ধারাবাহিক
গল্প
অর্পিতা
চক্রবর্তী
উত্তরাধিকারী
[৪র্থ পর্ব]
"আমি বাঁচতে চাই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি ওদের জন্য বাঁচতে চাই। আমি আমার চারপাশের এই ভালবাসার মানুষগুলোর জন্য আরও একবার বাঁচতে চাই।"
পূর্বানুবৃত্তি তুমি শুধু আমাকে না তোমার মেয়েটাকেও ঠকালে। তুমি কাল সকালেই আমার বাড়ি
থেকে চলে যেও। তোমার মুখ দেখতেও আমার গা গুলিয়ে উঠছে। তারপর…
সুভাষ তাকিয়ে আছে প্রমিলার দিকে। এ কে? একে তো আমি চিনি না। আমার প্রমিলা এত কঠোর এত কঠিন। সুভাষ উঠে গিয়ে তার স্ত্রীর কাঁধে আলতো করে হাত রাখল।
-প্রমিলা তুমি
কি আমায় ক্ষমা করতে পারবে?
প্রমিলা বলল,
-ক্ষমা ঘৃণা এগুলো তো নিজের মানুষকে করা যায়। আর তুমি তো...
-আমি তো কি
প্রমিলা, বলো? প্লিজ বলো?
-শুনবে তুমি কে? তুমি হলে সুখের পায়রা। কখনও এ ডালে কখনও ও ডালে। তবে এভাবে
উড়তে উড়তে একদিন যেন পড়ে যেও না। আর যদি যাও সেদিন কিন্তু কেউ আসবে না তোমাকে
বাঁচাতে। যাক আর রাত কোরো না শুয়ে পড়ো। এ বাড়িতে আজই তোমার শেষ রাত।
সুভাষ বলল,
-তুমি শোবে না।
-শোব অবশ্যই
শোব, তবে এ ঘরে না বৃষ্টির ঘরে।
প্রমিলা চলে গেল পাশের ঘরে।
যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।
সুভাষ বন্ধ ঘরে হঠাৎ ছোট
শিশুর ন্যায় কেঁদে উঠল আর বলল,
-আমাকে ক্ষমা করো প্রমিলা, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো। আমি নিরুপায়।
আজ মহামান্য আদালতে রায়
ঘোষণা হল, বিচ্ছেদের সিলমোহর লেগেছে
সম্পর্কের মাঝে।
প্রথম দিকে বৃষ্টি খুব ভেঙে
পড়েছিল বাবার সিদ্ধান্তে। আসলে মেয়েটা বড্ড বাবার ন্যাওটা। কিন্তু রূপক ওকে
বুঝিয়েছে সম্পর্কের গুরুত্বটা জীবনে ঠিক কতখানি। যখন বিশ্বাসের সেতুতে ফাটল ধরে
তখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটাই শ্রেয়। বৃষ্টি একটু একটু করে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।
ও বাবার সাথে দেখা করেছে কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ওর সেই চেনা বাবা। আর আজ
যে আছে সে সুভাষ সেনগুপ্ত, বৃষ্টির বাবা না
হয়তো বাবার মতো অন্য কেউ।
মেয়েজামাই আর উমা এই তিন
জনের সহায়তায় আজ প্রমিলা মুক্ত। আইনত সে বিবাহবিচ্ছিন্না। চৌত্রিশ বছরের ধুলো
জমা অতীতে আইনের সিলমোহর পড়েছে।
কাল গুরুমায়ের আশ্রম থেকে
চিঠির উত্তর এসেছে। এবার তাকে যেতে হবে অনেক দূরে। বৃষ্টি উমা আর রূপকের সব চেষ্টা
ব্যর্থ হয়েছে। প্রমিলার বাকি জীবনটা কাটবে ওর গুরুমায়ের আশ্রমে হরিদ্বার থেকে
বেশ কিছুটা দূরে। আপাতত সেখানে অনেক কাজ। কী কাজ সেটা অবশ্য যাওয়ার পর জানা যাবে।
কাল প্রমিলা পা রাখবে এক নতুন
