প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Saturday, May 17, 2025

২৫শে বৈশাখ | পারমিতা চ্যাটার্জি

বাতায়ন/দহন/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
দহন | ছোটগল্প
পারমিতা চ্যাটার্জি
 
২৫শে বৈশাখ

"গাড়িতে উঠে বাচ্চাটার হাতে একটা ভালো চকোলেট দিয়ে রূপসার মাথায় একটা মোটা গোড়ের বেলফুলের মালা খুব সুন্দর করে জড়িয়ে দিল। রূপসা আনন্দে স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরল আর অনিরুদ্ধ পরম আদরে রূপসার কপালে একটা চুম্বন করল।"


রূপসা খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায় বিয়ের আগে থেকে নানারকম প্রোগ্রামে যুক্ত থাকত প্রায় একমাস ধরে চলত প্রোগ্রামের প্রস্তুতি রিহার্সাল ইত্যাদি।

 
বিয়ের পর তার একরকম কেন সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্বামী অনিরুদ্ধ ছিল উদাসীন, নিজের পড়াশোনা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকত। বিশেষ করে নামী প্রফেসর প্রতিদিনের লেকচারগুলো খুব ভালো করে তৈরি করত তারসাথে জোরকদমে এগিয়ে চলছে তার রিসার্চের কাজ।
 
মাঝেমধ্যে তাদের শারীরিক সম্বন্ধ হত সেদিন সে রূপসাকে খুব আদর করত কিন্তু রূপসার মনের খবর জানতে চাইত না। রূপসার এই দিনগুলো নিজেকে খুব অপমানিত লাগত, মনে হত সে শুধুই কারুর ভোগের বস্তু আর কিছু নয়। আবার রবীন্দ্রপক্ষ পড়ে গেছে, তার ননদও রবীন্দ্রসংগীত গায় তার মেয়েকে রূপসার কাছে রেখে সে গান গাইতে যেত রাপসারও সন্তান আসার ইঙ্গিত দেখা দিচ্ছে। শরীরটাও ভালো নয় ননদরা এসেছে এই শরীরে তাকে অনেক রান্না করতে হয়েছে বাড়িতে শাশুড়ি নেই তাই শ্বশুরমশাই কোর্মা-দোর্মা নানানরকম পদ তাকে দিয়ে  বানিয়েছেন তার মনেই থাকে না যে পুত্রবধূটি অন্তঃসত্ত্বা তার এইসময় এত পরিশ্রম করা উচিৎ নয়। মেয়েরা এলে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন আর এদিকে রূপসার এতগুলো রান্নার ভার তার ওপর এখন রবীন্দ্রপক্ষ চলছে ননদরা তার কাছে বাচ্চা রেখে রিহার্সালে গেছে। সেদিন অনিরুদ্ধ মনে মনে বাবার ওপর খব অসন্তুষ্ট হয়েছিল, আর কিছু না হোক এই সময়টা তো একটু খেয়ালে রাখা উচিৎ ছিল আর রূপসাও হয়েছে তেমনি কোথায় গিয়ে থামতে হয় জানে না নিজের কথা নিজেকেই বলতে হয় নিজেই বলবে আমি এত রান্না পারব না বা আমাকে এতসব রান্না করতে হবে টুয়াকে তোমরা সাথে করে নিয়ে যাও।
 
অনিরুদ্ধ জানে তার ওপর আশা করে থাকে সে, তার হয়ে অনিরুদ্ধ বলবে বলতেও পারে কিন্তু ও জানে যে ও বলতে গেলেই তুমুল অশান্তির সৃষ্টি হবে তখন রূপসাই আবার বলবে,
-কে তোমাকে আমার হয়ে বলতে বলেছে এবার তো আমাকেই সামলাতেই হবে।
তাই রূপসা নীরব থাকত। এবারে অনিরুদ্ধর কলেজের খুব বড় প্রোগ্রাম হচ্ছে অনিরুদ্ধ রুপসার নামটা দিয়ে দিয়েছিল। শ্বশুরের মুখ গম্ভীর বাচ্চাকে তাকেই সামলাতে হবে যদিও বাচ্চার রাতের খাবার, মেয়েজামাইয়দের জন্য নানারকম পদ রান্না করে তবে যাচ্ছে। অনিরুদ্ধ বলল,
-এত আগুনের তাতে এসময়ে তোমার থাকা উচিৎ না টুয়া হওয়া হবার সময় বাবা মাম্পিকে একদম আগুনের তাতে যেতে দিতেন না। তাই না বাবা?
শ্বশুর ঢোঁক গিললেন সত্যি তো রূপসা অন্তঃসত্ত্বা ওকে দিয়ে একটু বেশি পরিশ্রম করানো হয়ে যায়।
 
রূপসা শ্বশুরের পান সেজে, যা-যা ওষুধ খাওয়ার আছে সব হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে নিজে তৈরি হতে গেল।
আজ বউয়ের মুখে এটুকু হাসি ফোটাতে পেরে অনিরুদ্ধ খুব খুশি। অনেকদিন পরে বউয়ের হাসিখুশি মুখটা দেখতে পাচ্ছে।
 
আজ শ্বশুরমশাই বললেন,
-এবার এদের বলতে হবে, তোমার বউদিরও গান গাইবার শখ হয়েছে, আমি এই বুড়োবয়সে বাচ্চার আয়াগিরি করতে পারব না, ওর জন্য একটা আলাদা লোক রাখার ব্যবস্থা করো
অনিরুদ্ধ রূপসার দিকে চেয়ে ইশারা করে বলল,
-কই তোমার হয়েছে?
-হ্যাঁ হয়েছে
আজ রূপসা সত্যি খুব খুশি এই ভেবে যে স্বামীর সত্যি তার ওপর গভীর অনুভূতি আছে হয়তো সবসময় তা প্রকাশ করে না। রূপসা শেষমুহুর্ত অবধি কাজ সেরে ফ্লাক্সে শ্বশুরমশাইয়ের চা করে পাশে বিস্কুটের টিন গুছিয়ে রেখে তারপর বাবা আসি বলে শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করল শ্বশুরমশাইও পুত্রবধূর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন, ‘এসো মা এসো’। তাছাড়া এ বাড়িতে দুটো বাচ্চা কাজের মেয়ে আছে রূপসা ওদের হাতে চকোলেট খাওয়ার পয়সা দিয়ে বাচ্চাটাকে দেখতে বললেন আর বাবাকে যেন জ্বালাতন না করে এসব ভালো করে বুঝিয়ে বেরোতে যাবে তখন বাচ্চা একেবারে চৌবাচ্চা হয়ে গেল, সেও তার মামির সাথে যাবে, কিছুতেই তাকে ভোলানো গেল না। যাইহোক এখন অবধি বাড়িতে একমাত্র বাচ্চা বলে খুব আদরের এমনকি মামা-মামিরও খুব আদরের। ওকে কাঁদিয়ে রূপসার গান গাইতে যেতে বাধল। শেষকালে অনিরুদ্ধ বাচ্চাাটাকে কোলে নিয়ে বলল,
-চলো ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি চলো রূপসা৷
রূপসা বলল,
-তুমি ওকে সামলাতে পারবে?
-মামা হয়েছি দুদিন বাদে বাবা হব সামালাতে তো হবে নাও আর দেরি কোরো না চলো
গাড়িতে উঠে বাচ্চাটার হাতে একটা ভালো চকোলেট দিয়ে রূপসার মাথায় একটা মোটা গোড়ের বেলফুলের মালা খুব সুন্দর করে জড়িয়ে দিল। রূপসা আনন্দে স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরল আর অনিরুদ্ধ পরম আদরে রূপসার কপালে একটা চুম্বন করল।
 
সেদিন রূপসা অসাধারণ গান গাইল। অনিরুদ্ধ তো অবাক যে মেয়েটা এত ভালো গান করে আর এর গান বন্ধ করে দিয়েছিল তারা! অনিরুদ্ধকে সবাই জনে জনে বলে গেল তোমার বউ তো মাতিয়ে দিল ভাই দারুণ দেখো ওর গানটা যেন কখনও বন্ধ না হয়।
 
বাড়িতে এসে দেখে ননদরা বসে আছে, ঠাকুর আছে খেতে দিয়ে দিতেই পারে তবু সবাই যেন ইচ্ছে করেই রূপসার জন্যই অপেক্ষা করছে। রূপসা এসেই রান্নাঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, অনিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় বলল,
-ঠাকুর তো আছেই তুমি কাকে কী দিতে হবে বলে দিয়ে ওপরে গিয়ে চেঞ্জ করে বিশ্রাম করো। সকাল থেকে এই শরীরে অনেক পরিশ্রম গেছে।
ছেলের এই প্রথম প্রতিবাদ দেখে শ্বশুরমশাইও থতমত খেয়ে গেলেন। রূপসার সত্যি একটু বিশ্রামের প্রয়োজন তাই সেও আর কথা বলতে না পেরে সোজা ওপরে গিয়ে শাড়িটা বদলে শুয়ে পড়ল। এরপর অনিরুদ্ধ নীচে বলল,
-বাবা এরপর থেকে রূপসা যেখানে গান শিখত সেখানে শিখতে যাবে
শ্বশুরমশাই বললেন,
-যদি দুজনের একই দিনে হয়? তবে যে যার ব্যবস্থা করবে।
এমনিতেই রূপসাও দুদিন বাদে নিজে মা হবে তখন ওর পক্ষে দুটে বাচ্চাকে সামলানো সম্ভব হবে না। আজ রূপসা এত অপূর্ব গান গেয়েছে যে আমাদের প্রিন্সিপাল হাত জড়িয়ে ধরে বললেন,
-ওর কাছ থেকে কখন গানটা কেড়ে নিও না।
সবাই একটু চুপ করে গেল, তারপর অনিরুদ্ধ বলল,
-নে আয় তোরা খেতে বস আর আমি তোদের খাওয়াচ্ছি, এমনকি বাবাকে সুদ্ধ বসিয়ে দিল বাবা বললেন,
-তুই খাবি না?
ওর বোন টুয়া বলল,
-যে দাদার আজ খুব আনন্দ বউ ভালো গান গেয়েছে
শ্বশুরমশাই বললেন,
-না বউমাকে আর গান ছাড়তে দেওয়া যাবে না, বেচারা আজও অসুস্থ শরীরে এত রান্না করেছে আমিই বলতাম এ অবস্থায় বেশি আগুনের তাতে থাকতে নেই আর আমি যে কী করে ভুলে গেলাম তাই ভাবছি!
সবাই চলে যাবার পর অনিরুদ্ধ রূপসাকে নিয়ে খেতে এল। সবাই বেশ খুশি হলো অনিরুদ্ধ খুব সুন্দর করে ব্যাপারটা ম্যানেজ করল। অনিরুদ্ধ বলল,
-দেখলে তো কেমন বুদ্ধি করে ব্যাপারটা ম্যানেজ করলাম? এইজন্যই তো বলতাম সবসময় একা সবকিছু ম্যানেজ করা যায় না পুরুষদের মাঠে নামতে হয়
-নামতে হয় বুঝি?
-হ্যাঁ হয় তো! তাহলে আমিই সব সামলে দিলাম বলো?
-হ্যাঁ আজকের দিনটা আমি চিরকাল মনে রাখব।
-তাইতো কবি নিজের জন্মদিনের গান নিজেই লিখে গেছেন পঁচিশে বৈশাখ হে নূতন
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)