কাছ থেকে একটা পার্টি।
সুচরিতার শরীরটা খুব খারাপ হচ্ছে, কদিন ধরে খেতে বসলেই গা গুলিয়ে উঠছে, মাথাটাও থেকে থেকে ঘুরে  ওঠে।
রাহুল কিছু বুঝতে না পেরে খালি ডাক্তার ডাক্তার করছে।
সুচরিতা রাহুলের কানে কানে বলল, প্রেগ্ন্যাসির টেস্ট-কিট একটা কিনে নিয়ে এস, রাহুল শুনে তো লাফিয়ে উঠে সুচরিতাকে কোলে উঠিয়ে অজস্র আদরের ছোঁয়া দিয়ে দিল ওর মু, ঠোঁট, চোখের পাতা, গলা সর্বত্র। সুচরিতা রাহুলের আদরে অবশ হয়ে ওর বুকের কাছে গুটিয়ে এসে শুয়ে পড়লরাহুল বলল,
-আমি এখনি নিয়ে আসছি, রাহুল নিয়ে এলে দেখা গেল পজিটিভ এসেছে। পরেরদিন কলিগদের কাছে খোঁজ নিয়ে ডাঃ জি জাদক একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ। তার কাছেই রাহুল নিয়ে গেল সুচরিতাকে। তিনি সব দেখেশুনে বললেন,
-একদম সব ঠিক আছে। প্রথম দিকে দুসপ্তাহ অন্তর দেখান তারপর মাসে একবার করে দেখালেই হবে।
রাহুল সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সবাইকে জানাতে চাইছিল  কিন্তু সুচরিতা বলল,
-আগে তিনমাস পূর্ণ হোক তারপর জানাবে। এখন একসপ্তাহ রেস্ট মনে আছে তো ডাক্তার বলেছে?
-হ্যাঁ বাবা মনে আছে, তা বলে একদম পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকতে পারব না ব্যাস্
-ব্যাস্ বললেই তো আর হবে না, তুমি তো এত ছটপটে ছিলে না, শান্ত ছিলে এখন ডাক্তার বলেছে সত্যি রেস্টে থাকতে
সুচরিতা রাহুলের কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল,
-তোমার খাওয়ার কষ্ট হবে না?
-তারচেয়ে অনেক বেশি কষ্ট হবে আমার সুচির কষ্ট হলে, দেখ এখানে আমরা একা আছি, মাথার ওপর কেউ নেই, আর তোমার কোন অভিজ্ঞতাও নেই এ প্রথম সন্তান আসছে আমাদের, এরপর হতে হতে তঝন তোমার অভিজ্ঞতা অনেক বেড়ে যাবে
-হতে হতে মানে কটা বাচ্চা হবে আমাদের হ্যাঁ?
-এই কমপক্ষে বারোটা তো হবে,
-ঈশ আহ্লাদ আর কী! তুমি সামলিও আমি অতগুলো বাচ্চার জম্ম দিতে গিয়ে শেষে নিজেই মরে যাব,
রাহুল তাড়াতাড়ি ওর মুখ চেলে ধরে বলে,
-আরে আমি তো ঠাট্টা করছিলাম, এরক অলক্ষুণে কথা বলে না কি তা বলে?
-তুমি রাগ করলে গো?
সুচরিতার ছেলেমানুষিতে ওর ঠোঁটের ওপর হাত রেখে হেসে ফেলে বলল,
-আমি কী তোমার ওপর রাগ করতে পারি না কি? এতদিনেও বুঝলে-না, তুমি ছাড়া আমি যে অস্তিত্বহীন একেবারে, আমার সবটুকু জুড়ে শুধু তুমি আছ বুঝলে?
-হ্যাঁ বুঝলাম,
-তাহলে সকালে প্রথমে চা-বিস্কুট, তারপর তোমার পছন্দমতো ব্রেকফাস্ট, কোনদিন পরোটা, আলুর পরোটা, দোসা, ইডলি, ডিম টোস্ট, যা তোমার ইচ্ছে। মাঝখানে একটা ফল, তারপর লাঞ্চ বিকেলে চা-বিস্কুট, সন্ধ্যাবেলায় কিছু পুষ্টিকর স্ন্যাকস, রাতে আর্লি ডিনার, সবশেষে এক কাপ গারম দুধ।
-উরে বাবা আমাকে মেরে ফেললেও আমি এত খেতে পারব না,
-ঠিক আছে প্রথমেই হয়তো পারবে না, তারপর শেষের দিকে ঠিক পারবে,
-ঠিক পারব?
-হ্যাঁ ঠিক পারবে,
-মশাই ক সন্তানের বাবা একটু বলবেন যে এত অভিজ্ঞতা আপনার?
-আপাতত একজনের হতে যাচ্ছি,
-নাও অনেক বকবক হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পড় প্লিজ, প্রথম একটা মাস তো একটু সাবধানে থাক।
 
পরেরদিন রাহুলের কাছে সজলের মেইল এল, মনকলির অসুখটা অনেক বেড়ে গেছে, ডাক্তা টাইম দিয়ে দিয়েছে খুব বেশি হলে তিন মাস আর বেঁচে থাকতে পারে।
 
ক্রমশ

No comments:

Post a Comment

সে কি তৃপ্ত— ?


Popular Top 10 (Last 7 days)