জীবনে। বৃষ্টির দাদুর নিজে হাতে গড়া এই বাড়িটা উনি দিয়ে গেলেন ওনার একমাত্র
মেয়ে এবং জামাইকে। মেয়ে অবশ্যই মায়ের সাথে যাচ্ছে। ওকে তো যেতেই হবে। মায়ের সব
লড়াইতে মেয়ে পাশে ছিল আছে আর থাকবেও।
হরিদ্বারের আশ্রমটা ভারি
সুন্দর। চারপাশটা সবুজে ঘেরা। আশ্রম সংলগ্ন একটা ছোট্ট স্কুল আছে। প্রমিলা সেখানে
বাচ্চাদের পড়াবে। বৃষ্টির চোখদুটো আবার ছলছল করছে। মা মেয়ের না বলা কথাগুলো কেমন
করে যেন বুঝে যায়।
-কী হয়েছে মা
আমার আবার চোখে জল কেন? আমি তো শুধু ঘরবদল
করেছি বাকি যা ছিলাম তাই আছি। তুই আর উমা তোদের যখন ইচ্ছা এখানে চলে আসবি। আমিও
সময় সুযোগ বুঝে চলে যাব। আমার তো এখন অনেক ঠিকানা। জানিস তো মা আমার শ্বশুর বাড়ির
প্রতিটা ঘর আমি নিজে হাতে সাজিয়েছি। আমি জানি তুই আমার মেয়ে। তুই ওই বাড়ির
যোগ্য উত্তরাধিকারী। তুই সব সামলে রাখতে পারবি।
-মা আমি
কোনোদিন বাবাকে ক্ষমা করতে পারব না। আমি কোনোদিন আর ওনার মুখদর্শন করতে চাই না।
আচ্ছা মা তোমার বাবার উপর রাগ হয় না। মনে হয় না ওনাকে কঠিন শাস্তি দিই।
মা হেসে মেয়ের কাঁধে হাত
রেখে বলল,
-যার কাছে সম্পর্কের কোন মূল্য নেই তাকে মানুষের পর্যায়ে
ফেলতে আমার ঘেন্না করে। এ জীবনে আমি কখনো কারোর অমঙ্গল প্রার্থনা করিনি আর আজও করব না।
তবে জীবনে অন্যায়ের সাথে আপোষ আমি কখনও করিনি আর তুইও করবি না। শুধু এটুকু মনে
রাখিস সব হিসাব একদিন মিলে যাবে। আর কেউ না করুক ঈশ্বর আছেন তিনি সব হিসাব মিলিয়ে
তারপর উপসংহার লেখেন। তোরা ভাল থাকিস। আমি মাসখানেক এখানে থেকে নিজের কাজকর্ম সব
বুঝে নিয়ে তারপর কলকাতায় আসব।
পাহাড়ের কোলে একফালি সবুজ
উপত্যকায় নতুন করে ঘর বেঁধেছে প্রমিলা। আবার সেই কচি কাঁচাদের কলতান, মাঝে মাঝে নাড়ির টানে কলকাতা। কেটে যাচ্ছে দিনগুলো।
সারাদিনের কর্মব্যস্ত জীবন তার মাঝে একটু অবসর। সবকিছুর মাঝেও একটা দলা পাকানো
কষ্ট গলার মধ্যে এমন ভাবে আটকে আছে যাকে ভোলা গেল না, ক্ষমা করা গেল না,
সে যেন
মনের অলিগলিতে সারাক্ষণ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে সবকিছু কেমন অসহ্য লাগে প্রমিলার
কাছে। তারপর সে আবার নিজেই নিজেকে বোঝায়, শান্ত করে।
-মাই ও মাই, ফুল লে লো ইয়ে আপকে লিয়ে হ্যায়...
অন্যমনস্ক প্রমিলা হঠাৎ
সম্বিত ফিরে পেল।
-কৌন হো তুম? কেয়া নাম তুমহারা?
-মেরা নাম
বারিস
-আপ মেরে দোস্ত
বনোগি?
একগাল হাসি হেসে বারিসকে কোলে
বসিয়ে প্রমিলা বলল, ধন্যবাদ ঈশ্বর তুমি
আছ। আমি বাঁচতে চাই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি ওদের জন্য বাঁচতে চাই। আমি আমার
চারপাশের এই ভালবাসার মানুষগুলোর জন্য আরও একবার বাঁচতে চাই।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment