বাতায়ন/দহন/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
দহন | ছোটগল্প
জগন্নাথ
মহারাজ
কবিতার
মুখাগ্নি
"তোমরা তো জানো সনাতন ধর্মের কেউ মারা গেলে আত্মার শান্তির জন্য শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণভোজন করাতে হয়। আর স্রষ্টা যখন নিজ সৃষ্টি শিল্পের মুখাগ্নি করে তখন কবিতার শ্রাদ্ধে কবিদের ভোজন করাতে হবে না..."
বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। ওপারের ডাক যেন ভেসে আসে... কিন্তু ডায়েরি ভর্তি আমার অজস্র সৃষ্টি তাদের শেষ পরিনতি কী! হয় উয়ে কাটবে নয় ছেলে-বৌমারা দোকানে কেজি দরে বিক্রি করবে। এই ভাবনা কয়েকদিন থেকেই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে গেঁয়েো স্বভাবকবি রমেশ হালদারকে। নিম্ন মধ্যবিত্ত। আগে ছোট্ট একটা পানগুমটি ছিল সেটা এখন ছেলেদের দখলে।
বুড়োবয়সের শেষ সম্বল বার্ধক্যভাতাটাও ঔষধের পিছনেই
চলে যায়। ছেলেদের বই প্রকাশের কথা বললেই আগে লাভক্ষতির অঙ্কটা কষে নেয়। তাই শেষ
আশার পিদ্দিম যেন কলকাতা। কিন্তু বুড়োবয়েসে ছেলে-বৌরা তো
একলা ছাড়বে না। তাই মাথায় তাকে একটা মিথ্যা বুদ্ধি আঁটতেই হলো,
-শুনছ গিন্নি
এই প্রথম কলকাতায় সাহিত্যসভায় আমন্ত্রণ পেয়েছি। এই সুযোগ ছাড়া যায় বলো? আমি একা নয় স্থানীয় সাহিত্যিক বন্ধুরাও যাবে।
সরলা ঝাঁঝিয়ে বলল,
-তা সাবধানে
যেও বাপু। তুমি তো কারো বারণ শুনবে না। সাহিত্য সাহিত্য করে পাগল হয়ে গেলে, কী পেলে অর্থ না সম্মান… তার থেকে সংসারে মনটা যদি দিতে…
নিরুত্তর। এ যে মনের খিদের খোরাক
কাকে বোঝায়। সারারাত ঘুম আসে না ভোরের প্রতীক্ষা। পরদিন ময়ূরাক্ষী ট্রেনে চড়ে একলাই কলকাতা হাজির। প্রকাশকদের দরজায় দরজায় এ যেন এক মাধুকরী... জনৈক
প্রকাশক চশমার ফাঁকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে।
-কত টাকা খরচ
করতে পারবেন?
-খরচ করতে পারব
না বাবা। আমি দরিদ্র এক গেঁয়ো কবি তুমি যদি বুড়ো মানুষটার প্রতি একটু করুণা করো... গ্রন্থের সত্ত্ব তোমারই থাকবে। শুধু আশা
মৃত্যুর আগে যেন দেখে যেতে পারি একটা কবিতার বই...
প্রকাশক বিরক্ত স্বরে বলে,
-কবিতাগুলো
দেখি... কলকাতার কোন কোন বড় পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন…
-না বাবা।
স্থানীয় পত্রিকায়...
কথা শেষ হবার আগেই প্রকাশক
কবিতাগুলোর দিকে চোখ না বুলিয়েই রাগে গজগজ করে,
-যান, যান এই সব গেঁয়ো লেখা কেউ পড়বে না। যত সব পাগল-ছাগল কবি আমার
ব্যবসা লাটে তুলে দেবে দেখছি… ছেলে-বৌ নিয়ে পথে বসতে হবে।
সব শৃগালের একই বর। অসম্মান
আশাহীন এক নীরব যন্ত্রণায় রমেশ স্টেশনের পথ ধরে। সন্ধ্যায় ফিরে আসে বাড়ি। ক্লান্ত
শরীর তবুও রাত্রের অন্ধকারে সকলের অগোচরে কবিতার ডায়েরিগুলোকে বস্তাবন্দি করে নিয়ে যায় শ্মশানে। আগুনে দাহ করে। পাগলের মতো চায় ছাইয়ের
দিকে...। কত রাত জেগে হৃদয় নিভৃত আবেগ, বিরহ, আনন্দ, প্রেম অভিমানের জ্যোতির্ময় নক্ষত্রমন্ডলী আজ যেন স্রষ্টার
বুক শূন্য করে ঝরে গেল! কী অব্যক্ত যন্ত্রণা...
কয়েকদিন পর মোবাইল ফোনে
কয়েকজন স্থানীয় কবি বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে... কবি বন্ধুরা আনন্দিত
জমিয়ে সাহিত্য আড্ডা হবে। মধু মাষ্টার হেসে বলে,
-বৌদি আজ
তোমাদের বিবাহবার্ষিকী নাকি? রমেশ তো খুলে কিছু
বলে না...
সরলা বলে,
-না তো! তবে
আপনাদের বন্ধু কয়েকদিন ধরেই দেখছি কেমন মন মরা। ভালো করে কারো সঙ্গে কথাও বলছে
না। চেনা মানুষটাকে বড় অচেনা মনে হয়।
সকলেই বিস্মিত! সত্যিই তো
ইদানীং রমেশ তো সাহিত্যআড্ডায় যাচ্ছে না। থমথমে পরিবেশ। খাওয়ার শেষে রমেশ ম্লান
হেসে বলে,
-তোমরা তো জানো
সনাতন ধর্মের কেউ মারা গেলে আত্মার শান্তির জন্য শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণভোজন করাতে হয়। আর স্রষ্টা যখন নিজ সৃষ্টি শিল্পের মুখাগ্নি করে তখন কবিতার
শ্রাদ্ধে কবিদের ভোজন করাতে হবে না...
সবাই রমেশের কাণ্ড দেখে
স্তম্ভিত হয়ে গেল,
-এ কী! রমেশ কি পাগল হয়ে গেল...
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment