ধারাবাহিক গল্প
পারমিতা
চ্যাটার্জি
আলোর
স্বপ্ন
[২য় পর্ব]
"তোমার মতন স্ত্রী অনেক ভাগ্যে মানুষ পায়, আমি আবার আগের আমিকে ফিরিয়ে আনব শুধু তোমার জন্য।
দিতিও আজ অনেকদিন পর অরুণের বুকে পরম তৃপ্তিতে মাথা রাখল।"
পূর্বানুবৃত্তি অরুণকে অদিতি বলল, এভাবে
শুয়ে না থেকে একটু রোজগারের দিকে মন দাও। দুবেলা যে খাচ্ছ
একবারও ভেবে দেখ কোথা থেকে সব আসছে! মেয়েটার কাল অঙ্কের
টেস্ট, ওকে
অঙ্কগুলো একটু করালেও তো সংসারের একটু সুবিধা হত। তারপর…
-আমি জানি, তাই বলছি এই হতাশা থেকে তোমাকে বেরিয়ে আসতেই হবে আর একমাত্র সংগীতই পারবে তোমার হতাশা কাটিয়ে আবার আলোর জগতে ফিরিয়ে আনতে।
-আমি কি আর
পারব দিতি?
-নিশ্চয়ই
পারবে, পারতেই
হবে তোমাকে, শুধু
রোজগারের জন্য নয়, তোমার
এই ট্যালেন্ট আমি এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি না।
অরুণ দিতির
হাতটা ধরে বুকের কাছে টেনে এনে বলল,
-তোমার মতন
স্ত্রী অনেক ভাগ্যে মানুষ পায়, আমি আবার আগের আমিকে ফিরিয়ে আনব শুধু তোমার জন্য।
দিতিও আজ
অনেকদিন পর অরুণের বুকে পরম তৃপ্তিতে মাথা রাখল। শুরু হল হারিয়ে য়াওয়া এক গায়কের
নতুন করে চলার পথ। অরুণ হারিয়ে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন ও অ্যাসিস্ট্যান্ট মিউজিক
ডিরেক্টর হয়ে কাজ করত এক বিখ্যাত মিউজিক ডিরেক্টরের আন্ডারে। সেই সময় ও নিজের সিডি
বার করত, নিজের
কম্পোজ করা গান নিয়ে। অনেক সিনেমায় মিউজিক ডিরেক্টর হিসাবে ডাইরেক্ট কাজ করেছে।
অরুণ সেনের তখন জমজমাট বাজার। এক-একটা ফাংশনের
জন্য ওকে প্রায় তিরিশ-চল্লিশ হাজার করে দেওয়া হত। তাছাড়া ছিল
অরুণ সেনের বিখ্যাত মিউজিক অ্যাকাডেমি, যেখান থেকে
পাশ করেও ছেলেমেয়েরা নিজেদের কেরিয়ার গড়ে নিয়েছে। সেই অরুণ
সেনের হঠাৎ মতিভ্রম হল। অ্যাসিস্ট্যান্ট মিউজিক ডাইরেক্টরের হয়ে কাজ করতে মুম্বাই গেল। একটি নামকরা সিনেমার গানের কম্পোজের সব ভার পড়ল তার
ওপর। গান লেখা থেকে সুর দেওয়া, এমনকি নিজের গলায় গাওয়া পর্যন্ত।
দিনরাত খেটে এককরে নিজের সবটুকু পরিশ্রম উজাড় করে দিয়ে গানের সৃষ্টি করল। ফিরে এল
প্রায় দুমাস পরে। এই দুমাস ও নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ
করেছিল, আর
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল কবে বইটা রিলিজ করবে। প্রতিটা গান ছিল তার বিভিন্ন
রাগের মিশ্রণে তৈরি।
দিতি ছিল
তার প্রিয় ছাত্রী, অদিতির
সাথেই সে জীবনকে আবদ্ধ করেছিল এক অবিচ্ছেদ্য ভালবাসার বন্ধনে। তার এই সুরের
সৃষ্টিতে অদিতির অবদানও অনেক জড়িয়ে ছিল। সে তাই মিউজিক ডাইরেক্টরকে অনুরোধ করেছিল
তার সাথে যেন অদিতি সেনের নামটাও থাকে। বই যেদিন রিলিজ হল তার তিন-চারদিন আগে তারা পৌঁছে গেল মুম্বাইয়ে। তাকে কথা দেওয়া হয়েছিল তার নামটাই
প্রথমে থাকবে কারণ সেই গানের কম্পোজ-সুর সব নিখুঁতভাবে
করেছে। আশার প্রহর গুণতে গুণতে অবশেষে এল সেই অপেক্ষার দিনটি। তারা উত্তেজনায়
কাঁপছে তখন। পর্দা উঠল, কিছু বিজ্ঞাপন চলছে এখনও প্রায় দশ মিনিট
অপেক্ষা করতে হবে। দশ মিনিট পর আরম্ভ হল সিনেমায় নাম দেখানোর পালা, একের পর এক
নাম দেখানো হচ্ছে, সংগীতের
নাম দেখে অরুণ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল— একি! এ কী দেখছে সে! তার নাম তো কোথাও নেই, না কথায়, না সুরে।
তার জায়গায় নাম রয়েছে বম্বের সেই বিশিষ্ট সুরকারের। হতাশ হয়ে বসে পড়ল সে। দিতি তাকে জড়িয়ে ধরে বাইরে নিয়ে এল, তখন তার কোনও জ্ঞান নেই,
এতদিনের এত পরিশ্রমের এই প্রতারণা সে নিতে পারল না। সিভিয়ার নার্ভাস ব্রেকডাউন
হয়ে প্রায় একমাস তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। আরও আঘাত পেল যখন সেই ছবির শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালনার জন্য সেই প্রতারক
সুরকার পুরস্কৃত হল। কলকাতার অনেক সুরকাররা অরুণের পাশে দাঁড়িয়ে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে
দিয়েছিল কিন্তু অরুণ নিজের অবসাদগ্রস্ত মনটাকে আর কাজে ফেরাতে পারেনি।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment